আমি মাকে দেখিনি

হেনা বিবি ৮ ডিসেম্বর ২০১৩, রবিবার, ০১:৫৯:৫১পূর্বাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ৮ মন্তব্য

১১ই জুন, বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট
বন্ধুরা, এইদিনে এই সময়ে আমি আমার মাকে হারিয়েছি । পাকিস্তানী বাহিনী আমার মাকে গুলি করে হত্যা করেছে।

প্রেক্ষাপট , ১৯৭১ সাল। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ , সোনাইমুড়ির একটি বাড়ী রামপুর। বাড়ীর ছেলে গুলো মুক্তিযুদ্ধে গেল। নোয়াখালীতে প্রথম সশস্ত্র হামলা চালান হল এই বাড়ী থেকে। পাকিস্থানীদের চোখ আমাদের বাড়ীতে পড়ল । জীবনের ভয়ে পালিয়ে শহর থেকে বাড়ীতে আমরা আশ্রয় নিয়েছি। সেই রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম আমরা সবাই। অকস্মাৎ রাতের অন্ধকারে পুরো বাড়ীতে একজাতীয় পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল পাকিস্তানী আর্মি। দাউ দাউ আগুন। সব পুড়ে গেল । বাড়ীর সব মানুষ প্রান নিয়ে পালিয়ে গেলাম। আত্মীয়দের বাড়ী বাড়ী ঘুরতে লাগলাম । আলু সিদ্ধ খেয়ে থাকতাম আমরা। অবশেষে পোড়া টিন দিয়ে আবার ঘর তুলে থাকা শুরু হল। আমি তখন ৫ বছরের শিশু। মা , চাচীরা রুটি আর পানির জগ দিয়ে আমাদের রাস্তায় পাঠাত কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখলে যেন তাদের খেতে দেই। দেশ স্বাধীনের কঠিন প্রত্যয় । জান্ মালের কোন চিন্তা নাই, শুধু স্বাধীনতা চাই। এলো সেই কঠিন দিন। ১১ ই জুন। মা রাঁধছিলেন । আমরা উঠোনে খেলছিলাম। পাকিস্তানীরা পুরো বাড়ী ঘিরে ফেলল । দিকবিদিক ছুটোছুটি । মা আমাদের নিয়ে পালালেন পুকুর পাড়ে । পাকিস্তানীরা ঘিরে ফেলল পুকুর পাড় । তারপর ব্রাশ ফায়ার। আমার হতভাগ্য মায়ের বুকে এসে বিঁধল সেই গুলি। আমি মায়ের নবম সন্তান। পাশে ছিলাম, একেবারে গা ঘেঁষে । বুক থেকে গলিয়ে সব রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। মা ,মা বলে অনেক্ষন ডাকলাম , জবাব নাই। পুকুর থেকে পানি এনে মায়ের মুখে দিলাম, গড়িয়ে পড়ে গেল। তারপর আমার চিৎকার অবশেষে অজ্ঞান। বাড়ীতে কোন পুরুষ ছিল না আমার মাকে তুলে আনার জন্য। নিথর মায়ের দেহ আর আমরা বসে রইলাম কখন কেউ আসবে আমাদের উদ্ধার করবে। আমার চতুর্থ ভাইটি বাজারে ছিল। শুনল বাড়ীতে আর্মি ঢুকেছে ,তিন মাইল হামাগুড়ি দিয়ে আমার সেই ভাই বাড়ী আসল । মায়ের দাফন শেষে আবার আমরা পালালাম এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী । আমাদের অপরাধ আমরা কেন স্বাধীনতা চাই।

স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আমি শহিদ আনোয়ারা বেগমের কন্যা তোমাদের কাছে আমার মাকে ফেরত চাই। তোমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছ । যেন তেন ভাবে দেশকে ক্ষতবিক্ষত করছ। চল বন্ধুরা দেখি দেশ কেমন আছে? এক বন্ধু এক সরকারী কর্মকর্তার অফিসে গেছে। সেই বন্ধুর জন্য নবম তলা পর্যন্ত সুগন্ধি স্প্রে করা হল। ২৩ রকমের তরকারী দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করা হল অফিসে । এসি গাড়ী দিয়ে বাড়ী পৌঁছে দেয়া হল তাকে। এই সরকারী কর্মকর্তাটি কত টাকা বেতন পায় ? আর অফিসে তার কি কাজ? এই শিক্ষিত পাপী কি জানে দেশ কিভাবে স্বাধীন হয়েছে? কাদের ত্যাগের বিনিময়ে সে ওই অফিসে বসে ? দেশকে রসাতলে নিচ্ছে এরা কারা? বন্ধুরা , খুব ইচ্ছা হচ্ছে ওই ঘুসখোরটাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে কষে একটা চড় দিতে। শুনেছি এইসব ঘুসখোররা নাকি আজকাল গুলশান ,ধানমন্ডিতে বাড়ীও কিনে।

আজকাল রাজাকারদের নিয়ে খুব হৈ চৈ । বিচার চাই ,বিচার চাই। আমার কাছে রাজাকারদের গাছের মরা ডাল মনে হয়। গাছে আছে বলে গাছকে অসুন্দর মনে হয়। কেটে ফেললে গাছের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে আর না কাটলেও কিছুদিন পর এমনিতেই ঝরে পড়ে যাবে। কিন্থু এইসব ঘুসখোর , অসুস্থ রাজনীতি, পচা রাজনীতিবিদ , অসৎ ব্যবসায়ী , শেয়ার বাজার লুণ্ঠনকারী এরা তো গাছের গোঁড়ায় বসে ঘুন পোকার মত আস্ত গাছটাই খেয়ে ফেলছে। এদের থেকে দেশকে বাঁচাবে কে? আমরা ? কে? কে?

আমার বড় মেয়ে একবার আমাকে বলেছে স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম এই আমরাই নাকি দেশের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছি। নিজের আখের গোছাতে আমরা এই ৪০ বছর দেশকে পিছনে ঠেলে দিয়েছি। তবে এখন কি হবে? আমার মায়ের রক্তের দাগ কি তাহলে মুছে গেছে? আমার হাত থেকে তো তা মুছে নাই। আমি আজও রক্ত দেখলে সেন্সলেস হয়ে যাই। হাসপাতাল গেলে মনে হয় রোগীগুলো বুঝি এখনই মরে যাবে এই ভাবনায় আমার জ্বর চলে আসে। বন্ধুরা ,আমি আমার মাকে হারিয়ে এই ৪০ বছর অসুস্থ হয়ে বেঁচে আছি। সাথে আমার প্রিয় দেশটিও অসুস্থ। মায়ের আজ হারিয়ে যাওয়ার দিন। দেশের জন্য বুকের রক্ত দিয়ে গেছেন তা যেন বৃথা না হয় আমার মায়ের। তাই এসো আওয়াজ তুলি আরেকবার,

মাগো , তুমি যা দিয়ে আমাদের ঋণী করেছ

আমরা জীবন দিয়ে , দেশকে ভালবেসে তা পুরন করব।

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ