আলতা

এস.জেড বাবু ১০ নভেম্বর ২০১৯, রবিবার, ০১:২০:০২অপরাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ২৭ মন্তব্য

মা !
বাবা কি আসবে ?

থমকে গিয়েও উচ্ছাসে ভিজে উঠে আলেয়ার চোখ-
কেঁপে কেঁপে উঠে থেমে যায় নিরব অন্তর্দহন-
গাল গড়িয়ে ঠোটের কোনায় লেগে থাকা অশ্রু কনার সাথে নিস্পাপ হাসিতে উদ্ভাসিত ভেজা মুখ-

সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেও পরক্ষনেই মিলিয়ে যায় উচ্ছাস, ভয়ার্ত চোখের ভাষায় শব্দহীন নিরব দৃষ্টি ফেলে তিথীর চোখে-
আড়াই বছরের মেয়েটা বুঝতে পারেনা ভয়ের সুর- বুঝেনা চোখের জলের অর্থ-

আবারও আকুতি-
মা !
বলোনা মা – বাবা আসবে ?

তেল কুচকুচে তিথীর বেণী করা মাথাটা টেনে নিয়ে বুকে হুহু করে উঠে আলেয়া____
মেয়ের মাথায় চুলের ফাঁকে আঙ্গুলের কড়া গুণে বের করে সময়ের ব্যাবধান –

সেই সাত মাস- আগে বৈশাখী মেলায় রেশমী চুড়ি, লাল ফিতা আর মেয়ের জন্য আলতা কিনতে গঞ্জে গিয়েছিলো মুহিত-
আর ফিরেনি-

নয়ন মাঝির মুখে, শুনেছিলো আলেয়া
হানাদারদের রেট পড়েছিলো সেদিন
১৮জন তাজা যুবকের হাত পা বেঁধে নৌকায় তুলেছিল ওরা-
মাঝ নদীতে যাওয়ার পর শুনতে পাওয়া যায় এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ-

এর পর আর শুনতে পারেনি আলেয়া-
শুনতে চায়নি সে-
বিশ্বাস জাগেনি পরের গল্পে-

আলোয়ার বিশ্বাস – মুহিত আসবে___
দু বছরের বাক প্রতিবন্ধী (তোতলা)  মেয়েটাকে দেয়া কথা ভুলতে পারেনা সে-
ওকে আসতেই হবে।
আলতা পড়াতে হবে তিথীর পায়।

দখিনা হাওয়ায় নদীর ঘাটে ভেসে আসা কিছু ক্ষতবিক্ষত লাশের খবর নড়াতে পারেনি আলেয়াকে-
শুনেই চিৎকার করে বলেছিলো আলেয়া-
নয়ন চাচা- ওখানে সে নেই-
মুহিত বেঁচে আছে,
সে আসবে-

-০-

যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাত মাস পর, আজ এ ঘরে প্রাণ ফিরে আসবে, এ দেহে জান ফিরে আসবে___
গেল সন্ধ্যার চিরকুটে সেই পরিচিত হস্তাক্ষর,

আমার আলো,
কেমন আছো ?
চিনতে পারছো ? আমি !
আমি তোমার মুহিত-
মনে পড়ে আলো, গাঁয়ের মাঠে হা-ডুডু খেলার সময় কেমন করে সামনের এক একজনকে ঘায়েল করতাম !
তুমি আসতে আমার খেলা দেখতে, মিটি মিটি হাসতে, তোমায় দেখলে আমি নিজেও কেমন বন্য হয়ে উঠতাম।
সেভাবেই-
সেদিন নৌকায় গুলি করার সময়, সামনের একজনকে ষাঁড়ের মতো গুতো মেরে নিয়ে পানিতে পড়েছিলাম।
ওরা গুলি করেছিলো পানিতে, আমার ডান হাটুতে লেগেছে। যতক্ষন নি:শ্বাস ছিলো সাঁতরে গিয়েছিলাম পানির নিচ দিয়ে।
পরে শুনেছি সবাইকে মেরে ফেলেছে ওরা।

সেদিন শুনলাম দুধেল গাইটা কেড়ে নেয়ার সময়, ওরা গুলি করেছে আমার বাবাকে- বাবা বলেছিলো, সদ্য বাঁছুরটা মরে যাবে, আমি কঁচি বাঁছুরটার চিৎকার সহ্য করতে পারবো না-

সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছি,
আমার গ্রাম হানাদার শূণ্য হবে,
হানাদার শূণ্য হবে এ দেশ।
আমরা ফিরেছি,
পাশের গ্রামে আছি, আজ আমাবস্যা- আমি আসবো, চার মাস ধরে আলতার শিশি কোমরে রেখে ট্রেনিং নিয়েছি, অস্ত্র তুলে নিয়েছি, এখন সময় এসেছে নিজের গাঁয়ে ফিরবো,  মেয়েটার মুখে বাবা ডাক শুনার বড় শখ।
এর পর হামলা হবে আলো-

-০-

হারিকেনের আলোয় চাঁদের মতো চকচক করছে তিথীর মুখ- বাবাকে দেখার আনন্দে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলেও মুখে হাসিটা লেগে আছে নিঃস্পাপ –

হটাৎ গোয়ালে বাছুরটা ভয়ার্ত সুরে ডেকে উঠে-
খিড়কি খুলে এক দৌড়ে উঠানে আসে আলেয়া, পিছন থেকে কালো চাদরে আচমকা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে- আলো – আমার আলো-

তেমনি বুকের সাথে আলেয়ার মাথা জড়িয়ে রেখে চার কদম হেটে ঘরে ঢুকেই দরজায় খিল লাগায় মুহিত।
মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে ঝড়ঝড় করে কেঁদে ফেলে সে-
চিৎকার করে বলে উঠে
যুদ্ধ- !!!
এ কেমন যুদ্ধ !!!
মেয়ের মাথায় হাত বুলানোর জন্য বেঁচে থাকার যুদ্ধ।
একজোড়া কঁচি পায়ের পাতায় আলতা লাগিয়ে দিতে- সন্তানের কাছে আসার জন্য যুদ্ধ-

-০-

টমেটু আর ফুলকপির সাথে কৈ মাছের ঝোল-
চকচকে চোখে ভাতের লোকমা মুখে তোলার সময় হটাৎ বলে উঠে আলেয়া-

– মেয়েটার না খেয়ে ঘুমিয়েছে, বললো বাবার সাথে খাবে-

মুখে না পুড়ে হাত খালি করে উঠে যায় মুহিত মেয়ের দিকে- খানিকটা টেনে হাঁটছে ডান পা-

অমনি দরজায় মৃদু শব্দ- আলো দরজা খোল মা-

– কে ?

আমি তোর নয়ন চাচা- নয়ন মাঝি-

আলেয়া দরজা খুলতেই নয়ন চাচাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে চার পাঁচজন খাকি পোষাকধারী-

পিঠে দুই দুইটি বেয়নেট বিঁধে উঠার ধাক্কায়, ঘুমন্ত মেয়েটার উপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছিলো মুহিত।
নিজ হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে কোন রকমে আড়াল করে বুক ফেটে বের হয়ে আসা আর্তচিৎকার-
যেন মেয়েটার ঘুম না ভাঙ্গে,
ততক্ষণে পিঠে বুট রেখে টেনে বের করে বেয়নেট, দু’বগলের নিচে হাত রেখে দুজন টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে যায় মুহিতের নেতিয়ে পড়া শরীর- আছড়ে ফেলে উঠানে।

মাত্র দশ ফিট দুরে খড়ের গাধায় তিন তিনটে জানোয়ারের সাথে ধস্তাধস্তিতে হার মেনে আসছে আলেয়ার শরীর।

চিৎকার করছে নয়ন চাচা-
মেয়েটাকে ছেড়ে দাও!
সে সাত মাসের অন্তস্বত্তা ।

মুহুর্তেই মুহিতের পায়ের কাছে হাটু গেড়ে আছড়ে পড়ে নয়ন চাচা-
আমাকে ক্ষমা করে দে বাপ।
তোকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য আমার চৌদ্দ বছরের মেয়েটাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে ওরা।

ততক্ষণে আলেয়ার দেহের উপরে জানোয়ার বদল হচ্ছে-
কেউ একজন সিগারেট জ্বালতে ম্যাচের খোচা দিতেই আলেয়ার মুখটা চোখে পড়ে মুহিতের-

লালচে চোখ দুটি যেন ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে।
আঁচলের অনেকটা অংশ মুখে ঢুকিয়ে রেখেছে ওরা- কখন থেকে থেমে গেছে ধস্তাধস্তি। নেতিয়ে পড়ে আছে হাত।

মৃদূ সুরে ডেকে উঠলো মুহিত- ওসকো ছোড় দো- ও জীন্দা নেহি রাহি ।

যেন জীবনের সবটুকু সঞ্চয়কৃত শক্তি ফিরে পেল নয়ন মাঝি- হটাৎ বিজলী খেলে উঠে মাথায়-

দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে দুরে সরিয়ে দেয় আলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা খাকি পোষাকের জানোয়ারটাকে-

আরে- কুত্তা – আল্লাহ সহ্য করবে না !
মেয়েটা গর্ভবতী ছিলো-
আর কখন যেন মরে গেছে তোদের অত্যাচারে-

কেমন মায়ের ঘরে জন্ম তোদের ?
শেষ পর্য়ন্ত একটা লাশের সাথে ………..

একটা গুলির শব্দ__
গড়গড় শব্দে থমকে গেল নয়ন চাচার কন্ঠ…

গুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেছে তিথীর।
এক হাতে হারিকেন, অন্য হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বাবার দিকেই এগিয়ে আসছে মেয়েটা____

মামনি- আমার মা, ডেকে উঠলো মুহিত

চোখ দুটি চকচক করে উঠলো তিথীর-

– তু.তু.তু তুমি আমাল বাবা !!!

কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বাবার গলা-

– তু.তু তুমি আমার জন্য আ.আ আলতা এনেছ ?

পিঠে হাত বুলিয়ে বুকের উপর মেয়েটারে বসায় মুহিত। কোমড়ে রাখা আলতার শিশির দিকে হাত যেতে যেতে ফিরে আসে ধীরে ধীরে।
বুকের তাজা রক্ত আঙ্গুলে নিয়ে মেয়ের পায়ের পাতায় লাগিয়ে দিতে দিতে মুহিত বলে,
– মামনি, এইতো আলতা, দেখো কত সুন্দর দেখাচ্ছে তোমার পায়ে ‘লাল’ রং ।

একটা মিস্টি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তিথীর মুখ-

সে রাতে, পায়ে আলতা মাখানোর আনন্দে বাবাকে তেমনি বুকে আগলে ধরে ঘুমিয়েছিলো তিথী-

আর অবুঝ সন্তানের পায়ে রক্ত রেখা এঁকে দিয়ে, চিরদিনের তরে ঘুমিয়েছিলো স্বাধীনতা প্রত্যাশী মুহিত।

-০-

সেদিনের সে ভয়াল রাতের পরও পূবের আকাশে সূর্য্য উঠেছিলো।
তারও একমাস পর বাংলার আকাশে উড়েছিলো স্বাধীনতার পতাকা।

আজ স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পর- আবছা আলোয় নিজের পায়ের আলতা দেখতে দেখতে, কিশোরী নাতনীটাকে বুকে আগলে রেখে, সেদিনের সে ভয়াল গল্প শুনায় তিথী-

কে জানে,

““পরাধীনতার শৃংঙ্খলে আবদ্ধ না হলে, কোন জাতি-
জন্মসূত্রে পাওয়া স্বাধীনতার মর্ম কতটা বুঝবে !!””

-0-
কাল্পনিক প্রেক্ষাপট- মুক্তিযুদ্ধ
ছবি- নেট থেকে

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ