কিছুদিন আগে কানাডিয়ান পরিচালক ডেনিস ভিয়েনুয়েভ পরিচালিত ইনসেন্ডিস সিনেমাটি দেখেছিলাম। ইনসেন্ডিস মুক্তি পেয়েছিল ২০১০ সালে। নিউইয়র্ক টাইমস এটিকে ঐ বছরের সেরা দশ ছবির লিষ্টে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০১০ সালের অস্কারে বিদেশী ভাষায় নির্মিত সেরা ছবির বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল ইনসেন্ডিস। অস্কার ভাগ্য সদয় না হলেও সিনেমাটি রটারডেম আন্তজাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইউপিসি অডিয়েন্স এ্যাওয়ার্ড জিতেছিল। এছাড়াও ৩১ তম গিনি এ্যাওয়ার্ডে জিতেছে ৮টি পুরস্কার। এবার সিনেমা সম্পর্কে একটু নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। সিনেমাটি দেখার অভিজ্ঞতা বেশ ভয়াবহ। জীবনে সিনেমা কম দেখিনি কিন্ত আর কোন সিনেমা এমন শকিং অনুভুতির জন্ম দিয়েছে কিনা বলে মনে করতে পারছি না। সিনেমা শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরও মাথার মধ্যে সিনেমাটির রেশ ছিল। সাম্প্রদায়ীকতা, ঘৃণা, যুদ্ধ মানুষের জীবনকে যে কত বিচিত্রভাবে বিধ্বস্ত করতে পারে তারই এক সার্থক উপাখ্যান সিনেমাটি।
vccb
ছবিটির মূল কাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের এক কাল্পনিক দেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও এটি মূলত লেবাননের গৃহযুদ্ধকে উপজীব্য করে নির্মিত। ষাটের দশক পর্যন্ত লেবাননে মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা শান্তিতে বসবাস করলেও ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার বিপুল সংখ্যক প্যালেষ্টাইনি শরণার্থী লেবাননে আশ্রয় নেয়। ফলে প্যালেষ্টানিয়ান লিবারেশন ফ্রন্টের ইজরায়েল বিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগারে পরিণত হয় লেবানন। তৈরী হয় মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ। সেই দ্বন্দ থেকে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর লেবাননে সংঘটিত হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধের এক পক্ষে ছিল ইজরায়েল ও পশ্চিমা সমর্থিত খ্রিষ্টান অধ্যুষিত সাউথ লেবানন আর্মি এবং অপর পক্ষে ছিল ইরান-সিরিয়া সমর্থিত হিজবুল্লাহ,প্যালেষ্টানিয়ান লিবারেশন ফ্রন্ট ও অন্যান্য সুন্নী মুসলিম গোষ্ঠী। দীর্ঘ ১৫ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে প্রাণ হারায় প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। ১৯৮৮ সালে সাওহা ফাওয়াজ বেচারা নামের লেবানিজ কমিউনিষ্ট পার্টির এক নারী কর্মী সাউথ লেবানিজ আর্মির নেতা আতোয়ান লাহাদের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালায়। বুকে গুলিবিদ্ধ লাহাদ প্রাণে বেঁচে গেলেও সাওহা কে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দশ বছর তাকে কুখ্যাত খিয়াম কারাগারে বন্দী রাখা হয়। গৃহযুদ্ধের অবসান হলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৯৮ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইনসেন্ডিস সিনেমার গল্পের একটা অংশ মূলত সাওহা ফাওয়াজ বেচারার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত।
ewe

লেবানিজ লেখক ওয়াজদি মাওয়াদের একই নামে রচিত একটি নাটক অবলম্বনে গড়ে উঠেছে সিনেমাটির প্লট। ছবির শুরুতে দেখা যায় সাইমন মারওয়ান ও জিন মারওয়ান নামের দুই জমজ ভাই বোন হার্ট এটাকে তাদের মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসে। সেখানে তারা তাদের মায়ের লেখা এক অদ্ভুত চিঠি হাতে পায়। সেই চিঠি পড়ে তারা জানতে পারে তাদের বাবা ও হারানো এক ভাইয়ের কথা। তার মায়ের শেষ ইচ্ছা তারা যেন তাদের জন্ম দাতা পিতা এবং সেই হারানো ভাইটিকে খুজে বের করে। এর জন্য তাদের ফিরে যেতে তাদের মায়ের অতীত জীবনে, ফিরে যেতে হবে তাদের মধ্যপ্রাচ্যের এক কাল্পনিক দেশে যেখান থেকে তাদের মা নাওয়াল মারওয়ান এক সময় অভিবাসী হিসেবে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিল। ছেলে সাইমন মায়ের শেষ ইচ্ছাটিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও মেয়ে জিন মরিয়া। যে করেই হোক সে তার মায়ের অতীতকে খুঁজে বের করবে। সেই অতীত খুঁজে বের করার মিশনে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয় জিন। তার মায়ের বংশ কিংবা পরিচিতদের কেউই তাদের মা নাওয়াল মারওয়ানকে নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। কি আছে তাদের মায়ের সেই হারানো অতীতে? হারানো সেই অতীতকে খোঁজার পাশাপাশি কাহিনী এরপর ফ্লাশব্যাকে চলে যায় মুসলিম আর খ্রিষ্টানদের সাম্প্রদায়ীক সংঘাতে বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের এক কাল্পনিক দেশে। নাওয়াল মারওয়ান মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের দাঙ্গায় বিধ্বস্ত একটি দেশের খ্রিষ্টান তরুনী। প্যালেষ্টানিয়ান এক মুসলিম যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোয় তার আপন ভাইদের হাতে খুন হয় তার সেই মুসলিম প্রেমিক। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি হয় সেও কিন্ত মাতামহের হস্তক্ষেপে সেখান থেকে প্রাণে বাঁচে সে। সেই মুসলিম প্রেমিকের ঔরসে সন্তান জন্ম দেয় নাওয়াল। তার অগোচরে সেই সন্তানটির ঠিকানা হয় একটি শিশু সদন। তারপর সময় গড়িয়ে যায়। এক সময় নাওয়াল জানতে পারে তার সেই সন্তানটির কথা। সেই সন্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার লক্ষ্যে সে যাত্রা করে এক শহরের দিকে। কিন্ত যাত্রা পথে সাম্প্রদায়ীক ঘৃণা ও যুদ্ধের ভয়াবহ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় সে। যুদ্ধের এই নির্মম ভয়াবহতা তার মধ্যেও জন্ম দেয় প্রতিশোধপরায়নতা। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে একসময় সে খুন করে বসে এক রাজনৈতিক নেতাকে। তারপর কি ঘটেছিল নাওয়াল মারওয়ানের ভাগ্যে? পাশাপাশি সাইমন ও জিন কি খুঁজে পাবে তাদের জন্মদাতা পিতা ও হারানো সেই ভাইটিকে? সিনেমার কাহিনী আর বেশি কিছু বলা যাবে না, শুধু এটুকু বলতে পারি যারা গ্রিক মাইথোলজি সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানেন তারা হয়তো গ্রিক মাইথোলজির এক বিখ্যাত উপাখ্যানের সঙ্গে গল্পের কিছু মিল খুঁজে পেতে পারেন।

ইনসেন্ডিস সিনেমাটির প্রাসঙ্গিকতা আমাদের আজকের সমাজে আজও বিদ্যমান। আমাদের আজকের সমাজে আমরা যখন প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়ীক হানাহানি, ঘৃণা ধবংসের চাষাবাদ দেখতে পাচ্ছি সেখানে এই সিনেমাটি নিঃসন্দেহে আপনার ভাবনা গুলোকে প্রসারিত করবে। যুদ্ধের ভয়াবহতাকে আবারো নুতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করে শান্তি পূর্ণ পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয়তাকে আপনার সামনে নুতুন করে তুলে ধরবে। সিনেমার শেষ টুইষ্ট আপনার হৃদয়কে বিক্ষত করবে এবং এর রেশ থাকবে বেশ কিছুক্ষণ। যাই হোক লেখাটার শেষ একটা ধাঁধা দিয়ে করি- ডাজ ওয়ান প্লাস ওয়ান মেইক ওয়ান?

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ