দৃশ্যপট : ১
ছোট বেলা থেকেই আমরা ঈদ , পূজা , নববর্ষ একসাথে পালন করে এসেছি। দুই ঈদের দিনে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছি। আমার মুসলমান ও হিন্দু বন্ধুরা বা প্রতিবেশী হিন্দু মুসলমান সবাই একই আনন্দে অংশ গ্রহন করেছি। ঈদের দিন দলবেঁধে আমাদের বাসায় হিন্দু মুসলমান সবাই আসতো।

এখনো আমার হিন্দু বন্ধুরা ঈদের দিনে, আমাদের বাসায় আসেন। বয়সের কারণে সেই উচ্ছ্বাসটা হয়ত আর নেই। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু ঈদের বিশেষ রান্না বেশ ভালোই পছন্দ করে

তেমনি পূজোয় মাসিমার নারকেলের নাড়ু, সন্দেশ ও মোয়া ছিল অত্যন্ত আকর্ষনীয় আমাদের কাছে। ধুমধাম ঢোলের শব্দ এখনো বাজে কানে। স্কুলের স্বরস্বতী পূজা শুধু হিন্দুদের একার ছিল না। কোন্‌ স্কুলের স্বরস্বতীর মন্ডপটা সবচেয়ে আকর্ষনীয় হয় সেই চিন্তায় থাকতাম অস্থির। যেদিন স্বরস্বতী নিয়ে শহর প্রদক্ষিন হোত সে দিন স্কুলের সব মুসলিম/হিন্দু ছাত্র তাতে অংশগ্রহন করতাম। প্রসেশন কোন স্কুলেরটা বড় এটাও দেখার একটা বিষয় ছিল।

এখনো বিভিন্ন পূজোর সময়ে- বাসায় নাড়ু ও সন্দেশ আসে। ছোট বেলার সেই মাসিমা এখনো বেঁচে আছেন। মায়ের মমতা এখনো পাই তাঁর কাছে।

আমাদের ছোট শহরটার অনেক মুসলিম ব্যাবসায়ী বিভিন্ন পুজা মন্ডপে ভালো অংকের চাঁদা দেন। আমিও আমার বাসার সবচেয়ে নিকটতম পূজামণ্ডপে মোটা অংকের চাঁদা দেই। অন্য পুজা মন্ডপের কাছে হার মানা চলবে না ।

আবার একই সাথে মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠান , যেমন ঈদ এ মিলাদুন্নবীতে চাঁদা দেয়ার পরিমান কিন্তু কম নয়।

ব্যবসা জীবনের প্রথম দিকে পিরোজপুরে একটা ইউনিয়নে যেতে হয়েছিল। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বেশ সন্মানিত ও ধনবান একজন হাজী সাহেব। উনি ওনার ইউনিয়নের দূর্গা ও স্বরস্বতী পূজোর সব খরচ একা বহন করতেন।

এই যে সম্প্রীতি, এতে কি আমাদের মুসলমানিত্ব চলে গিয়েছে ? বা ঈদের দিনে যে আনন্দ করা হত তাতে কি হিন্দুদের ধর্ম চলে গিয়েছে ?

আসলে এটাই আবহমান বাংগালীর রুপ। যেখানে ধর্মীয় গোড়ামী এই সম্প্রীতিতে কোন বাঁধা হয়ে আসেনি।

দৃশ্যপট : ২
১৯৭৫ এর পরে বিভিন্ন ঘটনায় আমার কয়েকজন হিন্দু বন্ধু চলে যান কলকাতা। খুব কষ্ট হয়েছে ওদের বিদায় দিতে। কেঁদেছি জড়াজড়ি করে। তারপরও দেশে থাকতে না পারার কষ্ট নিয়ে ওরা চলে যায়। ওদের প্রাণ থেকে যায় এখানেই।

৮৩ সনের দিকে কলকাতা গেলাম। প্রথম বিদেশ ভ্রমন। অনেক বছর পরে তপন ও দুলালকে দেখে কারো চোখেই আর পানি আটকিয়ে রাখতে পারিনি। কলকাতায় বসবাসকারী ওদের দুয়েকজন আত্নীয়ের কাছে নিজদের বড়ত্ব জাহির করার জন্য আমাদের কথা বলেছিল ওরা। তেমনি এক আত্নীয়ের বাসায় একরাতে দাওয়াত খেতে গেলাম। বাসায় প্রবেশের আগে বিশাল ধাক্কা খেলাম। আমি যে মুসলমান তা নাকি আমার বন্ধু তপন বলেনি ওর আত্মীয়দের কাছে। কি আর করা পরিচয় গোপন করে কোন রকম খেয়েই বিদায় নিলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এমনি ভাবে আর এক বাসায়ও দাওয়াত খেলাম।

কি দাঁড়াল ফলাফল ? আমার বন্ধুদের দুয়েকজন আত্মীয় গোড়া হিন্দু। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের যাওয়া নিষেধ। ঐ বাড়ির লোকজন আমাদের ভাষায় কথা বললেও তারা হিন্দু ধর্মীয় গোড়ামীতে আচ্ছন্ন । হিন্দুত্ববাদ তারা অতিক্রম করতে পারেনি।

দৃশ্যপট : ৩
মাস দুই আগে শেরপুর গেলাম। আমার এক বড় ভাইয়ের মেয়ের বৌভাতে । খুবই ভদ্র ও নমনীয় পরিবার। মিষ্টি ,পান সুপারি ও জর্দা ইত্যাদি নিয়েই গেলাম। মিষ্টির টিন গুলো গাড়ী থেকে নামানোর সময় বাড়ীর একজন মুরুব্বি বললো "বেয়াই সাহেব, মিষ্টি কোন হিন্দু দোকান থেকে কিনে আনেননি তো? " ভাগ্য ভালো যে মিষ্টি নিয়েছিলাম টিনের মধ্যে , তাই দোকানের নাম লেখা ছিল না। উত্তর দিলাম সাথে সাথে , "কি যে বলেন , হিন্দুদের দোকানের মিষ্টি আনবো কেন ? যে দোকান থেকে কিনেছি তার সব কর্মচারীও মুসলমান।" এরপর আর সমস্যা হয়নি।

ধর্ম এখানেও আটকে দিল। আমার এই আত্মীয়রা মুসলিম ধর্মীয় গোড়ামী মুক্ত হয়ে বিচার করতে পারেননি। মানুষের পরিচয় তারা মুল্যায়ন করেন ধর্ম দিয়ে।

আমরা ধর্ম পালন করবো । কিন্তু কখনোই তা যেন আমাদের মাঝের সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে না পারে ।

'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম.......'
(গানের এই চার লাইন একজনার একটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এখানে দিলাম)
গানের ভিডিও লিংক

মাত্র কয়েকদিন পূর্বে ঈদ এবং দূর্গাপূজা খুব নিকটতম সময়ের ব্যবধানে উদযাপিত হয়েছে। লেখাটি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আবার প্রকাশ করলাম।
৩,নভেম্বর,২০১১
বরিশাল।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ