দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ‘স্ট্র্যাটিজিক্যালি’ গুরুত্বপূর্ণ দেশ বা এলাকা হলো কাশ্মির। চারদিকে ভারত,পাকিস্তান ও চীন বেষ্টিত এই “ল্যান্ড-লকড” দেশটি মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এই দেশটি যার দখলে থাকবে সমগ্র এলাকার ওপর খবরদারী করার, , যাকে বলে 'মোড়লগিরি' করার, ক্ষমতা সে দেশ অর্জন করবে।

প্রাচীন বহু রচনায় কাশ্মিরের কথা পাওয়া যায়, মহাভারতেরএই অঞ্চলটির নাম ছিলো ‘কম্বোজ’ (কম্বু = শঙ্খ)। ধারণা করা হয় এই অঞ্চলটি পূর্বে বিশাল বড় সাগর ছিল, যেখানে কম্বু বা শঙ্খ পাওয়া যেত। মারিচি-পুত্র কশ্যপ ঋষি ‘বারামূলা’র (বরাহ-মূলা) কাছে একটি খাল কেটে এই সাগরের জল অপসারণ করে এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের বাস করতে নির্দেশ দেন। সম্ভবত সেই কারণে সাগর সংকুচিত হয়ে “ডাল লেক”-এ পরিণত হয়ে গিয়েছে! সেই সময়ে এই অঞ্চলটির নাম হয় কশ্যপ-পুর।

গ্রীক বিজয়ের পর এই এলাকাটির নাম হয় ‘কাস্পাপিরস’। হেরোডাটাসের সময় এর নাম হোয় ‘কাস্পাটিরস’। টলেমীর রচনায় এই অঞ্চলটি ‘কাস্পেইরিয়া’ বলে অভিহিত করা ছিল। সম্ভবত এই ‘কাস্পেইরিয়া’ থেকেই এই অঞ্চলটির নাম উচ্চারণ ভেদে কাশ্মির হয়ে ওঠে।

বর্তমানের কাশ্মির প্রাচীন কালে, ১৯৪৭ সালের আগে, লাদাখ, জম্মু, কাশ্মির, গিলগিট, বাল্টিস্থান, আকসাই চিন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্রাক্ট এই কএকটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল।

আজ থেকে ১০০০ বছর আগে এই এলাকাটি প্রথমে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দখলে ছিলো। নবম শতকে এখানে শৈবাবলম্বীদের দখলে চলে যায়। কাশ্মিরে ইসলাম আসে ১৩শ অব্দের দিকে। সুফিপন্থী সাধকদের প্রভাবে সুফী আধ্যাতিকতা সারা কাশ্মিরে ছড়িয়ে পড়লেও জম্মু অঞ্চলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্টতা বজায় থাকে।

১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মিরের শাসন ক্ষমতায় বসেন ও সালাতিন-ই কাশ্মির রাজ্য গড়ে ওঠে। প্রায় ৫০০ বছর মুসলমান শাসকরা কাশ্মির শাসন করে।

মুগল বাদশাহরা ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১, আফগান-দুররানী রাজবংশ ১৭৫১ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় ছিলো। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিং কাশ্মির দখল করে নেয়। ১৮৪৬ সালে প্রথম এংলো-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়ে জম্মুর রাজা গুলাব সিং অমৃতসর চুক্তিতে ব্রিটিশ রাজের অধীনে কাশ্মিরের নতুন শাসক হন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে কাশ্মিরের ভাগ্য কোন সমাধান না করে, সমস্যাসঙ্কুল রেখে ব্রিটিশরা দেশ ত্যাগ করে। ফলে কাশ্মিরের দাবীদার হয়ে দাঁড়ায় ভারত, পাকিস্তান ও চীন।

রনবীর সিং-এর পৌত্র হরি সিং কাশ্মিরের রাজা হন ১৯২৫ সালে। ব্রিটিশদের পদলেহন করে তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিরুপদ্রবে কাশ্মিরের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর ব্রিটিশ-ভারতীয় উপমহাদেশ ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া ও ডমিনিয়ন অব পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত হিন্দুপ্রধান স্বাধীন রাজ্যগুলির কয়েকটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারতের সাথে যোগ দিলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট হায়দ্রাবাদ সহ দুইএকটি রাজ্যের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে ভারতের সাথে যুক্ত হয়ে যেতে বাধ্য করে, যেভাবে পরবর্তীতে ভারত গ্রাস করে ফরাসী উপনিবেশ চন্দননগর, পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়া-দমন ও দিউ, আন্দামান, কেরালা ও আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য।

১৯৪৭ সালে কাশ্মিরের জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ ছিল মুসলিম। কাশ্মিরের মহারাজা পাকিস্তানের সাথে ‘স্থিতাবস্থা' চুক্তি স্বাক্ষর করলেও ভারতের সাথে তিনি তেমন কোন চুক্তি করেন নাই।

কাশ্মিরের পুঞ্চ এলাকার নাগরিক মহারাজার দমন-পীড়নমূলক আচরণে বিদ্রোহ আরম্ভ করে ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে যোগ দেওয়ার দাবী উত্থাপন করে। মহারাজার সৈন্যরা অত্যাচার করতে থাকলে ২৪ অক্টোবর ১৯৪৭ পুঞ্চ অঞ্চল স্বাধীন ‘আজাদ কাশ্মির' হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ সময়ে পকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (NWFP) পাশতুনরা পুঞ্চের নাগরিকদের সাথে মিলে কাশ্মীর আক্রমন করে।

হরি সিং উপায়ন্ত না দেখে মাউন্টব্যাটেনের সাহায্য চায়। ১৯৪৭-পরবর্তী ভারতের "গভর্নর জেনারেল" মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব দেন, রাজা যদি ভারতের সাথে যোগদান করে, তবে তিনি রাজাকে সহায়তা করবেন। উপায় না দেখে কাশ্মিরের রাজা ভারতের অন্তর্ভুক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করার সাথে সাথে ভারতীয় সৈন্য কাশ্মিরে প্রবেশ করে। ভারত এ সময়ে ঘোষণা দেয়, এই অবস্থা সম্পূর্ণ সাময়িক, এবং সৈন্য ততোদিন থাকবে “until such time as the will of the people can be ascertained”। কাশ্মিরের মুক্তিকামী নেতা শেখ আব্দুল্লাহ এই ঘোষণা ‘”অন্তর্বর্তী” বলে মেনে নেন। পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে ‘একটি প্রতারণা’ বলে মত প্রকাশ করে। কারণ কাশ্মিরের মহারাজা পাকিস্তানের সাথে ‘স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যা তখনও বাতিল করা হয় নাই।

 

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ