১.
আমি তখন অনেক ছোট, বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে। গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। অবাধ স্বাধীনতা, বাঁধভাঙা আনন্দ আর গাছের সবুজ পাতার মতই সজীব মন নিয়ে বেড়ে উঠছিলাম। গ্রামেরই একটি সমবয়সী ছেলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সারাদিন তার সাথে খেলাধূলা অতপর কোনদিন তার বাসায় খাওয়া তো কোনদিন আমার নিজের বাসায় দুজন মিলে খাওয়া। ছেলে আর মেয়েতে কোন বিভেদ বোঝার বয়স তখন আমার হয়নি। তাছাড়াও চিরকালই আমার বুদ্ধি সুদ্ধি একটু কম। যাই হোক, একদিন খেলতে গিয়ে দেখি ছেলেটি কোথা থেকে যেন একটি টায়ার নিয়ে এসেছে। আমি তখন দক্ষিণ ঘরের দাদুর বাড়ির পেছনের লিচু গাছে বসা। টায়ারের মত একটা অদ্ভুত নতুন জিনিস চোখে পড়ায় আমি তরিঘরি করে গাছ থেকে নেমে এলাম। এসে জিজ্ঞেস করলাম,
: এটা কি?
: এটা টায়ার।
এটার পেছনে লাঠি দিয়ে বারি দিয়ে কিভাবে দৌড়াতে হয় তা সে আমাকে বুঝিয়ে দিল।আমি সেই টায়ার দেখে মহা অবাক! আমারতো এমন খেলনা নেই৷আছে শুধু কয়েকটা পুতুল আর হাঁড়ি পাতিল। এবার আমার এটাও চাই! ছেলেটাকে বললাম…
: তোমার খেলনাটা আমাকে দেবে? একটু পরেই দিয়ে দিব। আমার পুতুলটাও তোমায় খেলতে দেব।
: ঠিকাছে টায়ার দেব। কিন্তু আমার পুতুল চাই না। তোমাদের ঘর থেকে যদি একটা জিলাপি এনে দাও, তাহলেই হবে।
: আচ্ছা, নিয়ে আসছি। জিলাপি খেয়ে আমরা টায়ার খেলব।
ছেলেটি সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে আমি তাকে জিলাপি এনে দিলাম। জিলাপি খেয়ে টায়ার হাতে নিয়ে ছেলেটি দিল ভোঁ দৌড়! আমি তো অবাক! জীবনের এই প্রথম প্রতারণা নামক বিষয়টার সাথে আমি পরিচিত হলাম, যদিও বিষয়টার নাম যে প্রতারণা তা জেনেছিলাম আরও বহুকাল পর। ততদিন নাম না জানা এক অনুভূতি আমার মনকে বিষিয়ে তুলতো।
এর কিছুদিন পর পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে গেলাম। ভুলে গেলাম টায়ারের গল্প। কিন্তু যখনই নতুন কেউ আমাকে ঠকাতো, তখনি চোখে ভেসে আসতো সেই টায়ার…
২.
আমার বাসা পলিটেকনিক মোড়, ময়মনসিংহ।ফলে প্রায়দিনই সৈয়দ নজরুল কলেজের সামনে থেকে অটোতে উঠি, টেকনিকেল মোড়ে এসে নামি। আমি জানি এতটুকুর ভাড়া ১০ টাকা, কিন্তু কিছু চালক খুব ঝামেলা করে আরও পাঁচ টাকা আদায় করে। তাই ঝামেলা এড়াতে সর্বদা ১৫ টাকা দিয়ে দেই। ফলে ভাড়া যে মূলত ১০ টাকা তা আমি ভুলেই গেছিলাম। একদিন আমার কাছে পাঁচ টাকা ভাংতি না থাকায় অটোমামাকে ২০ টাকার নোট দেই। তিনি আমাকে ১০ টাকা ফেরত দেন। আমি বললাম,
“ভাড়াতো ১৫ টাকা। আপনি ৫ টাকা ফেরত দেবেন।”
তিনি বললেন,
“ভাড়া ১০ টাকাই মামা।”
এবারও আমি তাঁর সততা দেখে মুগ্ধ হয়ে অটোর চলে যাওয়ার পথে চেয়ে রইলাম।
একটা ছোট্ট জীবনে যা শিখলাম তা হলো,
বেশিরভাগ মানুষ প্রতারক হলেও, দু/একজন সৎ মানুষ কোথাও না কোথাও থাকে। যদিও তাঁদের দেখা পাওয়া দুঃসাধ্য।
১৬টি মন্তব্য
বন্যা লিপি
কথায় বলে “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা”
আমরা জীবনের প্রতিটি স্তরে স্তরে শক্ষার যাঁতাকলের মাঝখানে পরে আবার বেরিয়েও আসি। পরবর্তি পর্যায়ে গিয়েই আবার ভুলে যাই। খুব কম সংখ্যক সৌভাগ্যবান/ বতী থাকেন একটা শিক্ষা থেকে বাকিটা পথে নিজেকে অটল রেখে চলতে পারা। কমসংখ্যকের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলে সেটাও বড্ড সৌভাগ্যের ব্যাপার।
নীরা সাদীয়া
আমি সে শিক্ষা অব্যাহত রাখতে পেরেছি কিনা জানি না। মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করে ফেলি।
শুভ কামনা।
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ স্মৃতিমুখর অনুগল্প ভাল লাগল আপু
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ ভাইয়া।
তৌহিদ
জীবনের চলমান বৈপরীত্য। এতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।
ভালো থাকুন আপু।
নীরা সাদীয়া
আপনিও খুব ভালো থাকেন ভাইয়া।
সাখাওয়াত হোসেন
দারুণ লিখেছেন। শুভেচ্ছা রইলো অবিরত।
নীরা সাদীয়া
শুভ কামনা জানবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভালো মন্দের চমৎকার উপস্থাপন করলেন আপু। এভাবেই আমরা ঠকছি, শিখছি আর নিজেদের ঝুলি ভারী করছি সততা আর অসতের অভিজ্ঞতায়। এখনো মানুষ চিনতে ভুল হয় , সবাইকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলি। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
নীরা সাদীয়া
খারাপ সময় কেটে গেলেই পূর্বের শিক্ষাগুলো ভুলে যাই। মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলি, পরিনাম প্রতারণা।
শুভকামনা।
খাদিজাতুল কুবরা
পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখে ভালো মানুষগুলোই।
আবার প্রতারকের ও কোন কমতি নেই। নিত্য নতুন রুপে ওরা জাল বিস্তার করছে।
সুন্দর গল্প পড়ে ভালো লাগলো
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। কিন্তু এত খারাপের ভীড়ে ভালো মানুষ চেনা দায়।
শুভকামনা সতত।
রেজওয়ানা কবির
এরকম প্রতারণার শিকার আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবেই হয়ে থাকি,কিন্তু আবার এমন অনেক মানুষই আছে যারা প্রতারণার হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। ভালো-মন্দ নিয়েই মানুষ, ভালো আছে বলেই পৃথিবীতে এখন ও ভালো কিছু ঘটে। ভালো লিখেছেন আপু। শুভকামনা ।
নীরা সাদীয়া
একদম তাই। ভালোও আছে কালোর পাশে।
শুভকামনা সতত।
আরজু মুক্তা
জীবন যেভাবে চলে।
নীরা সাদীয়া
এভাবেই জীবন চলে যায়।