একাকিত্ব

রোকন রিপন ১০ নভেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:৪৭:৩৬অপরাহ্ন অণুগল্প ১৭ মন্তব্য

কয়েক দিন ধরেই আমার মালিক বাড়িতে নেই। এতবড় বাড়িতে আমি সম্পূর্ণ একা । একা থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কোন নিয়ম মানতে হয় না। যা ইচ্ছা তাই করা যায়। আর একা থাকার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। এবারই প্রথম না। এর আগেও অনেকবার একা থাকতে হয়েছে আমাকে।

গ্রামের শেষ প্রান্তে আমাদের এই বাড়ি। বাগানে ঘেরা প্রাচীর দেওয়া বাড়ি এই গ্রামে এই একটাই। গ্রাম বললে ভুল হবে সম্ভবত এই এলাকার সবচেয়ে সুন্দর আর পুরনো জমিদার বাড়ি এটা। এতবড় বাড়ির দেখাশোনা করা আমার একার পক্ষে কষ্ট কর। তবুও অন্য কাউকে রাখতে দিই না আমি। এতবড় বাড়ির কর্তৃত্ব আমার একার হাতে। অনেকই আসে আমার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য, পাত্তা দিই না আমি। আমি বুঝতে পারি আমার মালিক আমাকে অনেক ভালোবাসে । তিনি থাকলে মনের মধ্যে জোস থাকে। মালিক চলে যাওয়ার পর থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।

দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনির পর খাবারের ব্যবস্থাও নিজেকেই করতে হয় । একটা সময় ছিল যখন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য বেতন ভুক্ত কর্মচারী নিয়োগ করা ছিল। আমার যখন যা প্রয়োজন সব বিষয়ে খেয়াল রাখত, পারলে মুখে তুলে খাইয়ে দিত। সেসব কেবলই এখন স্মৃতি। এখন সারারাত বাড়ির ভিতরে বাইরে পায়চারি করতে করতে কেটে যায়। সময় কাটানোই কষ্টের। আমি সময় কাটানোর খুব সুন্দর পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছি। ভাবনার অতলে তলিয়ে যাওয়া, স্মৃতির গভীরে ডুব দিলে সময় টা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত আর চারপাশটা হয়ে যায় ঘোলাটে।

মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। এতক্ষণ পায়চারি করে ক্লান্ত হয়ে গেছি । বয়স বেড়ে গেলে যা হয় আর কি । অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠি। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। বাসার সামনে একটু উচু জায়গায় বসে পড়লাম। মধ্যরাতের এমন সময়ে অন্যদিনের মতো ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম । মানুষ এবং কুকুরের মধ্যে মিল অমিলের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। এসময় অন্যান্য দিন কিছু বন্ধু বান্ধব আসে। তাদের সাথে জীবনের সাথে সময়ের সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা হয়। আজ কেন যে কেউ এলোনা । এই নিশিথ রাতের নিরবতা ভেঙে হাঁক ছাড়লাম কয়েক বার তাতে রাতের নিরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বাড়ির সামনে বসে ডাক দিলে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। এই প্রতিধ্বনির খেলাটা অবশ্য দু তিন বারের বেশি ভালো লাগে না। আবার ও ডুবে যাই নিঃসঙ্গতার অতল গহিনে

কেন জানি মালিক ফিরে আসছে না। সময়ের হিসাব আমার কাছে অর্থহীন।  আমি শুধু দিন আর রাতের হিসাবে সীমাবদ্ধ। মনে হচ্ছে অনন্ত সময় ধরে আমি এই বাড়িটাকে আগলে রেখে আছি । শরীর আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। একটু হাঁটা হাঁটি করলেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি। একাকিত্বের যন্ত্রণায় মন থেকে শরীর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইদানিং খাবার সংগ্রহ করা খবই কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। একটু পানি খাওয়ার জন্যেও অনেক দূর যেতে হয়।

মনে হয় অনন্ত কাল ধরে আমি পড়ে আছি । পানি খাওয়ার জন্যে দুদিন আগে আমি ঘর থেকে বের হয়ে এই মূল ফটকের কাছ পর্যন্ত এসেছি। শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করেও আর এক ইন্ঞিও এগুতে পারছি না। দুদিনের কাঠ ফাটা রোদ্দুরে চামড়া ভেদ করে হড্ডি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। মুখ থেকে জিভ বের হয়ে গেছে অথচ জিহ্বায় এক ফোটা লালা নেই। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বিগত দিনের রঙিন জীবন। আজ আমার মায়ের কথা মনে হচ্ছে খুব। বাবাকে আমি দেখিনি কোনদিন। মা খুব কষ্ট করে আমাদের ছয় ভাই বোন কে মানুষ করেছে। চোখের সামনে অন্ধকার । স্মৃতি গুলোও ধূসর হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আফসোস সৃষ্টিকর্তা আমাকে কুকুর না বানিয়ে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করলে আজ হয়তো একাকিত্বের এমন করুন যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না।

ঢাকা থেকে তালহা যুবায়ের তার বন্ধু তাহমিদকে নিয়ে এসেছে তাদের জেলার সবচেয়ে পুরনো আর দৃষ্টি নন্দন জমিদার বাড়ি দেখাতে। বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কয়েক বছর ধরে। বাড়ির সামনে আসতেই তারা দেখতে পেল মূল ফটকের কাছে একটা বিদেশী কুকুর মরে পড়ে আছে।।

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ লেখা

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ