বিশ্বের সমগ্র মুসলিম উম্মাহের জন্য বছরে দুইটি দিন বিশেষ আনন্দের। এই মহিমান্বিত দুইটি দিনের একটি হচ্ছে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর আর অন্যটি হলো পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। চলতি বছরে ঈদ-উল-ফিতর বা রমজানের ঈদ গত হয়ে আমাদের দ্বারে খুশির বার্তা নিয়ে পৌছে গেছে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানীর ঈদ। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরে জামা কাপড়ের বাজারে গণজোয়ার সৃষ্টি হলেও পবিত্র ঈদ-উল-আযহার ঈদের জামা কাপড়ের বাজারে অনেকটা ভাটা পড়ে যায় তবে জোয়ার সৃষ্টি হয় কোরবানীর পশুর বাজারে। এসময় সমাজের বিত্তশালীরা সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কিনে কুরবানী দিয়ে থাকেন। ঠিক একই সময়ে সমাজের প্রগতিশীলরা পবিত্র কোরবানীর বিরোধীতা করে সাধু সাজার ধান্ধায় থাকেন। কারো কারো পশুপ্রীতি এতোটাই প্রকট হয়ে থাকে যে তারা চোখে গ্লিসারিন ছাড়াই পশু প্রেমে অন্ধ হয়ে চোখের জল ছড়াতে থাকেন। অথচ তাদের চোখের সামনেই অনাথ বিবসনা অন্নহীনরা ঘুরে বেড়ায় দেদার তাতে তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন না। তাই আক্ষেপের সুরে বলতেই হয় তারা ভন্ড, ভন্ডের দল !! যারা আমাকে চেনেন তারা নিশ্চয় জানেন আমি স্পষ্টবাদীতা পছন্দ করি। কাউকে খুশি করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিইনা। বরং যা সত্য তা মেনে নেয়ার চেষ্টা করি। এবং আমার জানার মধ্যে যা কিছু ভালো তা অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি। কুরবানীর পক্ষে বিপক্ষে নানান মতামত আছে। কেউ কেউ বলে থাকেন এটা নিষ্ঠুর নির্মম। অথচ তারাই মুরগী জবাই করে তার মাংশ আগুনে জ্বলসিয়ে গ্লিল করে নান রুটি দিয়ে চিবুতে থাকেন। আসুন এবার দেখি তাদের কথিত নিষ্ঠুর ও নির্মম পদ্ধতিকে বিজ্ঞান কি বলে।

Western World এ পশু জবাইয়ের প্রচলিত নিয়ম (CPB Method):

Captive Bolt Pistol (CPB ) নামের এক ধরনের যন্ত্র দ্বারা পশুর কপালে প্রচন্ড আঘাত করা হয়, ধারনা করা হয় এতে পশু Unconscious হয়ে পড়ে এবং জবাইয়ের পর ব্যথা অনুভব করে না।

গবেষণাঃ
জার্মানির Hanover University এর প্রফেসর Wilhelm Schulze এবং তার সহযোগী Dr. Hazim এর নেতৃত্বে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষনার বিষয়বস্তু ছিলঃ
১. Western World এ প্রচলিত নিয়মে (CPB Method)
২. ইসলামিক নিয়মে পশু জবাইয়ে পশুর যন্ত্রণা এবং চেতনাকে চিহ্নিত করা।

Experimental Setup:
Brain এর Surface কে Touch করে পশুর মাথার খুলির বিভিন্ন জায়গায় Surgically কিছু Electrode ঢুকিয়ে দেয়া হয়। পশুকে এরপর সুস্থ হওয়ার জন্য কিছু সময় দেয়া হয়। তারপর পশুগুলোকে জবাই করা হয়। কিছু পশুকে ইসলামিক নিয়মে আর কিছু পশুকে Western World এর নিয়মে। জবাই করার সময় Electroencephalograph (EEG) এবং Electrocardiogram (ECG) করে পশুগুলোর Brain এবং Heart এর Condition দেখা হয়।

Results:
ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাইয়ের ফলাফলঃ

১. জবাইয়ের প্রথম ৩ সেকেন্ড EEG graph এ কোন Change দেখা যায় না। তারমানে পশু কোন উল্লেখযোগ্য ব্যথা অনুভব করে না।
২. পরের ৩ সেকেন্ডের EEG Record এ দেখা যায়, পশু গভীর ঘুম এ নিমগ্ন থাকার মত অচেতন অবস্থায় থাকে। হঠাৎ প্রচুর পরিমানে রক্ত শরীর থেকে বের হয়ে যাবার কারনে Brain এর Vital Center গুলোতে রক্ত সরবরাহ হয়না ফলে এই অচেতন অবস্থার সৃষ্টি হয়।
৩. উপরে উল্লিখিত ৬ সেকেন্ড এর পর EEG Graph এ Zero Level দেখায় তারমানে পশু কোন ব্যথাই অনুভব করেনা।
৪. যদিও Brain থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না, তবুও Heart স্পন্দিত হচ্ছিল এবং তীব্র খিঁচুনি হচ্ছিল (Spinal Cord এর একটা Reflex Action)। এভাবে শরীর থেকে প্রচুর পরিমানে রক্ত বের হয়ে যাচ্ছিল এবং এর ফলে ভোক্তার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত মাংস নিশ্চিত হচ্ছিল।

Western World এ প্রচলিত পদ্ধতিতে (CPB Method) জবাইয়ের ফলাফলঃ

১. মাথায় প্রচন্ড আঘাত করার পরের মুহূর্তে পশুটিকে দৃশ্যত অচেতন মনে হচ্ছিল।
২. কিন্তু EEG এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছিল পশুটি খুব কষ্ট পাচ্ছে ।
৩. ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাই করা পশুর তুলনায় CBP দিয়ে আঘাত করা পশুটির Heart স্পন্দন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । যার ফলে পশুটির শরীর থেকে সব রক্ত বের হতে পারে নি । এবং ফলশ্রুতিতে, পশুটির মাংস ভোক্তার জন্য অস্বাস্থ্যকর হয়ে যাচ্ছিল ।

Western world এর পদ্ধতি (CPB Method) এবং MAD COW রোগঃ

Texas A & M University এবং Canada এর Food Inspection Agency একটা পদ্ধতি (Pneumatic Stunning) আবিষ্কার করেছে যেটাতে একটা Metal Bolt পশুর Brain এ Fire করা হয় এবং এর ফলে Brain এর টিস্যু পশুর সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে। Brain Tissue এবং Spinal Cord হল Mad Cow আক্রান্ত গরুর সবচেয়ে সংক্রামক অংশ। এছাড়াও Brain এবং Heart এ Electric Shock এর মাধ্যমে পশুকে অচেতন করেও কিছু কিছু জায়গায় পশু জবাই করা হয় যেটা মাংসের Quality এর উপর খুব খারাপ প্রভাব ফেলে ।

ভারতীয় পদ্ধতিঃ
ভারতে পশুর মাথা এক কোপে আলাদা করে ফেলা হয় । এতে করে ঐচ্ছিক পেশীগুলো হঠাৎ করে সঙ্কুচিত হয়ে পরে যা অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধ তরল বের করে দেয় এবং Heart হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শরীর থেকে রক্ত বের হতে পারে না, যা বের হওয়া স্বাস্থ্যকর মাংসের জন্য দরকার।

এছাড়া ইসলামে Spinal Cord না কেটে শ্বাসনালী, এবং Jugular Vein দুটো কাটার ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে । এর ফলে রক্ত দ্রুত শরীর থেকে বের হয়ে যেতে পারে । Spinal Cord কাটলে Cardiac Arrest এর সম্ভাবনা থাকে যার ফলে রক্ত শরীরে আটকে যাবে যা রোগ-জীবাণুর উৎস।

এখানে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর একটি হাদীস মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করছিঃ "আল্লাহ সবাইকে দয়া করার হুকুম দেন । তাই যখন জবাই কর তখন দয়া কর। জবাই করার পূর্বে ছুরিতে ধার দিয়ে নাও যাতে পশুর কষ্ট কম হয়"। তিনি পশুর সামনে ছুরিতে শান দিতে বা এক পশুর সামনে আরেক পশুকে জবাই করতেও নিষেধ করেছেন কিন্তু আমরা অনেকেই এই জিনিষটা কুরবানীর সময় ভুলে যাই।

সবশেষে , আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে পশু জবাই করার ইসলামিক পদ্ধতিটিই সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত এবং পশু এবং পশুর মালিক উভয়ের জন্যই উপকারী ?

বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর পরও যারা বলবেন নিষ্ঠুর তাদেরকে আর কিছু বলার নেই। তারা এখন ইচ্ছে মতো ক্যাঁও ম্যাঁও করতেই পারেন। আমি আমার কর্ণে তালা ঝুলিয়ে দিলাম। ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষ্যে আমাদের অনেকেরই বাড়ীতে পশু কুরবানী দেয়া হবে। এবার আসুন কুরবানীর কিছু প্রয়োজনীয় মাসায়েল জেনে নেই।

১. কুরবানী করার সময়ে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বা দোয়া পড়া জরুরী নয়।
২. নিজের কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করা ভালো। কোনো কারণে নিজে যবেহ করতে না পারলে- পশুর কাছে হাজির থাকা দরকার।
৩. গরু, মহিষ প্রভৃতি কুরবানীতে কয়েকজন শরীক হলে গোশত ভাগ অনুমান করে করা চলবে না। বরঞ্চ মাথা, কলিজা প্রভৃতি প্রত্যেক জিনিস সমান সমান সমান সাত ভাগ করতে হবে। তারপর যার যতো অংশ তাকে ততোটা দিতে হবে।
৪. কুরবানীর গোশত নিজেও খাবে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যেও বন্টন করা যায়। এক-তৃতীয়াংশ গরীব মিসকীনের মধ্যে বন্টন করে বাকী নিজের মধ্যে এবং আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বন্টন করা ভালো। কিন্তু এটা অপরিহার্য নয় যে, এক-তৃতীয়াংশ গরীবদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। তার কম গরীব দুঃখীদের মধ্যে বন্টন করলেও কোন দোষ নেই।
৫. কুরবানীর গোশত অমুসলিমদেরকে দেয়াও জায়েয। তবে মজুরী বাবদ দেয়া জায়েয নয়।
৬. কুরবানীর চামড়া অভাবগ্রস্তকে দেয়া যায় অথবা তা বিক্রি করে মূল্যও খয়রাত করা যায়। এ মূল্য তাদেরকে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়।
৭. কসাইকে গোশত বানাবার মুজুরী স্বরুপ গোশত, চামড়া, রশি প্রভৃতি দেয়া ঠিক হবে না। মজুরী পৃথক দিতে হবে।
৮. আপন মুরুব্বীদের পক্ষ থেকে যথা মৃত মা-বাপ, দাতা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ভালো।
৯. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব- না বিবির পক্ষ থেকে, আর না সন্তানের পক্ষ থেকে।
১০. উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ এসব পশু ছাড়া অন্য পশু কুরবানী জায়েয হবে না।

** পশু জবাইয়ের বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা ইন্টারনেট থেকে নেয়া
** মাসায়েলগুলোর তথ্য আসান ফেকাহ থেকে নেয়া।

এবার একটি মানবিক আবেদন জানিয়ে আমার আজকের লেখা শেষ করছি। শীত আসন্ন, কিছু দিনের মধ্যেই সারা দেশ শীতের চাদরে ঢেকে যাবে। আমরা প্রতিযোগীতা করে লক্ষাধিক টাকায় ঈদের পশু কেনার চেষ্টা করি। বিশেষ করে তাদের কাছে এবং সমাজের বিত্তবানদের কাছে আকুল আবেদন করছি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আপনার পাশে যে শীতার্থ মানুষটি রয়েছে দয়া করে তাকে একটা শীত বস্ত্র দিয়ে তাকে শীতের হাত থেকে বাঁচান। আপনি লক্ষ টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করে আল্লাহকে খুশি করতে চাইছেন কিন্তু আপনার পাশের মানুষটি যদি শীতের প্রকোপে কষ্টে থাকে তাহলে কি আল্লাহ খুশি হবেন আপনার উপর ? এই পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি, মানুষ তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আপনি যদি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখান তাহলে আল্লাহও নিশ্চয় আপনার প্রতি দয়া দেখাবেন। পরিশেষে সব্বাইকে জানাই ঈদ মোবারক। সুখ, শান্তি, সাম্য ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক সবার জীবন। ঈদের আনন্দ লেগে থাক সারা বছর জুড়ে, সবার ঘরে ঘরে।

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
৬ই নভেম্বর ২০১১ খৃষ্টাব্দ।

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ