(সত্য ঘটনা অবলম্বনে), শেষ পর্ব:
দর্শকদের থেকে একজন লোকটিকে বলল- তোমাকে কে উদ্ধার করেছে তাকে জানো তো? সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল- জানি। ঐ লোকটি আবার বলল- তাহলে দেখাও তো এখান থেকে কে সেই উদ্ধারকারী। আমার গায়ে তখন বাদামী রঙের একটা হাতা গেঞ্জি এবং পরনে রিলিফের লুঙ্গি। মাথার চুল এলো মেলো ভাবে কপালের চার পাশে ছড়িয়ে আছে। গোসলের পর হাতের কাছে চিরনি পাইনি। লোকটি চোখ মিট মিট করে একে একে সবার দিকে তাকালো। কিন্তু উদ্ধারকারীকে চিনতে পারলো না।
 
ঐ প্রথম লোকটি এবার আমার কাধে হাত দিয়ে বলল- এ-ই তোমাকে জীবনের বিনিময়ে ভয়ংকর সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছে। সে আমার দিকে কিছুক্ষণ থাকিয়ে থেকে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। আমি কিছু বুঝতে না পেরে অপ্রস্তুত ভাবে এদিক ওদিক থাকাতে লাগলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর সে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে আমাকে নানা রকম দোয়া করতে লাগলো। আমি বললাম- আপনার নাম কি? সে ক্ষীন কণ্ঠে বলল-মোহাম্মদ মুহসিন। বাড়ী কোথায়- পটিয়া। এখন কেমন বোধ করছেন? সে জবাব দিল খুব ভালো। একজন দর্শক আমাকে জানালো ডাক্তার বলেছেন আর দু’এক মিনিট হলেই মারা যেতো। তারপর ঐ দর্শক আবার বলল-আপনি না হলে ও নির্ঘাত মারা যেতো। তার কথার সমর্থন জানালো আরো কয়েক জনে। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম- আপনাদের এ ধারণা ঠিক নয়। বাঁচা মরার ফয়সালা তো হয় আল্লাহর দরবারে। কোন মানুষ অন্য মানুষকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেনা। তারা বলল- তাতো বটেই, তবে আপনি হচ্ছেন উছিলা।
 
এরপর আমি মুক্ত হাওয়া খাওয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজের তৃতীয় তলায় উঠলাম। এখানে এক পাশে যাত্রীদের বসার গ্যালারী মধ্যখানে খালী এবং অপর পাশে জাহাজের কট্রোলরুম। পড়ন্ত বিকেলের দখিণা বাতাস কিছুক্ষণের মধ্যেই হাড়-কাঁপিয়ে দেয়। আমার কপালের এলোমেলো চুল বাতাসের সাথে উড়ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুক ভরে একটু শ্বাস নেব সে ফুরসত আমার কোথায়। আমাকে দেখেই লোকেরা কানাকানি আরম্ভ করে দিলো। কেউ বলে- এই সেই যুবক যে অন্যের জন্যে নিজের জান বিপন্ন করে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কেউ বলে দারুণ সাহস। কেউ বলে বাপের বেটা!
দু’এক জন আমার সাথে সাহস করে কথা বলেছে তো চারিদিকে জড়ো হয়ে লোকেরা আমাকে ঘিরে ধরছে। আমি কিন্তু নার্ভাস বোধ করছিলাম। লজ্জায় আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো কোন গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। শেষ পর্যন্ত আর বের হবো না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কেবিনে ফিরে আসলাম। সেখানেও দেখি একই অবস্থা, একই বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো। আমাকে পেয়ে আলাপের মধ্যমণি করে আসন খালি করে দিলো।
 
উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই বাবুল আমাকে বললেন- আপনি কুতুবদিয়ায় আমাদের বাড়িতে চলুন। ঝড়ে আমাদের বাড়ির তেমন ক্ষতি হয়নি। আশ্রিত অনেক লোক আছে, তবে আপনি আসলে দ্বিতলার একটি রুম খালী করে দেয়া যাবে। আমি উনাকে বললাম-ভাই, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা যাচ্ছি একটা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা এতদুর সিদ্ধান্ত বা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি যে, প্রয়োজনে প্রত্যেকে বস্তা কাধে নিয়ে ছয়-সাত মাইল ভিতরে নিয়ে যাবো যেখানে আজ পর্যন্ত কোন সাহায্য পৌছেনি।
বাবুলকে আমি আরো বললাম- এক্ষণে আমি যদি আপনার সাথে চলে যাই, তাহলে আনন্দঘন সেই স্বর্গীয় মূহুর্ত থেকে আমি বঞ্চিত থেকে যাবো। আমার আগ্রহ দেখে তিনি আর জোর করলেন না।
 
অনেক্ষণ থেকে একটা বিষয় আমার মাথায় আসছিলো না। সেই লোকটিকে পানিতে ফেলার পর থেকে যে ফেলেছে তাকে খুঁজছে সবাই। লোকটিকে একজনে তো আর ফেলতে পারেনি? তবে নিশ্চয় একজনের নেতৃত্বে কয়েকজনে মিলে ফেলেছে। ঐ নেপত্য নায়কটাকে উদ্দেশ্য করেই সবাই কথার ঝাল মিটাচ্ছে। অনেকে মন্তব্য করেছে তাকেই সাগরে ফেলে দেয়া উচিত। কেউ কেউ বলছে- তাকে দশ বার ফাঁসি দেয়া উচিত।
কেউ বলছে তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হোক। কিন্তু লোকটি সেই যে গা ঢাকা দিয়েছে আর কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ আর তেমন আগ্রহও দেখায় নি। তবে একজনে মন্তব্য করেছিল লোকটির গায়ে লাল গেঞ্জি আছে। এখানেই আমার খট্কা। আমি উপরে নিচে কোন লাল গেঞ্জি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য আমি খুঁজেছি তাও নয়। গত প্রায় দুই ঘন্টা ধরে আমার সাথে তিন জন লোক ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। তার মধ্যে একজন হচ্ছে বাবুল। অপর দুই জন পরে এসেছে।
 
এরমধ্যে একজন আমার বাড়ী সাতকানিয়া শুনে, সাতকানিয়া সরকারী কলেজ, ভোয়ালিয়া পাড়া, জাফর সাদেক ভাই অনেক কিছু নির্ভূল পরিচয় দিলো। লোকটি আরো জানালো সে সাতকানিয়া কলেজের ছাত্র। গত প্রায় দুই তিন বৎসর আগে চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েছে, এখন কোথাও মাস্টারি না কি করে।
ফর্সা রঙের হালকা-পাতলা গঠনের লোকটির পরনে লুঙ্গি। গায়ে লাল হাফ হাতা গেঞ্জি, মাথার চুল ছোট করে ছাটা, ক্লিন সেভড, চোখ দু’টো সামান্য ট্যারা। কথা বার্তায় আমার সাথে ভালই ভাব জমিয়ে ফেলেছে। সেই যে প্রথমে আমার সামনে বসেছিলো দিনের আলো থাকতে আর উঠেনি। এরই মধ্যে একজন এসে আমাকে ইশারা করে গেছে ; মনে হয় আপনার সামনের এই ব্যক্তিই লোকটিকে সাগরে ফেলে দিয়েছিলো। হঠাৎ আমার মনে হলো লোকটির গায়ে তো লাল গেঞ্জি। তাহলে কি.............।
 
হ্যাঁ, লোকটির সাথে এতক্ষণ কথা বলে আমার যে ধারণা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে এরকম একটা কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব। আর যদি তা হয়ে থাকে তাহলে যে ওর তারিফ করতেই হয়। কারণ একেবারে আমার সাথে বন্ধুত্ব। তার মানে সে ধরেই নিয়েছে বাঁচার এটাই পথ। আমার চিন্তাশ্রোত এক জায়গায় এসে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছে। খেই হারিয়ে ফেলছে এইজন্য যে আমরা এত কষ্ট, এত ত্যাগ স্বীকার করে যে দূস্থ-দূর্গত-মূমূর্ষ লোকদের জন্য কিছু সাহায্য নেবার চেষ্টা করছিলাম। যার উপর দিয়ে বয়ে গেছে অগ্নিবৃষ্টি বা এসিড বৃষ্টির সাথে জলোচ্ছ্বাস এবং সোয়া দুই’শ কিলো বেগে ঘূর্ণিঝড়। লোকটির বাড়ি হচ্ছে সেই কুতুবদিয়ায়। আমি ধীরে ধীরে যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবনার অতল গহবরে......।(সমাপ্তি)
0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ