ইদের গল্প  : তবু খোঁজে চাঁদ 

মাহবুবুল আলম ১৯ মে ২০২০, মঙ্গলবার, ০৯:৩১:১৭অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

মাহবুবুল আলম।।

ঢাকার বুকে এমন নীল আকাশ এর আগে কোনোদিন দেখেছে কিনা এ মুহূর্তে মনে করতে পারছেনা মারজিয়া। পুরো আকাশ গাঢ়ো নীল সামিয়ানায় ঢেকে দেয়া হয়েছে যেন। কারওয়ান বাজার ও এর আশপাশের এলাকায় এখন লোডসেডিং চলছে । মারজিয়া আজ একটা এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছে কারওয়ানবাজার রেলবস্তিতে। লোডসেডিং এর কারণে পুরো এলাকাটি ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাদরে ঢাকা। সন্ধ্যা হয়েছে একটু আগে। কিন্তু ঢাকার সেই সন্ধ্যার পুরনো ব্যস্ততা নেই। স্বজনদের সাথে ঈদের খুশির অংশীদার হতে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে সিংহভাগ মানুষ। তাই ঢাকার রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। এই ঢাকাকে যেন মারজিয়া চিনতে পারছে না।

এখন পর্যন্ত চাঁদ দেখার কোন খবর পাওয়া যায়নি। চাঁদদেখা কমিটির মিটিং চলছে। কাল ঈদ হবে কি হবে না হয়তো আরো কিছু পরেই জানা যাবে। সে সময় পর্যন্ত সবার অধির অপেক্ষা। তবে এই বস্তিতে ঈদ নিয়ে তেমন কোন উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সবাই যার যা মতো ব্যস্ত রান্নাবান্নার কাজে।

এখন পর্যন্ত বস্তির অধিকাংশ ঝুঁপড়িতে কোনো আলো জ্বলছে না। মাঝে মাঝে দু’একটি ঝুঁপড়িতে কুপির বাতির টিমটিমে আলো, এখানটায় আলোর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কিন্তু তা নিতান্তই বিশাল অরণ্যে দু’একটি জোনাকী পোঁকার মতোই জ্বলছে। এ আলোহীনতার কারণেই হয়তো আকাশটাকে আরো বেশি নীল দেখাচ্ছে। এমন নীল আকাশ সে দেখিনি অনেক দিন।

মারজিয়া একটা প্রাইভেট রেডিও-তে কাজ করে। বস্তিবাসী ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ঈদের দিনটি কিভাবে কাটে এ নিয়ে একটি প্রোগ্রাম থ্রো করার জন্য তাকে এ্যাসাইনমেন্টে দেয়া হয়েছে। এর ওপর কাজ করতেই মারজিয়া এখন কারওয়ান বাজার রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে এসেছে। যাদেরকে নিয়ে মারজিয়া এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করবে তারা হলো বাসাবাড়িতে কর্মরত বস্তিবাসি কর্মজীবী মহিলা। তাদেরকে এ সময়টা ছাড়া দিনে অন্য কোন সময়ে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাকে রাতের বেলায় আসতে হয়েছে।

মারজিয়া এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে রেল লাইনেরই পাশে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা একটা ছাতিম গাছের নিচে। এখানে এসে দাঁড়াতেই একটা মৌ মৌ মিষ্টি গন্ধ এসে তার নাকে আছরে পড়ে। নিশ্চয়ই গাছে ফুল ফুটেছে। এটা নিশ্চিত এটা ছাতিম ফুলেরই গন্ধ।  অনতি দূরেই রেললাইনের পাশ ঘেসে ইটের চুলায় একটা কিশোরী মেয়ে কিছু একটা রান্না করছে। তাকে ঘিরে রান্না দেখছে চারটা  ছোট ছোট বাচ্চা। হয়তো মেয়েটিরই ভাই-বোন ওরা। মেয়েটা যে খুবই সুন্দরী আগুনের লাল আভায় তা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। সে যে প্লাস্টিক পুড়িয়ে রান্না করছে তা স্পষ্ট হলো মুহূতেই। প্লাস্টিক পোড়ার বিদঘুটে আগ্রাসী গন্ধ ছাতিম ফুলের মিস্টি গন্ধটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমনই উৎকট বিশ্রী দুগন্ধ যে মগজে গিয়ে বিধেছে।

অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছে সে, বিদ্যুৎ আসার নামগন্ধ নেই। তবে বিদ্যুৎ এলে তার খুব লাভ হবে না। কারণ মারজিয়া মনে মনে ভাবে মেয়েটা যেখানে রান্না করছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে কেমন হয়। মুহূর্তে সে এ ভাবনা বাতিল করে দেয়-

: না থাক। এই খোলামেলা জায়গাটাই ভাল। ওখানে যেয়ে লাভ নেই।

এমন ভাবনার মাঝেই অনতিদূরেই ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা প্রবল আলোর বান যেনো সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আলোর জন্য না যতটা খারাপ লাগছে তার চেয়ে বহুগুণ খারাপ লাগছে মশার কামড়।  এতক্ষণ মশার তেমন উপদ্রব না থাকলে মানুষের গন্ধ পেয়ে যেনো এখানটায় ঝাঁকে ঝাঁকে মশা ‘হাউ মাউ কাউ মানুষের গন্ধ পাও’ বলে বলে এসে জড়ো হয়েছে। এ মুহূর্তে পারলে ওরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে এখানে দাঁড়িয়া থাকা সম্ভব নয়।

ভাবতে ভাবতেই ট্রেনটা চলে এসেছে। ট্রেনের ইঞ্জিনের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে ওঠেছে। আরো কাছে  আসতেই বোঝা যায় এটা একটা কন্টেইনার ট্রেন। হঠাৎই ট্রেনের বিকট চিৎকারে কানের মধ্যে কেমন যেনো তালা লেগে যায়। বিশাল লম্বা ট্রেন, দেখে মনে হচ্ছে চিটাগাং থেকে বুঝি এর সাথে সব কন্টেইনার জুড়ে দেয়া হয়েছে। ট্রেনটা চলে যেতেই কানের তালা ছুটে যায়।

মারজিয়া যেখানে কাজ করতে এসেছে, এখানে কোনো ঝুঁপরিতেই বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। তবে আশেপাশে আলো থাকলে আলোর কিছু দ্যুাতি হলেও এখনে ঠিকরে এসে পড়তো। এত খারাপ লাগত না অন্ধকারটাকে। এসব বস্তি এমনিতে নানা অপরাধের আখড়া। অস্ত্রের মজুদ, মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ এখানে ওপেন সিক্রেট।

মারজিয়ার ভাবনায় যতিচ্ছেদ পড়ার আগেই তিনচার জন ছোকড়া ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কেমন ভয় পেয়ে যায় সে। ছেলেগুলো কাছে আসতেই গাজা পোড়ার বিশ্রী গন্ধ এসে আছড়ে পড়ে নাকেমুখে। সে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকতেই ছেলেগুলো বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে এগিয়ে যায়। একজনকে বলতে শোনা যায়

: মনে হয় কোন ঠিকা নাগরের লাইগ্যা এমন আন্ধারের মধ্যে একলা একলা দাঁড়াইয়া আছে। আরেকজন বলে

: চল আমরা গিয়া একটু টেস্ট করে আসি। যদি রাজি হয়...। আরেকজন বাঁধা দিয়ে বলে

: চুপ হারামির বাচ্চারা, মাইয়া মানুষ দেখলেই মুখ দিয়া লালা পড়া শুরু হয়। লাগামু এক চড়। আগা সামনে আগা।

এরপর আর কোন কথা শোনা যায় না। ছেলেগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ভয়ে মারজিয়া গা ছম ছম করে ওঠে। সে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করছে না। এগিয়ে যায় ঝুপড়িটার পাশে; মেয়েটি যেখানে রান্না করছে।

মারজিয়া বাচ্চাগুলোর সাথে একটু সহজ হওয়ার জন্য আগবাড়িয়ে বলে-

হাই বাচ্চারা! কেমন আছে তোমরা! কিন্তু এ কথার প্রতিউত্তর দেয়ার আগ্রহবোধ করলো না কেউ।  তাকে দেখে মেয়েটি ও তার সঙ্গীয় বাচ্চাদের তেমন কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। তবু মার্জিয়া ঠিক করে এই এখানেই সে আরো কয়েকটি পরিবারের মানুষ জড়ো করে সে তার এসাইনমেন্টটা শেষ করবে। মারজিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের রান্নাবাটি। রান্না করা মেয়েটিকে দূর থেকে যতটা সুন্দরী মনে হয়েছিল তার চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী মেয়েটা। এ যেন গোবরে পদ্মফুল।

আগুন নিয়ে আসতে চাইলে মেয়েটি উনুনে একটা চপ্পলের ভাঙ্গা অংশ ঠেলে দেয়। সেন্ডেলপোড়ার উৎকট গন্ধটি সরাসরি মার্জিয়ার নাকের ভেতরে ঢুকতে সে কাঁশতে শুরু করে। কিছুতে কাঁশি থামাতে পারছে না সে। মার্জির এ বেহাল দশা দেখে মেয়েটি বলে-

: বুঝেছি। প্লাস্টিক পোড়ার গন্ধে আপনার এ অবস্থা। কিন্তু আমাদেরকে দেখছেন, এই  যে এতজন কেউ একটু কাঁশলো? কেউ কাঁশবো না। আমরা এইসব দিয়ে রাঁধতে রাঁধতে প্লাষ্টিকের গন্ধপ্রুফ হয়ে গেছি। প্রথম প্রথম লাগতো। এখন আর কোনো গন্ধ লাগে না। হিঃ হিঃ হিঃ!

মেয়েটির গুছিয়ে পরিষ্কার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা দেখে মারজিয়া ভাবে মেয়েটি নিশ্চয়ই লেখাপড়া করে। তাই মারজিয়া বলে-

: তোমার নাম কি বোন? কোন ক্লাসে পড় ? মেয়েটি মার্জিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলে-

: আমার নাম বিউটি। সিক্সে পড়ি।

মারজিয়া উচ্চকিতভাবে বলে-

: বিউটি খুব সুন্দর নাম। তোমার কথা শোনেই বুঝেছি তুমি নিশ্চয়ই লেখাপড়া করো। আমার অনুমান কেমন ঠিক হলো তাই না। বেশ ভাল। বেশ ভাল।

ভাতের ডেকচিতে ঢাকনা দিতে দিতে বিউটি বলে-

: আপা এমন সময় আপনি এখানে কি করতে আসছেন? এই জায়গাটাতো ভাল না। সব গুন্ডা বদমাইশ, হিরোইঞ্চি, ডাইখোরের জায়গা। একটু পরেই এখানে বাজে মাইয়া মানুষের সাথে এরা... ছিঃ আমি আর বলতে পারবোনা আপা। একটা পুরনো ইট এগিয়ে দিয়ে বিউটি বলে-

: নেন বসেন বসেন আপা।

মারিজিয়া ভাঙ্গা ইটের ওপর বসতে বসতে বলে-

: তুমি এত সুন্দর। তোমাকে ডিসটার্ব করে না বাজে লোকগুলো?

: আমাকে কিছু বলতে সাহস পাবে ওরা ওদের যে দাদার দাদা, সে মামুন মামা বলে দিয়েছে- এই হমুদ্দির পোলারা শোন, বিউটি হইল আমার ভাগনী বোঝলি; কেউ যদি ও দিকে খারাপ চোখে তাকাস তা হলে চোখ উপড়ে নেব। এখন বোঝেন ঠেলা। তবে...বলেই থেমে যায় বিউটি।

মারজিয়া জিজ্ঞেস করে-

: তবে কী? বল তবে কী?

: কিছুই না। আর আপনার এত কথা শুনেওতো লাভ নেই।

: তুমি ঠিকই বলেছো। এতে তোমার হয়তো কোন লাভ হবে না। কিন্তু জানলে যদি তোমাকে কোন উপদেশ দিতে পারতাম।

মারজিয়ার এ কথা শুনে, বিউটি কিছুটা নরম হয়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে-

: আামার বাবা নেই। দুইবছর আগে এখানেই টেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। আমার এই ছোট ভাই পিচকু ট্রেন লাইনের মাঝে পলিথিনের ব্যাগের বাতাস ভরে ওড়াচ্ছিল। হঠাৎ করে একটা ট্রেন এসে পড়ে। বাবা দৌড়ে গিয়ে পিচকুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে পিচকুকে বাঁচাতে পারলেও; বাবা নিজেকে আর বাঁচাতে পারেনি। ট্রেনে কাটা পড়ে সাথে সাথেই মারা যায়।

: কি করতেন তোমার বাবা? মারজিয়া জিজ্ঞেস করে।

: বাবা বাঙ্গারী কুঁড়িয়ে সংসার চালালেও বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আমি তখন ফোরে পড়ি। বাবার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করে বড় হয়ে চাকুরী বাকরী করে তাদের জীবনে সুখের দিন ফিরিয়ে আনবো। বাবার সেই স্বপ্নও আর পূরণ হয়নি। এরপর মা ঠিকা ঝিয়ের কাজ নেয় মামুন মামাদের বাসায়। মা সেই ভোরে যায় ফিরতে ফিরতে কখনো নয়টা কখনো দশটা বেজে যায়। ওরা খুব বড় লোক। কিন্তু মামুন মামা বড় মস্তান। কিন্তু মাঝে মাঝে মামুন মামা মা-কে এগিয়ে দিতে এসে আমাদের ঘরে মায়ের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়। নেশাও করে...।

এটুকু বলেই ভাতের মাড় ফেলার জন্য উনুন থেকে ডেকচি ওঠায় বিউটি। আর কিছু বলে না।

মারজিয়া মেয়েটির সাথে আলাপ জমিয়ে তোলার জন্য বলে-

: কি থামলে কেন, বলো।

: না এসব কথা বলতে পারবো না।

: ঠিক আছে তোমার আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই। মারজিয়া তার কৌশল পল্টায়। বেশি চাপাচাপি করলে হয়তো সে আর কিছুই বলবেনা।

বিউটিই শেষে নিজ থেকেই বলা শুরু করে-

: একদিন রাতে ফিসফিস আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মা বেড়ার দরজা খুলতে খুলতে ফিস ফিস করে বলছে-

: মামুন ভাই। বিউটি এখনও মনে হয় ঘুমায় নাই। আপনি আরও একটু পরে আসেন। কিন্তু মামুন মামা মায়ের বারণ না মেনেই হুড়মুড় করে ছাপড়ায় ঢুকে মা’কে আমাদের মাটির বিছনায় শুইয়ে দেয়...বলেই বিউটি চোখ মুছতে মুছতে বলে-

: এর পর মায়ের সাথে দুইদিন আমি কথা বলতে পারিনি, তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে উল্টো শাসায়। যদি এ কথা কাউকে বলেছিসতো-তোর জিভ ছিড়ে ফেলবো।  যাদের দয়ায় দুটো খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি, তাদের অনেক কথা  রাখতে হয়। না হলে এ বস্তিতে থাকতে দিব না, বাসার কাজ থেকে বের করে দিয়ে উল্টো গুন্ডা লেলিয়ে দেবে। নিজের ইজ্জত ও রক্ষা করতে পারবি না। তরে বাঁচানোর জন্যই আমাকে মামুন ভাইয়ের অন্যায় আব্দার রাখতে হয়। তাকে একদিন কসম দিয়ে বলেছি-মামুন ভাই আপনি যা বলবেন আমি আপনার সব কথাই শুনবো, কিন্তু আমার মেয়ে বিউটিকে শকুনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এর পরই মামুন মামা এলাকার খারাপ পোলাইনদের বলে দিয়েছে তোর দিকে যেন কেউ খারাপ নজরে তাকায়।

তবে একবার ভেবেছিলাম এখান থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু কোথায় যাব। বাইরে যে আরও হাজার শকুন। তাই এ বস্তি ছেড়ে আর আমার কোথাও যাওয়া হয়নি। সব কিছু চোখ বন্ধ করে সহ্য করে যাচ্ছি। তবে মামুন মামা এখন আর গভীর রাতে আসে না। দশটার দিকেই চলে আসে। আমি তখন এক আন্টির ঘরে গিয়ে গল্প করি। তার স্বামী কারওয়ান বাজারের পাইকারী সব্জি বাজারে মাল খালাসের কাজ করে। রাতে বাসায় থাকে না। মাঝে মাঝে ওই আন্টির সাথেই ঘুমিয়ে পড়ি।

বিউটির এসব কথা শুনে মারজিয়ার মনটা ক্রমেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এই কিশোরী মেয়েটিকে বোঝানোর মতো কোন কথা সে খুঁজে পায় না। তবু মারজিয়ার সাথে বিউটির কথা যেন শেষ হতে চায় না। মারজিয়া যেন ও মেয়েটির কত জনমের সখী। সব কথা গরগর করে বলে দিয়েই আবার বলেছে-

: জানেন আন্টি এ কথা আজ পর্যন্ত আমি কারও কাছে বলিনি। আপনার কাছে কথাগুলো বলতে পেরে যেন মনের ভেতরের পাথর চাপাটা সরে গেল। তবে এ কথা আমি মানুষকে না না বললে কি হবে, বস্তির সব মানুষই মা আর মামুন মামাকে নিয়ে ফিস্ফাস্ করে। কিন্তু ওই লোকটির ভয়ে মুখ খুলে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না। এখন বাদ দেন এসব কথা। কি কাজে আসছেন সে কথা বলেন। বিউটি মারজিয়াকে বলে।

মার্জিয়া বসতে বসতে বলে-

: রেডিওতে তোমাদের একটি সাক্ষাতকার নেব। কালতো ঈদ। তাই আজ এসেছি তোমাদের ঈদ ভাবনা নিয়ে একটি সাক্ষাতকারমূলক প্রোগ্রাম রেকর্ড করতে। এটা ঈদেও দিন রাত নয়টায় প্রচারিত হবে।

আমাদের আবার ঈদ ভাবনা। আমাদের ঈদ ভাবনার সাক্ষাকার নিয়ে কি লাভ। এর আগেও একটি টেলিভিশন সাক্ষাতকার নিয়েছিল। প্রচার হয়েছে কি না জানিনা। আর প্রচার হয়ে থাকলেও কি আমরা এই বস্তিবাসীরাতো যে অবস্থায় আছি; একই অবস্থায় আছি বছরের পর বছর।

মারজিয়া সহসাই বিউটির এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না।  একটু থেমে বলে-

তোমাদের কোন লাভ হবে কি হবে না তা আমিও জানিনা। আমি রেডিওতে চাকুরী করি, আমার ওপর এ কাজের দায়িত্ব পড়েছে, তাই এসেছি।

 

মার্জিয়ার কথা শোনে- একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিউটি বলে-

: আমাদের আর ঈদ। আর আমাদের সাক্ষাতকার নিয়েই কি হবে। এতে কি আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে। মেয়েটির এ কথাটির উত্তর মার্জিয়া সহসা দিতে পারে না। কথা ঘুরিয়ে তাদের সাথে ভাব জমাতে শুরু করে। ভাব জমাতে না পারলে যে তার এ্যাসাইনমেন্ট ট্যাসাইনমেন্ট কিছুই হবে না।

মার্জিয়া আবার জানতে চায়-

: তোমরা ভাই-বোন ক’জন?

আমার দুই ভাই তিন বোন। আমাকেসহ ছয়জন। বলেই বিউটি ম্লান হাসে। এতজন ভাই-বোনের কথা বলেই যেন সে লজ্জা পেয়ে গেছে।

কথা শেষ করতে পারে না বিউটি। তখনি তার মা এসে হাজির।

: কিরে বিউটি কার সাথে তুই এমন কথা জমিয়ে বসছত। কে সে?

: মা ওনি রেডিও থেকে এসেছে। আমাদের একটি সাক্ষাতকার নেবে বলে।

: কিসের সাক্ষাতকার? বিউটির মায়ের কন্ঠস্বর কেমন ঝাঁঝালো শোনায়। মারজিয়া মহিলার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে-

: আন্টি আমি একটি রেডিও থেকে এসেছি। বস্তিবাসীদের ঈদ ভাবনা নিয়ে একটি সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য।

: আমাদের আবার কিসের ঈদ, কিসের ভাবনা। আর আমার মেয়ের সাথেই আপনার এত কিসের আলাপ। ঐ টং দোকানের সামনে থাইক্যাই দেখছি- বিউটি আপনারে ইনয়ে-বিনিয়ে কিসব বলছে। আর আপনি বসে বসে গিলছেন।

: না আন্টি। বস্তিতেতো এখন তেমন মানুষজন নেই। তাই বিউটির সাথে বসে গল্প করছিলাম।

: ওর সাথে আপনার কিসের গল্প। যান যান। আমাদের কোন ঈদ ভাবনা নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করি খাই, আর রাইত হইলে এই ঝুঁপড়ি ঘরে আইস্যা ঘুমাই। তয় আপনেই কন আমাগো আবার কিসের ঈদ ভাবনা। এখন যান যান, আপনের সাথে প্যাঁচাল পাররেনের সময় এখন নাই। বেগম সাব বাচ্চাদের জন্য কিছু পুরানা কাপড়-চোপড় দিছে, এই গুলা হেগরে দিয়া এখনঐ আমার আবার যাইতে হইবো। হেগো ঈদের সব গুছগাছ এহনও অনেক বাকি। কথা শেষ করেই মহিলা বিউটির দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে বলে-

: তর কি ভাত রান্দনের কাজ শেষ।

: জি¦। বিউটি কথা না বাড়িয়ে এক কথায় উত্তর দেয়। মহিলা বলে-

: চল চল ঘরে চল। এই কাপড়চোপড়গুলা রাখ। আর এই বাটিতে কিছু বাসি তরকারী আছে, রাতে ওগরে লইয়া খাইয়া নিস। চাঁন দেখা গেলে আমি রাইতে নাও আইতে পারি। তুই ভালা কইরা দরজা লাগাইয়া ঘুমাইয়া পরিস। মহিলা হনহন করে তার ঝুঁপড়ি ঘরে ঢুকে যায়। বিউটি ও তার ভাইবোনও তার মাকে অনুসরণ করে। অসহায়য়ের মতো একা দাড়িঁয়ে থাকে মারজিয়া।

ততক্ষণে বিদ্যুৎও চলে এসেছে। তখনই আসপাশের বাসা ও কাওরান বাজারের দিক থেকে মানুষের আনন্দ-কলরোলের আওয়াজ শুনা যায়। চাঁদ দেখা গেছেএএএ। ঈদ। চাঁদ দেখা গেছেএএএ। ঈদ। এ আওয়াজ শুনেই খালী গায়ে উলঙ্গ-অর্ধ উলঙ্গ ছেলে-মেয়ের বস্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। হই হই হই! চাঁদ দেখা গেছেএএএ! ঈদ ঈদ ঈদ-রে। আগামী দিন ঈদরে। মিছিল করার সুরে তারা এক সাথে জড়ো হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খুঁজতে থাকে। একটা ছোট মেয়ে বলে : কই চাঁন? চাঁন কই? চাঁনত দেখবার পাইছিনা।

সব ছেলে মেয়ে উদগ্রীব হয়ে চাঁদ খোঁজে। কিন্তু চাঁদ খোঁজে না পেয়ে ওদের চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ। এদের সাথে বিউটিও বেরিয়ে এসেছে। সেও অনেকক্ষণ ধরে চাঁদ খোঁজে না পেয়ে বিরক্ত আক্ষেপ করে বলে- : সবাই চল চল। ভিতরে চল। ঈদের চাঁদও বেস্তিবাসীদের দেখা দিবেনা। আমাদের মতো মানুষের আবার কিসের ঈদ, কিসের আনন্দ। আল্লাহতো আমাদের গরীব বানিয়ে সারা জীবনের আনন্দই কেড়ে নিয়েছে। এক দিনের আনন্দ দিয়ে আর কি হবে। চল চল সবাই, যার যার ঘরে চল। তবু বিউটির কথা উপেক্ষা অনেকেই পশ্চিম আকাশে চাঁদ খোঁজে বেড়ায়।

এরইমধ্যে যে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে তা টের পায়নি জাকিয়া। সেও চাঁদ দেখার জন্য বাচ্চাদের সাথে যোগ দেয়। বাচ্চারা চাঁদ খুঁজেই যাচ্ছে। কেউ কেউ চাঁদ দেখার গল্পও ফেঁদে বসে। কেবল বলে: ঐ দেখ চাঁন, ঐ বড় বিল্ডিং-এর ছাদের উপর। দেখছো!

কিন্তু কেউ চাঁদ দেখে না।  এরই মাঝে একফালি কৃষ্ণমেঘ পশ্চিম আকাশের দখল নিয়েছে। মেঘলা আকাশে আর কেউ চাঁদ খোঁজে পায় না। সবার মন খুব খারাপ। ওদের এ ব্যাকুল আবেগ মারজিয়ার মনকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায়। এখন কি করবে মারজিয়া ভেবে পায় না। কি হবে তার ‘বস্তিবাসীর ঈদ ভাবনা’র সাক্ষাতকার? সে মুহূর্তেই তার মত পাল্টায়। আর কোন সাক্ষাতকারের প্রয়োজন নেই। তার অন করা রেকর্ডারে বিউটি ও তার মায়ের যেটুকু কথা তা এবং বস্তিবাসীদের মিথ্যা চাঁদ দেখার শোরগোল কাটছাট করে আর; তার কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে চালিয়ে দেবে।

আর অপেক্ষা করেনা মার্জিয়া। রেল লাইন ধরে ব্যর্থ ও বিষণ্ন মনে সে প্রধান সড়কের দিকে হাঁটা দেয়।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ