আমি ও আমার সিরিয়াল (ম্যাগাজিন)

রাফি আরাফাত ১৭ মে ২০১৯, শুক্রবার, ০৩:৫৯:১০অপরাহ্ন গল্প ১৩ মন্তব্য

জীবনের প্রতিটা পরীক্ষায় সবার শেষ সিরিয়ালটা যেন আমার জন্য সরকার থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত। সেটা আমি ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত দখল করতে পারেনি। আর আমি হয়তো একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা সবার শেষ সিরিয়ালটি পাওয়ার জন্য আগ্রহের সাথে পরীক্ষা দেই। কি হাসি পাচ্ছে সবার তাইনা। আমারও পায় মাঝে মাঝে। কারন কি জানেন, যখন ভাবি যে ক্লাসের শেষ সিরিয়ালটা কি কোন মানুষ পায় না? নাকি কোন পশু পায়? যাকে কেন্দ্র করে আমরা এতো হাসাহাসি করি৷
..
শিক্ষাগত ইতিহাস আজ এতটুকুই থাক। এখন আসি পরিবারে আমার অবদান নিয়ে। মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান হওয়া সত্বেও,বাবার একমাত্র কুলাঙ্গার সন্তান আমি। দিনে মা যতবার আদর করতো,বাবা ঠিক ততবার পিটাতো। সেটার কারণ কি জানেন? ঐযে আমার সিরিয়াল সবার পরে। আচ্ছা আপনারা বলেনতো সিরিয়াল আগে নাকি আমি তার ছেলে এটা আগে? তাই মাঝে মাঝে মনে হয় কেন যে আমার মতো করে সবাই ভাবে না। আর ভাববেই বা কেন! আমারতো সিরিয়ালই নাই। আমার আগে কতজন আছে। ওদের কথা ভাবতেই তো সবার দিন শেষ।
..
অবশেষে সিরিয়ালে সবার শেষে থেকেই গৌরবের সাথে স্কুল জীবন শেষ করলাম। পড়ার ইচ্ছে ছিলো ঢাকায়। যদিও সিরিয়ালের মতে আমাকে পড়াশুনা করাতে চাইলে আমার বাবাকে নিজেই কলেজ খুলে সেখানে আমাকে ভর্তি করায় পড়াশুনা করাতে হবে। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে তার আর দরকার হলোনা। ঢাকায় থাকা কলেজ গুলোর সিরিয়ালে সবার শেষে যেই কলেজ, সেখানে আমার ভর্তি হওয়ার সুযোগ হলো। যদিও আমার সাথে কলেজের সিরিয়ালের দিকটা পুরোপুরি মিল আছে।
..
কলেজ জীবনটাও সিরিয়ালের সবার শেষের নামটা আমার ই থাকলো। সত্যি এটা যেন এক বিশেষ ক্ষমতা আমার। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পালা। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সেটা সবার অজানাই থাক। কিন্তু জীবনের কাছে পরাজিত হওয়া সেখান থেকেই শুরু।
..
প্রথমেই বাসা থেকে টাকা দাওয়া বন্ধ করে দাওয়ার কারণে টিউশনি করাই। আর যাকে পড়াই সেও প্রতিবার আমার মতো করে ক্লাসে সিরিয়ালে সবার পরেই থাকে। কি অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা? এভাবেই কাটতে লাগলো দিন রাত। ধীরে ধীরে জীবনটাকে অসহ্য লাগতে লাগলো। ঠিক সেই মূহুর্তে জাদুর মতো করে সফলতা হাতের মুঠোয় আসে ধরা দিলো।কি ভাবছেন চাকরি পাইছি? আরে ভাই না। আমার বিয়ে ঠিক হইছে তাও সেটা গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র মেয়ের সাথে। কিন্তু সমস্যা কই জানেন,আমি বেকার, তাই আমি চেয়ারম্যান বাড়ির একমাত্র ঘরজামাই।
..
২৩-০২-২০১৭ সালে বা্দ আসর আমার আর জেবার বিয়ে সম্পন্ন হলো। ব্যতিক্রম ঘটলো শুধু মেয়ে ছেলের বাসায় না আসে ছেলে মেয়ের বাসায় গেলো। খুব হাসি পাচ্ছে সবার তাইনা। আচ্ছা ঠিক আছে অনেক হাসছেন এখন একটু অন্য কথায় আসি। আবার পিছনে ফিরে গেলাম।
..
স্কুলে সবার শেষ সিরিয়ালটা আমাকে দেয়ার পর যখন স্যাররা আমাকে উপহাস স্বরূপ সামনে নিয়ে বলতো,এই বেয়াদবটাকে তোমরা কেউ বন্ধু বলে স্বীকার করবা না,ঠিক সেই সময়ে আমার জীবনের কাছে আমি আমার মরন কামনা করছি। বাবা যখন বলতো তোর মতো কুলাঙ্গার জন্ম দিয়ে আমি পাপ করেছি তখন আমি চুপ করে থাকতাম। আর আমাকে গাল দাওয়ার পর যখন বাবা রুমে গিয়ে কান্না করতো, তখন আমাকে আমার পরিবারের জন্য বোঝা মনে হইতো।
..
এতকিছুর পরও আমাকে একজন খুব ভালবাসতো। তার নাম ছিলো কনা। আমাদের গ্রামেই তার বাসা। সেটা অবশ্য কনা আর আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। সে আমাকে কতটা ভালবাসে সেটা বোঝার চেষ্টা আমি কখনো না করলেও যখন আমাকে না পাওয়ার সম্ভাবনা তার মনকে তাড়া করতো, তখন আমার নিজেকে সবার অযোগ্য মনে হতো।
..
এর মাঝে একদিন মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো। ডাক্তার দেখায় জানলাম তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু সে পরিমান টাকা আমাদের কাছে এখন নেই। অবশেষে আমাদের চেয়ারম্যান এর কাছে বাবা গেলো ধার নিবে বলে। তিনি ধার দিলেন তবে তাও এক শর্তে।
..
চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে তার সবচেয়ে আদরের। তাই তিনি চান তার মেয়ে সারাজীবন তার পাশেই থাকুক। তাই তিনি প্রস্তাব দিলেন যদি আপনার ছেলেকে আমার মেয়ের ঘরজামাই করতে রাজি থাকেন তবে আমি টাকা দিবো। সেদিন কনা নামের মেয়েটাকে জীবন থেকে কবর দিয়ে দেই আমি। মা সুস্থ হয়ে উঠলো। জানিনা এইবার কে জিতলো,আমি, নাকি কনা,নাকি চেয়ারম্যান সাহেব।।
..
আমার বিয়ের তিন দিনের মাথায় কনা গলায় দড়ি দিলো। কেন দিলো সেটা আজ কেউ না জানলেও আমি জানি৷ আমার কি করা দরকার এখন? সেদিন আমার প্রথম মনে হয়েছিলো জীবনে সিরিয়ালটা সত্যি গুরুত্বপূর্ণ।
..
আপন বলতে আমার মা আর বাবা সারা আমার আর কেউ ছিলো না। এরই মধ্যে মা বাবাও আমাকে একা করে না ফেরার দেশে চলে গেলো। আর চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়েও আমাকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পৃথিবীটা কতো অদ্ভুত তাইনা।
..
বাবা বলতেন আমাকে, বাবারে আমরা না থাকলে তুই কিভাবে থাকবি। তুই যে খুবই বোকা রে। তোকে কেউ তো এই সমাজে রাখবে না। আমি হাসতাম আর বলতাম, তোমরা না থাকলে আমি আর কারো কাছে মার খাবোনা, আর অন্য সমাজে গিয়ে ভদ্র হয়ে থাকবো। অথচ আজ হা হা হা।
..
বেঁচে থাকার জন্য কাজ করা শুরু করলাম। মানুষের উপকার করলাম। এখন আমি আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান। কিন্তু আজ আমার মাকে টাকা লাগবে না,আজ কনাকে বিয়ে করার মতো ক্ষমতা নেই আমার, আজ বাবার গালটা শুনতে চাইলেও পারছিনা। আসলে জীবন এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে সবকিছু সময় মতো না করলে, সারাজীবন তার আফসোস করতে হয়।
..
আজ বাবা মা কনা কেউ নেই। আমি আছি কিন্তু খুব বাবার কাছে যাইতে ইচ্ছে করছে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। কনার কাছে মাফ চাইতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা এই ইচ্ছেগুলো কিভাবে পূরন করা যায় কেউ বলতে পারবেন?
..
আমার ইচ্ছেগুলোর একটা সিরিয়াল করছি আমি। যার সবার শেষ সিরিয়ালে ছিলো, *রাফি তুই মর*।এখন বলেন তো আমি কি করবো।

ধিক্কার তোমাকে হে সমাজ,
যেখানে মনুষ্যত্ব বিক্রি হয় সিরিয়াল দিয়ে,
আর মায়ের জীবন রক্ষা হয়,
ছেলেকে বিক্রি করে।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ