পৃথিবীতে খুব কম মানুষকেই পাওয়া যায় যারা ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, লাভ-ক্ষতি ও ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে এসে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে পরের উপকারে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আজ থেকে ১২৩ বছর আগে এই উপমহাদেশে জন্মেছিলেন এক মহান মানুষ ও সমাজ-সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি নিজের সবকিছুই মানুষের কল্যাণের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন, পুরোনো জরাজীর্ণ সমাজকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তোলার আত্মপ্রত্যয়ে নিজের সকল ব্যক্তিগত সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন।

পুরুষশাসিত সমাজে প্রতিপদে, প্রতিনিয়ত নিগৃহীত নারীদের জীবন বদলাতে চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। আর দশটা মানুষের মতো নারীদেরও যে বাঁচার অধিকার আছে, তারাও যে মানুষ- সেটা সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে নিরলস কাজ করে গেছেন এই মহান মানুষটি।

এ যুগেও আমরা বিবেকবান মানুষেরা নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে শিহরিত হই, আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। আর বিদ্যাসাগরের যুগটা তো নারীদের জন্যে ছিল আরো বিভীষিকাময়। নারীদের মানুষ হিসেবে কোনো মূল্যই ছিলনা তৎকালীন সমাজে; না তারা শিক্ষার অধিকার পেতো না পেতো নিজের জীবনের কোনো বিষয়ে মতামত জানাতে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ছিল সমাজিক রীতি। অকালে বৈধব্য বরণ করে সারাজীবন দুঃসহ কষ্টে কাটাতে হতো বিধবাদের, তার ওপর তাদের ওপর চাপানো হতো ধর্মীয় অনুশাসনের নামে দুঃশাসনের নির্মম বোঝা।

বাল্যকালের খুব প্রিয় বান্ধবীকে বিয়ের ক’মাসের মাথায় বিধবা হতে দেখে ও একাদশীর নামে সারাদিন তাকে অভুক্ত থাকতে দেখা চৌদ্দ বছরের বালক বিদ্যাসাগরের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন এটা কোনো জীবন হতে পারেনা, নারীদের বাঁচতে হবে মানুষের মতো করে। তাই সমাজের শত বাধা উপেক্ষা করে একসময় বিধবাবিবাহ আইন পাশ করান। পাশ করিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেটার বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েও দেখিয়েছেন তিনি। বিদ্যাসাগরের নিজের ছেলে নারায়ণচন্দ্রও বাবার সম্মতিতে একজন বিধবা নারীকে বিয়ে করেছিলেন।

আজো আমাদের সমাজে বিধবাবিবাহ নিয়ে অনেক রক্ষণশীলতা দেখা যায়। এখনো খুব কম পুরুষই বিধবা মেয়েদের বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। অথচ সেই যুগে বিদ্যাসাগর এতোটা মানবিক ও আধুনিক চিন্তা করতে পেরেছিলেন যা আজকের যুগে এসেও তথাকথিত আধুনিক ও প্রগতীশীলরা ভাবতে পারেননা।

শুধু বিধবা বিবাহই না, তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধেও বিদ্যাসাগর লড়ে গেছেন। ছাত্রজীবনে বিদ্যাসাগরের অথর্ব বুড়ো অধ্যাপক শম্ভুনাথ তর্কবাচস্পতি বিয়ে করতে চাইলেন। তখনকার দিনে পুরুষেরা ইচ্ছেমতো বিয়ে করতে পারতো, একে বলা হতো কৌলীন্য প্রথা। সুপাত্রীর সন্ধান পাবার পর বাচস্পতি তার প্রিয় ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্রের মত চাইলে ঈশ্বরের মন তার গুরুর প্রতি প্রবল ঘৃণা ও বিদ্বেষে ভরে উঠলো। সে বলল- ‘আপনার তো বেশিদিন আর বাঁচবার সম্ভাবনা নেই, একটি মেয়েকে পথে বসাবেন কেন? বিয়ে তো দূরের কথা, বিয়ের চিন্তাতেও আপনার পাপ হবে।’

কিন্তু তবুও বাচস্পতি বিয়েটা করে এবং বিয়ের ক’দিনের মাথায় মেয়েটি বিধবা হয়। সমাজের এসব নৃশংস- অমানবিক রীতিনীতি দেখলে বিদ্যাসাগরের মন বিষিয়ে উঠতো। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, পঞ্চান্ন বছরের বুড়ো বিয়ে করেছে আশিটি, আঠারো বছরের ছেলে বিয়ে করেছে একুশটি, ৩৫ বছরের লোক বিয়ে করেছে চল্লিশটি। এসব অনাচার বন্ধের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু তার এই সৎ উদ্দেশ্য সফল না হলেও কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে লড়াকু এই সৈনিককে ইতিহাস ভুলে যাবে না।

নারীদের শিক্ষার অধিকারের জন্যেও প্রাণপণ লড়েছেন এই মহান মানুষটি। সমাজের অর্ধাংশকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে একটা জাতি যে বেশিদূর এগোতে পারে না তা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ১৮৪৯ সালে গড়ে তুলেছিলেন এখনকার ‘বেথুন’ স্কুলটি। মেয়েদের স্কুল চালাতে গিয়ে কম গঞ্জনা আর বাধার সম্মুখীন হননি তিনি, কিন্তু বিদ্যাসাগর তার নীতিতে অটল রইলেন। ১৮৫৭ সালে মাত্র সাত মাসের মধ্যে একাই গড়ে তুললেন ৩৬ টি মেয়েদের স্কুল, যেখানে ছাত্রীসংখ্যা হয়েছিল দেড়হাজার।

গরীব-দুঃখী, দুস্থদের পাশে সবসময় নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতেন বিদ্যাসাগর। কদর করতে জানতেন জ্ঞানী-গুণীদের। মাইকেল মধুসূদনের দুরাবস্থায় সব সময় বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন বিদ্যাসাগর এবং প্রেরণা যুগিয়েছেন লেখালিখি চালিয়ে যাবার জন্যে। পরোপকার করতে গিয়ে নিজে ঋণের বেড়াজালে জর্জরিত হয়েছেন। শাদাসিধে জীবনযাপন করলেও বিদ্যাসাগরের দরজা থেকে কেউ সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফেরত যেতো না। তিনি ছিলেন দয়ার সাগর ও দানশীল মানুষ। দেশে দুর্ভিক্ষ হলে তিনি গ্রামে গিয়ে নিজ দায়িত্বে অন্নসত্র খুলে চার-পাঁচমাস খাইয়েছেন গ্রামের সকলকে, এমনই দরাজ দিলের মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর।

এই যুগে এসেই বা আমরা কি দেখছি? অনেকক্ষেত্রে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো নানাভাবে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অধিকার আগের চেয়ে বাড়লেও এখনো অসংখ্যা কন্যাশিশুরা ন্যায্য শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রাইমেরি ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশের আগেই ঝড়ে পড়ছে অনেকেই। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এখনো সমাজে বিদ্যমান।

চোখের সামনে এসব অনাচার দেখেও নিশ্চুপ বসে আছে শিক্ষিত সমাজ। কারণ এসব দেখার, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার দরকার মনে করিনা আমরা। ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তায় এতোটাই ডুবে আছি আমরা যে কোনো অন্যায়ই আমাদের গায়ে লাগে না। মানুষের জন্যে, মানবতার খাতিরে কিছু করার ইচ্ছা জাগে না আমাদের, যেমনটা জেগেছিলো বিদ্যাসাগর কিংবা রোকেয়ার মনে। এইসব মহান মানুষদের জীবনের সংগ্রাম, আত্মত্যাগের কাহিনী শুধু পড়ে গেলেই চলবে না, তাদের কাছ থেকে বড় মনের মানুষ হবার শিক্ষা নিয়ে বাস্তবে আত্মত্যাগ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, কাজ করতে হবে। সমাজটাকে এখনো অনেক বদলানোর বাকি। বিদ্যাসাগর চলে গেছেন, রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ। সেই আদর্শে উজ্জিবীত হয়ে আমাদেরই সমাজ বদলানোর কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

আজ এই মহান মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ