কিছু ভাল লাগেনা জামিলার। সারাক্ষণ শুধু ভাবেন। পড়শিরা এসময় তার সাথেই থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু জামিলা খুবই কম কারো সাথে কথা বলেন। পড়শীরা ভয় পায়। ও জামিলা, কথা বলোনা কেন? কথাবার্তা না বললে তোমার তো অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। থানায় তো কোন মামলাও করলেনা। মামলা করলে তবু মেয়েটার আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পেত।
রেগে ওঠেন জামিলা, আমি কারো কাছে কোন বিচার চাইনা, চাইবোও না, তোমরা জানো। তবুও বিরক্ত করো কেন এই কথাটা বলে?
অতি কাছের দু’একজনকে জামিলা বলেন, কী করা যায় বুদ্ধি দাও। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া স্বামীর কলার ধরে টেনে তোলেন জামিলা একদিন গভীর রাতে ।
ঘুমালে হবেনা। কিছু একটা করো। আমি ছাড়বোনা, এটা মনে রেখ। বদলা আমি নেবোই, নেব। কিন্তু কীভাবে, সেটা বলতে হবে তোমাকে। আগুন জ্বলতে দেখেন জামিলার চোখে স্বামী হাশেম।
ভয় পেয়ে যান হাশেম আলী। কী করবেন ভেবে পাননা। গতকাল শোনা এরকম আরো একটা ঘটনা খুলে বলেন জামিলাকে।
ঘটনাটা গতানুগতিক ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও বলেন কারন এক্ষেত্রেও মা-এর অনুভূতিটা জামিলারই মতো। আর মেয়েটা প্রতিবন্ধী, কথা বলতে পারেনা এবং মিলির মতো মরতে হয়নি অবশ্য মেয়েটাকে। অবলা বোবা মেয়েটা যখন ছট্পট্ করে এবং ঘটনাটার বর্ণনা করে অথবা করতে চায়, বিবেকবান মানুষের কলিজা তখন ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে।
আমি যাবো, কালকেই আমি তোমার সাথে যাবো মেয়েটার মা’র সাথে দেখা করতে।
আসলে তোমার মতোই সে-ও বিচার চায়না। বলে বিচার চেয়ে কী হবে? কিছুই না, তার চেয়ে আল্লাহ’র কাছে বিচার চাই আমি।
কিন্তু আমি তো আল্লাহ তা”লার কাছে বিচার চাইনা। তিনি তো করবেন পরে। বিচারহীনতার এই সমাজে আমি কী চাই তা তুমি জানো। আমাকে কাল ওখানে নিয়ে যাবে।
আচ্ছা যাবো নিয়ে। তোমরা কথাবার্তা বলবে, আমি ডাষ্টার বিক্রি করে ফেরার সময় নিয়ে আসব তোমাকে।
কুঁড়েঘরের ছ্টো একটা কুটির, তারই মধ্যে বাস করেন রাবেয়া বোবা মেয়েটাকে নিয়ে। স্বামী দিনমজুর একজন। দিন আনেন দিন খান। যেদিন কাজ পাননা, আগের কিছু না থাকলে উপোস করে থাকতে হয় সেদিন ওদের।
রুকু ওদের চৌদ্দ বছরের একমাত্র মেয়ে, আর কোন সন্তান নেই ওদের। জন্ম থেকেই কথা বরার শক্তি নেই মেয়েটার, তবুও কিছুদুরের এক প্রতিবন্দ্বী স্কুলে ক্লাশ সিক্সে পড়ে ও। চরম দু:খের মাঝেও কোনরকম কেটে যাচ্ছিল ওদের দিনকাল। এক সন্ধ্যায় মেয়েটার সর্বনাশ করে এলাকার বদমায়েশ সাদী। রাবেয়া বাড়ী ছিলেননা তখন, আর সেই সুযোগটাই নেয় পাষন্ডটা।
পানিতে ভরে যায় রাবেয়ার চোখ দু’টো কথাগুলো জমিলাকে বলার সময়। পরম মমতায় তা মুছিয়ে দেন জমিলা।
এরপর কেটে যায় অনেক, অনেকক্ষণ। কথা বলেননা কেউ, শুধু অনূভব করেন নীরবে একে অন্যের বেদনাগুলোকে।
মামলা করেননি কেন আপা?
কী হবে করে আপা! সাদী শয়তানটা লোক মারফৎ টাকার প্রস্তাব দেয়, আর ভয় দেখায় কোথাও যেন বিচার চাইতে না যাই আমরা। তাহলে খুুন করবে আমাদের।
তাহলে ভয়েই মামলা করেননি?
জামিলার এই কথায় রাবেয়া চুপ থাকেন কিছুসময়, এরপর আড়মোড়া ভাঙ্গেন তিনি। আত্মবিশ্বাসের কীরকম এক দ্যুতি যেন খেলে যায় তার চোখে। ভয় আমি পাইনা আপা। কী হবে! জীবনই যাবে, এটাই তো সর্বোচ্চ। আর তো কিছু হবেনা, নাকি? আমার মেয়ের জীবনে এতবড় ঘটনা ঘটে গেল, আমার জীবন নিয়ে আমি কোন্ লজ্জায় ভয় পাবো আপা? আমি দেখছি আপা, প্রতিশোধ কীভাবে নেয়া যায়, সেটাই ভাবছি।
আর সেজন্যই কী টাকা নেননি? আবার বলেন জামিলা।
ততক্ষণে রাবেয়াও্র জেনে গেছেন জামিলার দু:খ-ব্যাথাগুলো। ভাবেন একি জীবন হলো তাদের! প্রচন্ড ঝড় এসে যেরকম লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় সবকিছু, নদী যেমন গ্রাস করে নেয় বাড়ীঘরসহ সবকিছু নিমেষের মধ্যে, সেরকমভাবেই তাদেরও জীবনটা একইভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে এক নিমেষের মধ্যে। কথা বলতে ভাল লাগেনা আর তার।
আমি তো জানতে এতো পথ পেরিয়ে এসেছি আপা, আপনি কী করতে চান? আমার কথা শুনুন, আমি প্রতিশোধ নেব, প্রতিশোধ। আমার মেয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ, আমার মেয়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুত্বের প্রতিশোধ আমি নেবই নেব আপা। মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত দিয়ে বাম হাতের তালুতে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে জামিলা বলে ওঠেন।
আসেন হাত মেলাই আমরা আপা। আমিও চাই নরপশুদের এমন শাস্তি দিতে, জাতটা-ই যাতে ওদের চমকে ওঠে।
আবেগে উভয়ে উভয়কে জড়িয়ে ধরেন। ওদের এভাবে দেখে ছোট্ট কিশোরী রুকু পাশে এসে দাঁড়ায় ওদের, আলতো করে জড়িয়েও ধরে। (ক্রমশ:)

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress