আলুবোখারা নাম শুনে চমকে গেলেন?।

শামীম চৌধুরী ১৫ নভেম্বর ২০২০, রবিবার, ০৩:২৪:২৭অপরাহ্ন পরিবেশ ২০ মন্তব্য

মদনা টিয়ার লিংক এখানে- লাল-বুকের মদনা টিয়া

*

কুষ্টিয়ায় গিয়েছিলাম মূলত দুধরাজ পাখির ছবি তোলার জন্য। ঘটনাটি ছিল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস। রাতের বাসে কুষ্টিয়া রওনা হলাম। ভোরে কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা ছোট ভাই শাফায়াত বাস স্ট্যান্ডে এসে আমাদের রিসিভ করলো। পরে সেখান থেকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেল। সাফায়াত মূলত ঢাকার উত্তরায় থাকে। কুষ্টিয়া যেতে হয় প্রতিমাসে বাড়ি ভাড়া ও দোকান ভাড়া সংগ্রহের জন্য। ওদের বাড়িটি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা। পুরা বাড়িটা নান্দনিক কারুকাজ ও হরেক প্রজাতির ফলজ গাছে পরিপূর্ন। ওর বাড়িতেই জলপাই গাছে আমি প্রথম সিপাহী বুলবুল পাখির ছবি তুলেছিলাম। যদিও ছবি ভাল হয়নি, তারপরও রেকর্ড শট হিসেবে আজও রেখে দিয়েছি। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আলমডাঙ্গায় আমাদের নিয়ে গেল। সেখানে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের বিশাল জমি। বড় বড় বেশ কয়েকটি পুকুর আর নানান গাছে পরিপূর্ন পুরা এলাক জুড়ে। সেখানেই দুধরাজ পাখির আনাগোনা ছিল।

আমরা একটি বাঁশ বাগানের ভিতর দুধরাজ পাখি খুঁজছিলাম। হঠাৎ টুই..টুই...টুই শব্দ কানে ভেসে আসলো। পাখিটির ডাকে বুঝতে পারলাম কোন টিয়া প্রজাতির পাখি হবে। তবে সবুজ টিয়া পাখি যে নয় সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আমার কাছে ভিন্ন প্রজাতি টিয়া পাখির ডাকের শব্দ মনে হওয়ায় দুধরাজ পাখি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখলাম। বাঁশ বাগানের পাশের গাছে মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ গাছের পাতা নড়ে উঠলো। চোখ চলে গেল সেই পাতার দিকে। এমন সময় দেখলাম হলদে-সুবজ রঙের দুটি পাখি বের হয়ে আসলো। আমি বোকা হয়ে গেলাম। দূর্লভ পাখি দুটি এখানে দেখবো তা ছিল আমার কল্পনার বাহিরে।

হীরমন টিয়া (ছেলে)

দূর্লভ ও আমাদের দেশীয় এই পাখিটি ছিলো Plum-headed parakeet বা হীরামন টিয়া। অঞ্চল ভেদে লালমাথা বা আলুবোখারামাথা টিয়া নামেও পরিচিত। আলুবোখারামfথা টিয়া Psittaculidae পরিবারের ৩৭সেঃমিঃ দৈর্ঘ্য ও আকার ভেদে ৫৬-৮০ গ্রাম ওজনের দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার আবাসিক পাখি। এরা আমাদের দেশীয় পাখি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ৩৭সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের মধ্যে লেজই প্রায় ২২ সেঃমিঃ। এদের পালক হলদে-সবুজ বা হালকা সবুজ। ঠোঁট হুকের মতন বাঁকানো। নীলচে সবুজ লেজটি সরু। যার আগ্রভাগ সাদা। ছেলে ও মেয়ে পাখির মধ্যে প্রার্থক্য আছে। পুরুষের মাথার রং আলুবোখারা (Plum) ফলের মত গাঢ় বেগুনী-লাল। চিবুক কালচে রংয়ের। ঘাড় ও গলা জুড়ে রয়েছে কালো বন্ধনী। যা চিবুকের কালো রঙের সঙ্গে মিশে গেছে। কাঁধে মেরুন লাল দাগ। মেয়ে পাখির মাথার রং হালকা ও ধূসর। যা হলদ রং দিয়ে ঘেরা থাকে। এমনকি কাঁধের উপরের দাগটিও হলুদ থাকে। উভয়ের পা, আঙ্গুল ও পায়ের পাতা সবুজাভ-ধূসর। এদের মাথায় দাগ ও রঙের মাধ্যমে কইরাদি টিয়া থেকে পৃথক করে চেনা যায়।

হীরামন টিয়া বনের শেষ প্রান্তে যেখানে কৃষি জমির সঙ্গে মিশেছে সেখানে ফলের বাগান ও খোলা বনের গাছে থাকতে পছন্দ করে। সচারচর এরা ছোট ছোট দলে থাকে। পাকা ফল,ফুল ও ফসল পেলে খাবারের জন্য গাছ থেকে নীচে নেমে আসে। খাদ্যতালিকায় রঙ্গিন পাকা ফল, ফুলের রেণূ, শস্যদানা,ফুলের পাঁপড়ি ও ফুলের মধু রয়েছে। এরা অন্যান্য টিয়া পাখি থেকে একটু নম্র স্বভাবের ও লাজুক হয়ে থাকে। উড়ার সময় টুই,টুই,টুই শব্দ করে। এদের স্বরে কোন মধুরতা নেই। কর্কশ স্বরে ডাকে।

জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে বড় গাছের খোঁড়লে বা অন্যান্য খোঁড়লি পাখির পরিত্যাক্ত বাসায় বাসা বানায়। স্ত্রী পুরুষ দুজনে মিলেই বাসা তৈরী করে। নিজেদের বানানো বাসায় স্ত্রী পাখিটি সাদা বর্ণের ৪-৬টি ডিম পাড়ে। উভয়েই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। ২০-২২ দিনে ডিম থেকে ছানা ফুঁটে বের হয়। মা-বাবা দুজনেই ছানাদের খাবার থেকে নানান পরিচর্যা করে। এক সময় ছানাগুলি নিজেদের খাবার সংগ্রহের জন্য খোঁড়লের বাসা থেকে উড়ে প্রকৃতিতে মিশে যায়। এদের আয়ুস্কাল ৭-৮ বছর।

বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিস্তৃত রয়েছে। এরা আমাদের দেশে খুবই দূর্লভ। যত্রতত্র দেখা যায় না। তবে কুষ্টিয়া নওগা,বগুড়া, ঢাকায় এদের মাঝে মাঝে দেখা যায়। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে আলুবোখারামাথা টিয়া পাখি সংরক্ষিত।

হীরামন টিয়া (মেয়ে)

বাংলা নামঃ হীরামন বা আলুবোখারামাথা টিয়া
ইংরেজী নামঃ Plum-headed parakeet
বৈজ্ঞানিক নামঃ Psittacula cyanocephala

 

 

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ