মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভিতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।
-রমা চৌধুরী
রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। শিক্ষা জীবন শুরু করেন নিজ বিভাগেই। তারপর
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন ১৯৬১ সালে। সম্ভবত তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর !
কর্ম জীবন শুরু করেন কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে।
১৯৭১ সাল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রমা চৌধুরী তখন পোপাদিয়ায়। পৈত্রিক ভিটায়। সাথে তিন পুত্র সন্তান ও বৃদ্ধা মা। স্বামী তখন ভারতে।
১৯৭১ এর ১৩ মে। এই দিনটা রমা চৌধুরীর জীবনে কালো এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই দিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে উনার বাড়িতে। অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় রমা চৌধুরীর উপর। তিন শিশুপুত্র তখন ঘরে । নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জীবন বাঁচাতে ঝাঁপ দেন পুকুরের জলে।
প্রাণে বেঁচে যান। সেদিনই গানপাউডার ছিটিয়ে রমা চৌধুরীর বাড়িটি পুঁড়িয়ে দেয় রাজাকার ও পাকিস্তানিরা।
তারপর থেকে শুরু হয় দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন।
রমা চৌধুরীর লেখা 'একাত্তরের জননী ' গ্রন্থে সেইসব দুঃসহ দিনের কথা এভাবেই ফুটে উঠেছে,
" আমাদেরকে দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই আসছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকারের বাড়ি।সে বাড়ির দু'তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হয়। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার।"
তারপরের আট মাস কাটে জঙ্গলে লুকিয়ে ।রাতের বেলা পুঁড়া ভিটেতে খড়-পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে। বর্ষা কিংবা শীত , কোন ঋতুতেই নিজেদের রক্ষা করার সম্বলটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই।
অনাহার -অর্ধাহারে সন্তানেরা নানান অসুখে ভুগতে থাকে। ১৫ ই ডিসেম্বর রাত। বিজয়ের পূর্ব দিন। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ছেলে সাগরের। ডাক্তার-ঔষুধ-পথ্য কিছুই নেই। চারদিন এভাবে থেকে ২০ ডিসেম্বর মারা যায় সাগর। শোকে তিনি তখন অর্ধ পাগলিনী। ১৯৭২ এর ১৫ ই ফেব্রুয়ারীতে আরেক ছেলে টগরও একই অসুখে ভোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তিনি তখন পাগলপ্রায় হয়ে উঠেন পুত্রদের শোকে। এই সন্তানদের জন্যই তিনি আত্মহনন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।সন্তানদের মৃত্যুর পর প্রথম সংসার ভেঙে গেলে দ্বিতীয় সংসার করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন।
এই দুঃখিনী জননী সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী দুই পুত্রকে না পুঁড়িয়ে কবর দেন।
পুত্রদের হারিয়ে তিনি একটানা চার বছর পায়ে জুতা পরেন নি। যে পুত্রদের তিনি মাটিতে শুইয়েছেন সেই মাটির উপর জুতা পায়ে হাঁটতে নারাজ ছিলেন তিনি। দীর্ঘ চার বছর এভাবে হাঁটার পর প্রতিবেশীদের অনুরোধে জুতা পায়ে তুলেন।তাও শারীরিক অসুস্থতায়। কিছুদিন জুতা পায়ে রাখলেও গত ষোল বছর ধরে তিনি খালি পায়েই হেঁটে চলেন সবখানে ।
রমা চৌধুরীকে চিনতে চান ?
প্রখর রোদ কিংবা বৃষ্টি- বাদল। চট্টগ্রামের অলি-গলিতে যে বৃদ্ধা কাঁধে বইয়ের ঝোলা নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে বই বিক্রি করছেন , তিনিই আমাদের মা রমা চৌধুরী।
এভাবেই তিনি এখন পরিচিত। নিজের লেখা বই বিক্রি করেই নিজের যাবতীয় খরচ বহন করেন । এ যাবতকালে ১৮ টি মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
ব্যক্তিত্ববোধের অনন্য এক উদাহরণ রমা চৌধুরী ! তিনি একজন বিস্ময় মহিলাও। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন রমা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণেই। দুজন ভাগ করে নেন নিজেদের কষ্টকে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সহযোগিতার কথা বলা হলে তিনি বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ না করার কথা জানান। মূলত তিনি দুঃখের উপাখ্যান শোনাতেই দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে।
রমা চৌধুরীর সেই পুঁড়িয়ে দেয়া বাড়িতে 'দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেছেন নিজের প্রচেষ্টায়। বেঞ্জামিন পার্কারের বিখ্যাত একটা উক্তি মনে পড়ছে-
" With great power comes great responsibility."
স্বাধীন দেশে আমাদের একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী সেই মহৎ দায়িত্বের ভার একাই বহন করছেন!
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লাল-সবুজ পতাকা দিয়েছে, বিশ্বমানচিত্রে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছে ।কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেড়েও নিয়েছে অনেক । সম্ভ্রম হারানো মায়েরা দেহে বয়ে বেড়াচ্ছেন হায়েনাদের নির্যাতনের দিনগুলোকে।এমন দুঃখগাঁথা উপাখ্যানেরই এক নাম রমা চৌধুরী।
এইসব বেদনার স্মৃতি , বিষাদময় , যন্ত্রণার ক্ষত বয়ে চলা বীরাঙ্গনা মায়েদের জন্য ভালোবাসা মিশ্রিত বিনম্র শ্রদ্ধা ....

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress