‘উপনিবেশবাদ’  অর্থাৎ ‘দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার 

 

উপনিবেশের  ইতিহাসে  দুটো ঢেউ 

স্পেন এবং পর্তুগাল প্রথম দেশ যারা আটলান্টিক মহাসাগর পারি দিয়ে উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে

রেকর্ড ইতিহাসে দুটো বিরাট উপনিবেশের ঢেউ হয়েছে। প্রথম ঢেউটি  ১৫ শত শতাব্দীতে ইউরোপে  যখন ‘এইজ অব ডিসকভারি’ হয় সে  সময় । দ্বিতীয় ঢেউ টি হল ১৯ শতকে আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশ করার মাধ্যমে। যাকে বলা হয় 'scramble For Africa' . যার স্থায়িত্য কাল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ হওয়া পর পর্যন্ত ।পশ্চিম ইউরোপের দেশ যেমন  ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান এবং  ডাচ এই আফ্রিকা মহাদেশ টিতে উপনিবেশ স্থাপন করে। 

‘এইজ অব ডিসকভারি’  বা ‘নুতুন দেশ আবিষ্কারের সময়” 

‘দেশ আবিষ্কারের সময়’ , এই সময়টিতে ইউরোপের কিছু দেশ যেমন ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স,ডাচ  এবং পর্তুগাল  সমুদ্র পাড়ি  দিয়ে উপনিবেশ করতে বের হয়। ভাস্কদামা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারত যাওয়ার পথে আফ্রিকা পৌঁছে এবং কলম্বাস এশিয়া যেতে ছেয়েছিল কিন্তু পথ ভুলে যায় এবং খুঁজে পায় আমেরিকা। 

সর্ব প্রথমে স্পেন ১৪৯২ সালে সমস্ত দক্ষিণ আমেরিকা,ক্যারাবিয়ান এবং আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমে কলোনি স্থাপন করে। আমেরিকার কিউবা, পুয়ের্তো রিকো এবং ফিলিপাইনে উপনিবেশ গড়ে তুলে। 

প্রথম ঢেউটির কলোনি- কারিদের উদ্দেশ্য ছিল ‘গোল্ড, গড এবং গ্লোরি’ এই তিনটি অর্জন করা। অর্থাৎ সম্পদ, খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তার এই ছিল তাদের কলোনি করার উদ্দেশ্য। নিজেদের আর্থিক অবস্থা ভাল করার জন্য তারা অন্য দেশ দখল করতো। 

‘জোর যার মুলুক তার’ 

 ইওরপীয়ান দেশ গুলো প্রতিযোগিতায় নেমে ছিল কে কতগুলো যায়গা নিজেদের মধ্যে দখলে আনতে পারবে। 

পশ্চিম ইওরোপের দেশ গুলো যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল,ডাচ  এবং স্পেন আফ্রিকা মহাদেশ টিকে কেক কাটার মতো টুকরো টুকরো করে কেটে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নায়। এবং তারা দাবী করতে থাকে এই মহাদেশটি তাদের। অথচ সব যায়গাতেই আগে থেকেই মানুষ ছিল,  ছিল তাদের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার ,এবং ভাষা। অথচ পশ্চিমা দেশ গুলো সেগুলোর তোয়াক্কা না করে ‘জোর যার  মুলুক তার’ এই থিওরি চালায়। 

বড়ো বড়ো ধনী দেশ গুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছিল কে কোন  ভাগ নিবে

  

আগে অনেক দেশেই কাছা কাছি দেশ অধিকার করতো । যেমন ইতালি, তুরস্ক এবং মিসর । রোমান সাম্র্যাজ্য,বাইজেনটাইন ,ইসলামী খালিপাত ,   অটোমান স্যাম্র্যাজ্য বা রাশান সাম্র্যাজ্য ।   কিন্তু স্পেনই প্রথম দেশ যে  কিনা এক মহাদেশ থেকে যেয়ে  অন্য মহাদেশ অধিকার করে দখল করে এবং  কলোনি গড়ে তুলে। 

১৮৯৮ সালের ডিসেম্বরে স্পেন কিউবা এবং puert Rico,  ফিলিপাইন ,  Guam এবং অন্যান্য আইল্যান্ড কে কলোনি করে। স্পেনকে  সিলভার এবং অন্যান্য রিসোর্স পেয়ে ধনী হতে দেখে ব্রিটেন ভাবতে থাকে কি ভাবে সেই সব সম্পদ  নিজেদের আয়ত্তে আনা যায়। ১৫৮৫-১৬০৪ সালে  স্পেনীয় এবং ব্রিটিস  মধ্যে কনফ্লিকট আরম্ভ হয়। এবং স্পেন আগে আসলেও ক্রমাগত ভাবে নানা ধরনের চুক্তি দ্বারা তাদের করা কলোনি গুলো ব্রিটেনের হাতে চলে আসে।১৭০৭ সালে কিংডম অব ইংল্যান্ড এবং কিংডম অব স্কটল্যান্ড একসঙ্গে কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন গঠন করে এবং পরে  ব্রিটিশ ইম্পপরার হিসেবে বিস্তার লাভ হয়। ২০২০ সালের সার্ভেতে দেখা যায় আমেরিকায় ২৫.২১ মিলিওন আমেরিকান ব্রিটেন থেকে যাওয়া। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশ জারমান,ফ্রান্স,নেদারল্যান্ড,নরওয়ে এবং  সুইডেন ক্রমান্বয়ে উত্তর আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ গোড়ে তোলে। 

 উপনিবেশ বা কলোনি অর্থাৎ অন্য দেশকে কুক্ষিগত করা আর  ক্ষমতার অপব্যাবহারঃ 

প্রথম ছবিঃ আফ্রিকার মানুষ গুলোকে স্লেভ হিসাবে ব্যাবহার করতো এবং অত্যাচার চালাত পশ্চিমা বিশ্ব।  দ্বিতীয় ছবিঃ স্পেন্সিস দের  নিষ্ঠুর অত্যাচার আমেরিকার আদি বাসীদের উপর।

উপনিবেশ মানে ভায়োলেন্স করে এবং নিজের ক্ষমতা ব্যাবহার করে  অন্য দেশকে কুক্ষিগত করা এবং নিজের সুবিধা আদায় করা। 

‘কোনো এক দেশের অধিবাসীদের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া এবং তাদেরকে নিজেদের করতলগতো করা’। 

‘কলোনি করা মানে একটি দেশ যখন অন্য একটি দেশের মানুষকে পরাজিত করে,অত্যাচার করে তাদের দেশকে দখল করে  নায় এবং বলতে থাকে এখন এটি আমাদের আর সেখানে নিজেদের দেশের মানুষকে বসবাস করার জন্য প্রেরণ করে’ ।   

সেখানে আগে থেকেই মানুষ বসবাস করতো, নিজেদের বিভিন্ন রকমের ইথিনিক গ্রুপ ছিল, কালচার ছিল, ভাষা ছিল সেগুলো তোয়াক্কা না করে পুরো  আফ্রিকা মহাদেশটি ইওরোপিয়ান দেশ গুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নায়। 

আফ্রিকাকে ভাগাভাগি

 

এই ইউরোপিয়ান রা তাদের সেই প্রচলিত প্রোথা, কালচার, রাষ্ট্রীয় গঠন, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক রীতি নীতি কে তোয়াক্কা না করে সেগুলোকে নিচু চোখে দেখতে আরম্ভ করে। 

যা ছিল তাদের নিজস্ব ট্র্যাডিসনাল  লাইফস্টাইল কিন্তু এই সাদা চামড়ার  মানুষ গুলো ( White race) অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব এটাকে নিচু চোখে দেখতে আরম্ভ করে। 

সবার মধ্যে নিষ্ঠুর ছিল বেলজিয়ামের রাজা Leopold 2 , যাকে বলা হয় ‘The butcher of Kongo’ । যার অত্যাচারে ১০ মিলিওন কঙ্গো বাসীর মৃত্যু হয়। 

‘নুতুন দেশ’ তো  নয়ই , ‘আবিষ্কার করলাম’ তাও নয়ঃ

‘আবিষ্কার করলাম’ বা ‘নুতুন পৃথিবী’ এটা হলো ইওরোপিয়ান দের যুক্তি। এমন ভাবে তারা বলে যেন মনে হয় তারা যদি আবিষ্কার না করতো তা হলে আমেরিকা  ‘অনাবিষ্কৃত’  হয়ে থাকতো। কিন্তু এটাতো  সঠিক নয়। যে স্থান গুলো আগে থেকেই আছে  এবং মানুষের সভ্যতা আছে , নিজস্ব শাসনকর্তা আছে সেই দেশ কি ভাবে আবিষ্কারের দেশ হতে পারে? এই দেশ ইওরোপিয়ান দের মোটেও  আবিষ্কারের দেশ নয়।

এটা তাদের দখল করা অন্যজনপদের  দেশ। যেখানে তারা নিজেদের আধিপত্য  বিস্তার করে এবং ক্ষমতা ব্যাবহারের অপচেষ্টা চালায়। 

Amerigo Vespucci নামে একজন  ইটালিয়ান ন্যাভিগেটর USA র নাম দিয়েছিলো “New World” । আদতে এটা মোটেও ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’  নয়।  শত শত বছর ধরে সেখানে মানুষ বসবাস করে আসছে এবং তাদের নিজস্ব সভ্যতার পরিচয় আছে। 

ইওরোপিয়ান রা তাদের ইতিহাসে ‘কলম্বাস’ কে হিরো মনে করে এবং বলে থাকে তার মাধ্যমেই এই স্থান গুলো আবিষ্কার হয়েছে। যে  কিনা এশিয়া যাওয়ার জন্য রওনা দিয়ে পথ হারিয়ে এখানে অবতরণ করে এবং স্থানীয়দের নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা কোরে দখল কোরে ‘নুতুন পৃথিবী’   

এশিয়া যাওয়ার জন্য পথ ভ্রষ্ট হয়ে কলম্বাস সেখানে পৌঁছায় এবং সেখানে দমন পীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা বলে তাদের যে দেশটি  দখল করে সেটা ‘ক্যারাবিয়ান আইল্যান্ড’ ‘Taino’ নামে জনৈক স্থানীয় indigenous people এর সাথে তার পরিচয় হয়। বর্তমানে যেটা  ‘হাইতি' এবং ‘ডমিনিকান আইল্যান্ড’ বলে পরিচিত ।সেখানে বসবাস করতো উচ্চ শ্রেণীর কৃষ্টি কালচার সমন্বিত একটা জাতী। সেটা ধ্বংস হয়ে যায় ইওরপীয়ান দের দ্বারা । 

স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান দের সাথে ইউরোপিয়ান দের বোঝাপড়া

 

‘ মায়া’  এবং ‘ Aztec’  সভ্যতা যা এখানে আগে থেকেই ছিল 

স্পেন এবং মেক্সসিকান দের মধ্যে যুদ্ধ করে দেশ দখল

মেক্সিকো উত্তর আমেরিকার একটি দেশ। যা কিনা বিখ্যাত নিজস্ব কালচার,খাবার,মিউজিক এবং সভ্যতার জন্য। তাদের নিজস্ব দুটো ইন্ডিজেনিয়াস গ্রুপ ছিল যারা এই অঞ্চল শাসন করতো। কলম্বাস এখানে আসার আগেই তাদের নিজস্ব সভ্যতা ছিল। “ Hernan Cortes” নামক জনৈক স্পেনের অভিযানকারী ১৫২১ সালে এখানে কলোনি করে । শতাব্দী কাল পর্যন্ত স্পেন তাদের দখলে রাখে। ১৮২১ সালে মেক্সিকানরা স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে স্পেনের হাত থেকে স্বাধীন হয়। 

কিন্তু ততদিনে তাদের কালচার বিলীন হয়ে যায় এবং কোথায়  মেক্সিকান দের আদি জনসাধারন ? নিজেদের ভাষা বিলীন হয়ে গেছে । স্প্যানিশ ভাষা এখন তাদের অফিসিয়াল ভাষা। স্প্যানিশ রা নিজ দেশে ফিরে আসেনি। ইতিমধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রাধান্য পায়। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার মানুষ মারা যায় তাদের আনা অসুখ বিসুখে।স্পেনিশ দের হাতে মারা যায় হাজার হাজার তাদের অধিকৃত দক্ষিণ আমেরিকার সাধারণ লোকজন ।

কলোনি করা দেশ গুলো নিজেদের   ভাষা,কালচার এবং ধর্ম চাপিয়ে দেয়  তাদের দেশে গিয়ে এবং এই  হল আর একধরনের ক্ষমতা  প্রয়োগ এবং প্রতিপত্তি বৃদ্ধির নয়া কৌশল । 

 

নয়া উপনিবেশবাদের নয়া পায়তারা 

উপনিবেশ হয়তো চলে গেছে আফ্রিকা এবং ভারত বর্ষ থেকে  কিন্তু এখন  তাদের নুতুন  কৌশল দিয়ে সেই শক্তিশালী পশ্চিমা দেশ গুলো তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অপেক্ষা কৃত দরিদ্র দেশ গুলোতে । আর কোনো দেশ,  তাদের অর্থনৈতিক দিক  থেকে উপরে  উঠতে দেখলে  উপনিবেশকারী দেশ গুলো  পরিকল্পনা  করতে থাকে কি ভাবে সেই দেশকে  দুর্বল করা যায় এবং নিজেদের প্রতিপত্তি সমস্ত পৃথিবীতে বজায় রাখা যায়। 

বৈদেশিক ঋণ, সামরিক অস্ত্র বিক্রয়, বাণিজ্য, সাংস্ক্রিতির  আদান প্রদান,বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন,নিষেধাজ্ঞা আরোপ  ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোকে শোষণ করে চলেছে শক্তিশালী পশ্চিমা বিশ্ব ।   

 উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশ গুলোকে ঋণ দেয়ার সময় নানা রকম শর্ত জুড়ে দায় । আর ঋণ বহনকারী দেশ এইভাবে তাদের  দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

তাছাড়া যারা ঋণ নায় তাদের বিদেশ নীতি প্রনয়ন এবং বাস্তবায়নের সময় ঋণদানকারী দেশ প্রভাব খাটায়। অন্য দেশের  আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে  প্রবেশ করে ।  নানান ছুতায় যেমন হিউম্যান রাইটের অভাব, গণতন্ত্র নাই, জঙ্গি ধ্বংস, মাইনরিটি  গ্রুপকে উস্কানি এইসব কে ব্যাবহার করে সে দেশের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে পুতুল সরকার বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে এবং সেই পুতুল সরকারকে তারা পরিচালনা করে।  মিডিয়ার মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে। 

পশ্চিম ইওরোপের দেশ গুলোর ধনী হওয়ার প্রধান কারন ১) মডার্ন টেকনোলজির আবিষ্কার, ২) সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নূতন দেশ আবিষ্কার ৩) উপনিবেশ করা এবং ৪) শিল্প বিপ্লব। 

এখন সময় এসেছে জেগে উঠার। উপনিবেশ থাকা দেশ গুলোকে সজাগ হতে হবে।  নারীপুরুষ সকলকে শিক্ষিত হয়ে,  টেকনিক্যাল বিষয়ে এগিয়ে যেয়ে, অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির  কূটকৌশলের চাল  বুঝতে হবে। নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে । 

অথচ এর আগে ব্যাবসা বাণিজ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে এই সিল্ক রুটের আশেপাশের দেশ গুলোতেই  সমৃদ্ধি ছিল।

এখন সময় এসেছে তৃতীয় বিশ্বের সমস্ত মানুষকে উজ্জীবিত হওয়ার । 

What is colonialism?  A History of violence, control and exploitation ,Jamila Osman     

       Tragic History Of lost colony, Horn James

Why Colonialism was bad, Natham J Robinson

The epic and forgotten story of hispanic North America , Gibson Carric

Photo credit, wikipedia

প্রবন্ধঃ ইতিহাস ও ঐতিহ্য

হুসনুন নাহার নার্গিস, লেখক ও গবেষক , লন্ডন  

0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ