
চাঁদমুখখানি কাতরের আবডালে ঝুলে ঝুলে চুপসে শুকিয়ে বিবর্ণমুখী। দেহে প্রাণ থাকলেও আত্মাটুকু নড়বড়ে নড়বড়ে অবস্থা। বিবাহের প্রথম রাত। বাসর রাত। বিসর্জনের রাত। তিলে তিলে সঞ্চিত করা দেহসজ্জা দেহস্থ পটভূমি উজাড় করে দেওয়ার রাত। কিন্তু প্যাঁচ লেগেছে অন্য সুতোর গিট্টুতে। যে গিট্টুর বাধঁন সহজেই ছেঁড়া যায় না। সহজেই নতুন করে রূপ-যৌবন দেওয়া যায় না।
পিরিয়ড নিয়ে বাসরঘরে বসে আছে দেহুড়ী। বাসরঘরে অস্বস্তির উপস্থিতিতে সবকিছু এলোমেলো অগোছালো এলোপাথাড়ির ছায়া সঙ্গী হয়ে ছুটোছুটি করছে। আর দোটানায় ডুবে ডুবে গলা শুকিয়ে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা? বাসর রাতে অচেনা একটা ছেলেকে কথাটা কিভাবে বলা যায়? সে-ই বা ভাববে? অথবা তার ইচ্ছার মূল্যায়ন করবে? যদি এ অবস্থায়ও পুরুষত্ব…।
উফফ! সবকিছু গোলমেলে গোলমাল গাঁথুনিতে গেঁথে গেঁথে কলিজায় ব্যথা লাগতে শুরু করেছে। কিছু ভাবতে গেলেই মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরপাক খাচ্ছে। শরীরটা ঝিনঝিন করছে। যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে টেনশনের মাত্রা ততই বাড়ছে। কি এক অপ্রত্যাশিত ঝামেলা? অপ্রত্যাশিত দোটানা।
পারিবারিক বিবাহবন্ধন। মধ্যবিত্ত এক ছোট পরিবারের বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। ছোটবেলা থেকেই খুব পরিপাটি পরিবেশে বড় হয়েছে। এত আদরের মাঝেও অনার্স ১ম বর্ষে বাবা-মার পিড়াপিড়িতে বিয়ের ঘাটে নৌকা বাঁধতেই হয়েছে।
বিয়ের এই বয়স পর্যন্ত প্রেমের অভিজ্ঞতা একেবারে নেই বললে অনেকখানি ভুল
হবে দেহুড়ীর। কলেজে থাকতে প্রেমে জড়িয়েছিলো একবার। তবে ছেলেটির ব্যাপক চাহিদার আগ্রহটা একেবারেই নিরাশ করেছিলো তাকে। এরপর আর এ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় হয়ে ওঠেনি। অবশ্য অনেক বন্ধু-বান্ধবীদের নষ্ট প্রেমলীলা দেখেছে সে।
যাইহোক, বাসর রাতের আগে স্বামী মানুষের কথা হয়নি কখনো দেহুড়ীর। সামনাসামনি বসে চোখে চোখ রেখে মৃদু মৃদু হাসির কাতরানির মূহুর্তও আসেনি। শুধু একবার ইচ্ছার বিপরীতেও ছবি দেখতে হয়েছিল। তবে সেটাও মায়ের জোড়াজুড়িতে।
স্বামী মানুষটার বাড়ির পরিচিত বলতে শ্বাশুড়িকে বিয়ের আগে কয়েকবার দেখেছিলো। সে সুবাদেই পরিচিত। সে সুবাদেই স্বামী মানুষটার নামটা জানা। খুব সুন্দর না হলেও অপছন্দও হয়নি। পরাণ, জহিরুল ইসলাম পরাণ। দেহুড়ীর স্বামীর নাম।
স্বামী মানুষটার উপর খুব রাগ দেহুড়ীর। কথা নেই বার্তা নেই সরাসরি বিয়ে করতে আসলো। একবার তো বলতেও পারতো চলুন দেখা করি কথা বলি। গাঁধা একটা। যদি দেখা হতো কথা হতো তাহলে তো এখন…।
হঠাৎ দরজায় খট শব্দ শুনে দেহুড়ীর দেহের ভেতরের পর্দাগুলো চমকে ওঠলো। হাতপা কাঁপতে শুরু করলো। এরকম অযাচিত অশোভন অসহ্যকর ঘটনার সূত্রপাতের সম্মুখীনে বসে থাকাটাও অতৃপ্তির। একটু নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলো সে। এটা যেন বলিদানের প্রস্তুতি।
দরজায় খট শব্দের বেশ কিছু সময় পার হলেও স্বামী মানুষটা ঘরে আসছে না। ব্যাপার কি তাহলে? শব্দটা কিসের হলো? তাহলে কি…? প্রশ্নের বেড়াজালে পেঁচিয়ে ঘোলাটে হতে শুরু করলো দেহুড়ী।
উফফ! অসহ্য অস্বস্তিকর। খুব রাগও হচ্ছে হ্যাংলাটার ওপর। ছবিতে তো হ্যাংলা, লম্বা, ফর্সাই দেখতে ছিলো। এমনকি কপালের ঠিক নিচ বরাবর লম্বা নাকের ওপর এক বিন্দু তিলক যা পুরো মুখটাকে সুন্দরে ভরে তুলেছে। এমন দেখতে ছেলে হলেও দেহুড়ীর কিছু যায় আসে না। ব্যাটাকে আজ থেকে জ্বালা বোঝাবে সে। কিন্তু পরক্ষনেই চুপসে গেলো সে। ইস্! বাসরঘর বলে কথা। কি যে ভাবছি?
ঘুমের কাছে হার মানার মতো। প্রায় ঘুমো ঘুমো অবস্থা। কিন্তু হঠাৎ করেই জোড়ে দরজাটা খুলে গেলে দেহুড়ী আতঙ্কে জেগে ওঠে। দেখে পরাণপাখি তাড়াহুড়া করে দরজাটা লাগিয়ে দিচ্ছে। দেহুড়ী ভাবতেছিলো তর যেনো সইছে না।
দেহুড়ী চুপচাপ বসে আছে। পরাণ সাহেব ধীরে ধীরে গিয়ে দেহুড়ীর পাশে বসেছে। আর দেহুড়ীর হৃদকম্পন দ্বিগুন হতে শুরু করছে। কলিজার ভিতর যেন ধুকপুক ধুকপুকানির মেশিন চলছে। কোনক্রমেই থামছে না।
হাতে থাকা জিনিসগুলো খাটের কোণায় রেখে পরাণ সাহেব খুব শান্তভাবে দেহুড়ীর অস্বস্তি মাখা হাতদুটো খুব আলতো করে ধরলো। দেহুড়ী কিছু না ভেবেই হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও কোন লাভ হলোনা।
হঠাৎই দেহুড়ীর অস্বস্তির চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে পরাণ সাহেব বললো, ‘আমি জানি আপনার খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো বলুন তো? সেই ছেলেবেলা থেকেই এই রাতটি নিয়ে কতকিছু ভেবে এসেছি কিন্তু আজ কোন কথাই খুজে পাচ্ছি না।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার পরাণ সাহেব বলতে লাগলো, ‘একটা কথা বলি আপনাকে, রাখবেন?’
দেহুড়ী মাথা নাড়ালো।
‘আপনাকে আজীবন খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো, আমার পাশে থাকবেন তো?
দেহুড়ী মাথা নাড়ালো।
তারপর কেন জানিনা পরাণ সাহেব দেহুড়ীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে ওঠে দাড়ালো। এবং খাটের কোণা থেকে একটি ন্যাপকিনের প্যাকেট বের করে বলল, ‘যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
দেহুড়ী রীতিমতো অবাক। বিস্ময় নিয়ে পরাণ সাহেবের দিকে আরচোখে তাকাল। আর একটু মুচকি হাসলো।
পরাণ সাহেব বললো, ‘প্রথম যখন দরজার শব্দ শুনেছিলেন তখন আমিই আসিতেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। দেখি আপনার ভাবির নাম্বার। তারপর আর কি? কথা হলো। আর এতো দেরি।’
৮টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাহ্! চমৎকার। এমন বুঝদার স্বামী পেলে সবাই ধন্য হতো। ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা রইলো
অন্বেষা চৌধুরী
সত্যিই দারুণ গল্প। এমন বর পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
ফয়জুল মহী
অনন্যসাধারণ লিখনী । শুভেচ্ছা সতত ।
ইসিয়াক
খুব সুন্দর।
সুরাইয়া পারভীন
চমৎকার লিখেছেন।
অপার ভালো লাগা রইলো
আরজু মুক্তা
এমন লোক পেলে তো কথাই নেই।
এস.জেড বাবু
হঠাৎ দরজায় খট শব্দ শুনে দেহুড়ীর দেহের ভেতরের পর্দাগুলো চমকে ওঠলো। হাতপা কাঁপতে শুরু করলো। এরকম অযাচিত অশোভন অসহ্যকর ঘটনার সূত্রপাতের সম্মুখীনে বসে থাকাটাও অতৃপ্তির। একটু নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলো সে। এটা যেন বলিদানের প্রস্তুতি।
নারী মনের অমূল্য সময়ের অভাবনীয় ভাবনাগুলো পুরুষ হয়ে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব।
আপনি তা সুন্দর ভাবেই করেছেন।
গল্পে ভিষন মুগ্ধতা
নৃ মাসুদ রানা
ধন্যবাদ প্রিয় কবিবর। মেলায় আসুন। ইনশাআল্লাহ দেখা হবে কথা হবে চস হবে আড্ডা হবে।