এলোমেলো কিছু কথা…**একুশ**

নীলাঞ্জনা নীলা ১৮ নভেম্বর ২০১৬, শুক্রবার, ০৯:১১:০১পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩২ মন্তব্য

ছায়ার ভেতর কায়া, নাকি কায়ার পাশে ছায়া?...
ছায়ার ভেতর কায়া, নাকি কায়ার পাশে ছায়া?...

কথায় আছে পৃথিবী রহস্যময়। এর রূপ যতোটুকু প্রকাশিত, তারচেয়ে দ্বিগুণ/ত্রিগুণ অপ্রকাশিত। আবার এও বলা হয়ে থাকে নারী রহস্যময়ী। কিন্তু আমি বলি পৃথিবী কিংবা নারী নয়, মানুষ সবচেয়ে বেশী রহস্যময়তায় ভরা। কারণ আমরা নিজেকেই নিজেরা চিনিনা, অন্যদেরকে চেনা কিভাবে সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যতোই বলে যাননা কেন, "আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী!" সেই বিদেশিনীর নাম, পরিচয় আর ঠিকানাই জেনেছেন, কিন্তু তার অন্তর্সত্ত্বার সম্পূর্ণ রূপ কি চিনতে পেরেছেন? এই চেনা-অচেনা নিয়ে কতো কিভাবে যে মনের আবেগ প্রকাশ করেছেন আমার এই বুড়ো! একবার বললেন “চিনিলে না আমারে কি!” আবার এও বললেন,

“চেনা ফুলের গন্ধস্রোতে ফাগুন-রাতের অন্ধকারে
চিত্তে আমার ভাসিয়ে আনে নিত্যকালের অচেনারে।।”

আহা!! এতো কিছু কথা কেন? কারণ আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে একটা দ্বৈতসত্ত্বা বসবাস করে। রহস্য তৈরীর প্রধান কারখানা হলো মস্তিষ্ক। আমি জানিনা সৃষ্টিকর্তা মনে হয় ওই মস্তিষ্ক তৈরীর সময় ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন, আর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখলেন হায় হায় সময় তো একেবারেই নেই! তাড়াতাড়ি করে মস্তিষ্ক তৈরী করে বসিয়ে দিলেন মানুষের শরীরের উপরে। কাজের কাজ কি হলো, এমন প্যাঁচের জ্বালা নিয়ে মানুষ একবার প্রেমে পড়ে, আরেকবার হার্টফেলও করে। মস্তিষ্ক বলে “এই এখুনি ওই কাজ কর” মানুষ সেটাই করে। আবার বলে “তোর প্রেমে ওইজন পড়েছে, তুই ওকে পাত্তা দিসনা।” ব্যস হয়ে গেলো, কেউ ডুবে, কেউ সাঁতরায়, কেউ ভাসে, কেউ গাছে উঠে, কেউ মানুষ খুণ করে আর কেউ বাঁচাতে গিয়ে মরে। আহা মস্তিষ্কের কি খেল! আচ্ছা এ খেলা মস্তিষ্কর নাকি ‘আমার আমি’র?’ এখন নিশ্চয়ই সবাই ভাবছেন আসলে কি মাথামুন্ডু নিয়ে বলছি! আরে আমার নিজের মাথাতেই তো কাজ করছে না আসলে আমি কি বলতে চাইছি? মস্তিষ্ক নাকি দ্বৈতসত্ত্বা?

অনেক বেশী বকর-বকর করে ফেলছি। অবশ্য সাধে কি আর নাম দিয়েছি “এলোমেলো কিছু কথা?” আমাদের সকলের একটা দ্বৈতসত্ত্বা আছে, যার সাথে আমরা কথা বলি, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। এই দ্বৈতসত্ত্বা যতোটা উপকার করে, ঠিক ততোটাই অপকারও করে, তবে পরিমাণে দ্বিগুণ। কিভাবে? খুব রাগের সময় নিজের সাথে যে গজগজ করি তাকে আরোও উস্কে দেয়। কিন্তু একতরফা কিংবা দুই তরফা ভালোবাসায় ডুবে গেলে তখন কিন্তু ওঠায় না। মাঝে-মধ্যে যদিও ভুলবশতঃ বলে ফেলে, তবে তার পাওয়ার একশ’তে মাত্র দশ। একটা কথা না বললেই নয়, এই দ্বৈতসত্ত্বাই নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ দেয়। মানুষ হয়তো সে কারণেই একেবারে পিনপতন স্তব্ধতার মধ্যেও জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু দ্বৈতসত্ত্বাকে যখন সৃষ্টি করা হয় নতূন এবং আলাদা একজন মানুষ হিসেবে, তখন যে ভয়ঙ্কর এক সমস্যা তৈরী হয়, যার থেকে নিজেকে কখনোই মুক্ত করা যায়না। নিজস্ব ওই সত্ত্বাটা একজন মানুষ হয়ে লাভের চেয়ে বিশাল ক্ষতি করায়। যেমন আমি একজন, আমার ভেতরে যে একজনের বাস, তাকে আরেকজন হিসেবে বানিয়ে নিজের সামনে এনে দাঁড় করালাম। তখন আমি যা কিছু অন্যায় করবো, আমার তৈরী সেই একজন সেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে। হাজারও ভুল করলেও আমাকে সাপোর্ট করবে। কিছুতেই আমায় পজিটিভ হিসেবে কিছু ভাবতেই দেবে না। এমনকি যারা আমাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে, তাদের সব কথাতেই মনে হবে তারা আমার শত্রু। কোনো একটা গল্প থেকে একটা সিনেমা তৈরী হয়েছিলো। আর আমি দেখেছিলাম সেখানে নায়ক কোনো একজন মানুষকে খুণ করে এসে পরের দিন সকালে ভুলেই যেতো যে তার হাতেই একজন খুণ হয়েছে। নাহ তার ভেতরে কোনো অশরীরি না, আসলে সেই দ্বৈতসত্ত্বাই আরেক রূপে তারই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে চলেছে। আজকাল ইন্টারনেটে অনেকেই কিন্তু বিভিন্ন আইডি খুলে থাকেন বিভিন্ন নাম দিয়ে। এটা একধরণের অসুস্থতা। শুধু তা-ই নয় এই দ্বৈতসত্ত্বা নিজের ক্ষতি তার অগোচরেই করে থাকে। তারুণ্য বয়সে বোঝা যায়না, কিন্তু জীবনের এমন এক সময়ে এসে ওই সত্ত্বা নিজের সামনে দাঁড়ায়, যা কিছুতেই স্বস্তি এনে দেয়না। আবার অনেকে একই সাথে অনেকের সঙ্গেই আবেগ নিয়ে খেলে, সেটাও ওই দ্বৈতসত্ত্বারই কাজ। এই সত্ত্বা যে নিজের জীবনেরই ভিলেন সে কথা যতো তাড়াতাড়ি বুঝে নেয়া যায়, জীবনের জন্য ততোই মঙ্গল। অনেক লেকচার দিলাম। আর বেশী সময় নেবো না। পূর্ণেন্দু পত্রীর “কথোপকথন” কেউ পড়েননি, এমন মানুষ অন্তত খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুভঙ্কর আর নন্দিনী, আহা!

-তুমি আজকাল বড় সিগারেট খাচ্ছ শুভঙ্কর
-এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি । কিন্তু তার বদলে ?
-বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো?
-খেয়েছি।

===========================
তারপর,

-কি করছো?
–ছবি আকঁছি।
–ওটা তো একটা বিন্দু।
–তুমি ছুঁয়ে দিলেই বৃত্ত হবে। কেন্দ্র হবে তুমি। আর আমি হবো বৃত্তাবর্ত।
–কিন্তু আমি যে বৃত্তে আবদ্ধ হতে চাই না। আমি চাই অসীমের অধিকার।
–একটু অপেক্ষা করো। . . . এবার দেখো।
...............................................................................................
ওটা কি আঁকলে? ওটা তো একটা হৃদয়।
–হ্যাঁ, এটা হৃদয়। যেখানে তুমি আছো অসীম মমতায়, চিরন্তন ভালোবাসায়। এবার বলো আর কি চাই তোমার?
–সারাজীবন শুধু ওখানেই থাকতে চাই।

শুভঙ্কর-নন্দিনী পূর্ণেন্দু পত্রীর-ই দ্বৈতসত্ত্বা যদি বলি, ভুল হবে কি? লেখালেখির জগতে আমার কাছে কল্পনা মানেই নিজস্ব একটি সত্ত্বা। এই সত্ত্বা কখনো অপকার করতে জানেনা। কারণ এর বাস নিজের মধ্যেই, আলাদা একজন হিসেবে স্বীকৃতি নিতে জানেনা সে। সে-ই লিখিয়ে নেয় যখন যা আমি চিন্তা করি, আবার সম্পাদনাতেও সাহায্য করে। সে-ই ধরিয়ে দেয় দোষ এবং গুণ। সবশেষে এই কথাটি না বললেই নয়, নিজস্ব সত্ত্বাকে আরেক রূপে সৃষ্টি করতে যাওয়াটা বোকামী যেমন, আর তার ফলাফল স্বরূপ জীবনের চরম ক্ষতির সম্ভাবনা ৯৯.৯৯%। একেবারে একা হয়ে যেতে তো হবেই আর স্বস্তিও কোথাও, কোনোকিছুতেই পাওয়া যাবেনা।

**এই দ্বৈতসত্ত্বা সম্পর্কে লিখতে এসে মনে হলো মনোবিজ্ঞানে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ আমি, গভীরের আলোচনায় ‘নৈব নৈব চ।’ অনার্সে দর্শন সাবসিডিয়ারি ছিলো, আর ওখানেই মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুটা পড়েছিলাম। ওটুকু সেই অনার্সের আমলেই পড়ে থাক, এখনকার আবেগে কিছুতেই জায়গা নেই বাপু। এক্সিডেন্টের পর অফুরান সময়, আর তাই মাথার ভেতর গিজগিজ করে পাগলামী। সেসব পাগলামী ঢেলে দেই সবার মধ্যে। আর আপনারাও আমার এসব আউল-ফাউল কথাগুলোকে যত্ন করে আগলে নেন। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে এখন এতোটাই জ্বালাচ্ছি সবাইকে, আচ্ছা আপনারা কি বিরক্ত হচ্ছেন?**

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৬ নভেম্বর, ২০১৬ ইং।

এলোমেলো কিছু কথা…**বিশ**

0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ