
আজগরের সব জমি নদী ভাঙ্গনের শিকার। সহায় সম্বল আর কিচ্ছু নেই। শেষ একজোড়া গাভী ছিলো সেটা বিক্রি করেই একখন্ড ধানি জমি বর্গা নিয়েছিলো দু’ মাস আগে। অনেক কষ্ট করে গতর খাটিয়ে সে জমি চাষ করে, সেচ দিয়ে এবারে ধান ফলিয়েছে।
ফসলের দিকে তাকিয়ে আজগরের মুখে মৃদু হাসি ফোটে। সমস্যা হলো ফসল কাটার কামলা পাচ্ছেনা করোনার এই দুর্যোগের সময়। সবাই ঘরবন্দী এখন। কি যে হবে! তবে শেষমেশ মানুষ না পেলে সে একাই ধান কাটবে মনস্থ করলো। প্রতিদিন একটু একটু করে কাটলেও তিনদিনে কাটা হবে। এরপরে সুযোগ বুঝে মাড়াই করা যাবে।
আজগরের মনে দুঃখ একটাই ফসলের অর্ধেকটাই চলে যাবে জমির মালিকের কাছে। তা হোক, অন্তত কিছুদিন চলার মত ধান ঘরে উঠবে এটাই সান্ত্বনা। বউকে এবার দুটো শাড়ি, আর বাচ্চাদুটোকে নতুন জামাকাপড় দিতেই হবে। নিজের জন্য একখানা লুঙী আর একটা ফতুয়াও কেনার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। গত একবছর কাউকে কিছু দিতে পারেনি সে। এসব পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে আজগর বাড়ির দিকে পা চালালো।
আজ আজগরের কাছে কিছু পাতি নেতা এসেছে। তাদের বড় নেতা নাকি কৃষকদের সহায়তার জন্য ধান কাটার শ্রমিক নিয়ে আসবে অন্যজেলা থেকে। এই কাজের উদ্বোধন করতে আজগরের ফসলি জমিই পছন্দ হয়েছে তাদের। কারন মুল রাস্তার পাশেই তার জমিটি হওয়ায় নেতার দামী গাড়িটি সহজেই আসতে পারবে সেখানে। সাথে পুলিশ প্রশাসন সাংবাদিক সহ এলাকার আপামর জনগনও সেখানে থাকবে। সে এক বিরাট এলাহি কান্ড!
এসব শুনে আজগরের মন খুশিতে ভরে উঠলো। এতবড় নেতা আসবে তার জমিতে! সেই যে দুই বছর আগে নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে এসেছিলো নেতা এরপরে আর দেখেনি তাকে আজগর। একসময় তার কঠিন বিপদে সাহায্য চাইতে একবার দেখা করতে গিয়েছিল সে, কিন্তু এই পাতিনেতাদের হম্বিতম্বিতে দেখাটাও করতে পারেনি নেতার সাথে। যাক এবারে কিছু একটা হবে তাহলে।
অবশেষে সে মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এলো। আজ গ্রামে সাজসাজ রব। আজগর পাতি নেতাদের কথামত ধানাকাটার কিছু কাস্তে যোগার করে রেখেছে। তার আর চিন্তা নেই। নেতা সাথে করে ধানকাটার কামলা নিয়ে আসবে। তাদের পারিশ্রমিকের টাকাও নাকি সরকার দেবে! এর চেয়ে খুশির খবর এই সময় আর কি হতে পারে? এসব ভেবে মনে চাঙা ভাব নিয়ে সে তার ক্ষেতের দিকে রওনা দিলো।
কিন্তু জমিতে পৌঁছে তার চক্ষু চড়কগাছ! রাস্তায় অনেক গাড়ি দাঁড়ানো। পুরো ক্ষেতে লোকে লোকারন্য। মাঝাখানে কে একজন ধান কাটছে আর চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। একি দেখছে সে! তার ধানক্ষেত আর চেনাই যাচ্ছেনা। মানুষের পায়ের চাপায় সব গাছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার যোগাড়। পাকা ধানগুলি যে সব ঝুরঝুর করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে এটা কেউ খেয়াল করছেনা কেন? সবাই নেতার ধানকাটার ছবি তুলতেই ব্যস্ত। ধানক্ষেতের চিন্তা কেউ করছে না! আচ্ছা নেতা কাস্তে পেলো কোথায়? ছবি তোলার জন্য নিজেই সাথে করে নিয়ে এসেছে নাকি!
রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠলো আজগর। কিন্তু কে শোনে তার কথা! দূরে কিছু শ্রমিক কাস্তে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নেতার ছবি তোলার লঙ্কা কম্মটি শেষ হওয়ার পরেই ধানক্ষেতে যাবে তারা। তাদের উসখুস মুখ দেখে আজগরের মনেও কু-ডাক দিয়ে উঠল। তাহলে কি আর ধান পাবেনা সে এবারেও? এত কস্টের ফসল সব নষ্ট হয়ে গেলো তার! চাপা কান্নায় বুকটা মুচড়িয়ে উঠছে বারবার।
অবশেষে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। নেতারা সব চলে গিয়েছে। আজগর মাথায় হাত দিয়ে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে শ্রমিকদের ধানকাটা দেখছে। আসলে ধানক্ষেতের যে ক্ষতি হয়েছে সেখান থেকে কতটুকু ধান আসবে আর সে ধান মালিককে দিয়ে তার ভাগে কতটুকু থাকবে এটা ভেবেই সে অস্থির এখন। কত স্বপ্ন! কত আশা সব গুড়েবালি মনে হচ্ছে। সব সহ্য করা যায় কিন্তু পেটের ক্ষুধার জ্বালা মেটাবে কি করে?
গাছের ছায়ায় বিষণ্ণ মনে আজগর বসে আছে। তার পাশ দিয়ে কে যেন সাইকেলে চেপে রেডিওতে খুব পরিচিত একটি গান শুনতে শুনতে যাচ্ছে। আজগরের কানে বাজলো সে গানের সুর। তবে নানাবিধ দুঃশ্চিন্তায় সে ঠিক মনে করতে পারছেনা গানের কথাগুলো। বিষণ্ণতা দূর করতে আজগর এখন নিজেই বিড়বিড় করে গান গাইছে-
“এখনতো সময় ধান কাটার
এখনতো সময় ছবি ওঠার….”
২৫টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গরীবের কষ্ট ,স্বপ্ন এভাবেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। গল্প দিয়ে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
তৌহিদ
পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন দেখে ভালো লাগলো দিদিভাই। আসলে কৃষকদের এই সময়টা এখন গল্পের মতই অনেকটা। সবাই ভালো থাকুক।
শুভকামনা রইলো দিদিভাই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
এমন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কেউ একজন ব্লগে গল্প লিখবে মনেমনে ভাবছিলাম যাই হোক শেষপর্যন্ত বিষয়টি গল্প আকারে বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গরীবের কষ্ট ধূলিসাৎ করে মানবতার ছবি আপ্লায় নেতারা।
আয় সখি মাঠে আয় বাংলার নাটক দেখিতে,
রাজনৈতিক,সামরিক, আধাসামরিক. আম পাবলিক সব আছেন আজ ধান ক্ষেতে!
তৌহিদ
আপনার মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম। আসলে কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ। তাই তাদের কথা সবার আগে ভাবতে হবে আমাদের।
ভালো থাকবেন দাদা।
সুপায়ন বড়ুয়া
আজগরের কপালে পড়েছে ভাজ
ধীরে বাড়ে নাভিশ্বাষ
নেতার উছিলায় পাতি নেতারা
করে আজগরের সর্বনাষ।
বড়ই কষ্টের বেদনার।
ভাল লাগলো শুভ কামনা।
তৌহিদ
হ্যা দাদা, আতি আর পাতি নেতাদের দৌরাত্ম্যে কৃষক যেন নাজেহাল না হয় সেটি অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।
ভালো থাকবেন দাদা।
ফয়জুল মহী
তাদের জ্ঞান এবং হেদায়েত দিন আল্লাহ
তৌহিদ
তাই যেন হয়। ভালো থাকবেন ভাই।
ত্রিস্তান
আজগরদের স্বপ্ন এভাবেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। হ্যাঁ এটাই হওয়া উচিত আজগরদের সাথে।
তৌহিদ
আজগরেরা ভালো থাকুক। তারা না বাঁচলে আমাদের মরণ নিশ্চিত।
আরজু মুক্তা
হায়রে স্বপ্ন! কে দেখে? পরিণাম একই
তৌহিদ
কারো স্বপ্নে কেউ ভেসে যায়। এটা কিছুতেই কাম্য নয় আপু।
শামীম চৌধুরী
জ্বীভাইজান বেশী আশা করলে তা গুড়ে বালিই হয়। ভাল লাগলো।
তৌহিদ
ভাইজান, কৃষক আশা করতেই পারেন। আমাদের নিজেদের এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে তাদের আশা ভেস্তে যায়।
ভালো থাকবেন ভাইজান।
রিমি রুম্মান
অনেকদিন পর গ্রামীণ পটভূমির লেখা পড়লাম। সমসাময়িক। সুন্দর।
তৌহিদ
আপনার মতন গুণী লেখক সুন্দর বলে মন্তব্য করেছেন দেখে উৎসাহিত হলাম আপু। কৃষক বাঁচলেই বাঁঁচবে দেশ।
ভালো থাকবেন সবসময়।
কামাল উদ্দিন
আগে শুনতাম পাকা ধানে মই, এবার নেতারা নাকি কাঁচা ধানেও মই দিচ্ছে
তৌহিদ
মাথায় ঘিলু না থাকলে যা হয় আরকি ভাই। সবার বোধদয় হোক এটাই কাম্য।
ভালো থাকবেন ভাই।
কামাল উদ্দিন
রাজনীতিকরা সবার মাথায় কাঠাল ভাঙ্গে, অথচ আপনি বলতে চাচ্ছেন ওনাদের মাথায় ঘিলু নাই!!
তৌহিদ
সাধারণ মানুষকে নিয়ে যার চিন্তা হয়না তার ঘিলু নাই। মাথায় গিজগিজ করে গোবর… হা হা হা
না হলে কাঠাল ভাঙে ক্যামনে ☺
হালিম নজরুল
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখার সক্ষমতা সবার থাকে না। আপনাকে ধন্যবাদ ভাই।
তৌহিদ
পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। শুভকামনা রইলো ভাই।
নীরা সাদীয়া
এটা একটা ভন্ডামী। এদের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হলো কত না জানি কৃষক। প্রচন্ড রকম রাগ উঠেছে এদের এসব ভন্ডামী দেখে।
তৌহিদ
এদের বুদ্ধিশুদ্ধি সবই আছে, কিন্তু সব লোক দেখানো কাজ করে। ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষ। কবে যে এদের বিবেক হবে!!
জিসান শা ইকরাম
ধান কাটা নিয়ে কয়েকদিন খুব সার্কাস হলো দেশে। এরা সার্কাসের জোকারকেও হার মানিয়েছে।
ভালো লিখেছেন ভাই।