আজ একুশে বই মেলা হয়। আমার কোন হেলদুল নেই। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন এই বই মেলার জ্ন্য মুখিয়ে থাকতাম। বই মেলায় যেতে না পারলে মন হাসপাস করত। আমিতো ছিলাম বরাবরই বই এর পোকা । এখন সে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে অনেকটা। সময়ও তেমন নাই । যে বই পড়াটা আমার নেশা মত ছিল আজ তার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারন হুমায়ুন আহমেদ।তার ইন্তেকালের পর হতে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করি। উনি বেচে থাকতে নিয়মিত না হলেও সময় করে একবারটি হলেও গিয়েছি মেলায়। কিন্তু তার অবর্তমানে আমার কাছে এই মেলা প্রায় গুরত্বহীন হয়ে পড়েছে। আগে নতুন নতুন কি কি বই বের হল তা দেখার জন্য পত্রিকায় হুমরি খেয়ে থাকতাম। আর এখন মেলা কখন শুরু কখন  শেষ  তা নিয়ে আমার মধ্যে কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই।

এর মানে এই নয় যে আমি যে শুধু হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ি। তা কিন্তু না। তার ভাই জাফর ইকবালের বইয়ের আমি একজন ভক্ত। এছাড়া ওপার বাংলার শির্ষেন্দু আর সমরেশে, শংকর আর বুদ্ধদেবের বইয়ের আমি খুব ভক্ত পাঠক। মেলায় গেলে হুমায়ুন আহমেদের পাশাপাশি ওদের বইও কিনতাম।

আমার এই পাঠাগারটি গড়ার পিছনে একটা ইতিহাস আছে।হুট করে এটি হয়নি। আসলে বই  পড়তে পড়তেই এর সৃষ্টি। আর আমার বই পড়ার অভ্যাস গড়ার পেছেনে যার ভুমিকা সবচেয়ে বেশী তিনি হলেন আমার মরহুম বাবা। যখন প্রাইমারীতে পড়তাম তখন দেখতাম বাবা অফিস থেকে যখনই আসতেন সাথে করে শিশু পত্রিকা নিয়ে আসতেন। সেই ম্যাগাজিনটি আমরা চার ভাইবোন মিলে পড়তাম। এছাড়া প্রায়ই বাবা পুরোনো মার্কেট থেকে ছোটদের বিভিন্ন গল্পের বই কিনে আনতেন। সেই তখন থেকে আজ অবধি বই পড়ার অভ্যসটা ধরে রেখিছি এখনো।

এছাড়া খিলগাঁঁও ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যান পরিষদ এই প্রতিষ্ঠানটিও আমার বই পড়ার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেখান নানা পত্রিকা থাকত। ইসলামিক বই সহ নানা প্রকার গল্পের বই থাকতো। ইসলামী ফাউন্ডেশন এর সিরাতুন্নবী সা. এর মেলা থেকে পাঠাগারে প্রচুর বই কিনা হতো। ইসলামী ফাউন্ডেশনের গল্পের বইগুলির অন্যরকম মজা ছিল।  বিশেষ করে নবী রাসুলের কাহীনি গুলো।  হায়রে কোথায় সেই দিনগুলি!

বই পড়া নিয়ে একটা ঘটনা বলি- আমরা তখন থাকি ১৬/৬ খিলগাঁও বাগিচার ইলিয়াস কলোনী নামে খ্যাত একটি ভাড়া বাসায়। পড়ি ক্লাস ফাইফ কি সিক্স এ। বাবার আনা বই সব পড়ে ফেলেছি। নতুন বই খুজছিলাম পড়ার জন্য্। কিন্তু ঘরে কোন বই নাই। এ সময় পাসের বাসায় এক আপার ঘরে একটা মোটা গল্পের বই দেখে নিয়ে এলাম পড়ার জন্য। পড়ব বলে মাত্র বইটা নিয়ে বসেছি তখনই সেই আপা কোথা এসে ছো মেরে বইটি নিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল –সাহস দেখো ছেলের নাক টিপ দিলে দুধ বেরুবে সে কিনা নোবেল পড়ছে। তাও আবার প্রেম কাহিনি ভালবেসে হাতটি ধরো। আমিতো পড়ার জন্য একটা বইইতো নিয়েছি এতে এতো চেচামেচি কিসের তা বুঝার বয়স তখনো হয়নি আমার। আর প্রেম কাহিনি কি নোবেল কি এই জ্ঞানও তখন হইনি। রাক্ষস খোক্ষস আর ভুত পেত, ঠাকুরমা ঝুলি আর গোপলভাড়ের গল্পতেই তখনো আটকে ছিলাম। আশে পাশের অন্য সব ভাড়াটিয়া আর বাড়ির লোকের সামনে সে সময় খুব হেনস্তা হয়ে ছিলাম। এরপরও আমার বই পড়ার অভ্যাসে কখনো ভাটা পড়েনি।

একুশে বই মেলাতে প্রথম যখন যাই তখন আমি পড়ি ক্লাস নাইনে। সেবা প্রকাশনির তিনগোয়েন্দা সিরিজের ভক্ত হয়েছি। একই প্রকাশনীর অনুবাদকৃত গল্প আর উপন্যাসগুলো পড়াশুরু করেছি। মেলা থেকে এসব বই কিনে এনে পড়তাম। সেই সময় হঠাৎ বাবা নিয়ে এলেন হুমায়ুন আহমেদের একটি বই যার নাম বোতল ভুত। ওটা দিয়েই হুমায়ুন জগতে প্রবেশ। এরপর থেকে সেবা প্রকাশনীর বই এর পাশাপাশী মেলা থেকে সমানে কিনে চললাম পুতুল, ভুত ভুতং ভৌত হুমায়ুন আহমেদের বইগুলি। কলেজে যেতে যেতে আমি রিতিমত হুমায়ুন আহমেদের ভাল একজন ভক্ত হয়ে গেলাম। আর এভাবেই আমার ব্যাক্তিগত পাঠাগারটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠল দিনকে দিন।

এসময় আমরা থাকি ৫৪২/সি খিলাগাঁর বাসায়। এলাকার শিশু কিশোর কি ছেলে কি মেয়ে এমনকি বৃদ্ধ যুবা পুরুষ মহীলা সবাই আমার বইয়ের পাঠক। রিতিমতো বই পড়ার আন্দোল যেন শুরু হয়েছিল এলাকাতে। বই মেলা থেকে বই আনা মাত্রই কাড়া কারি পড়ে যেতো সবার মাঝে। কার আগে কে পড়বে। কত রকমের পাঠক যে ছিল। কত টাইপের বই যে কিনেছি।

আমার মা বাবা পছন্দ করত দস্যু বনহুর সিরিজ। আমার পড়া প্রথম বড়দের বই। বাবা প্রাযাই কিনে আনতেন । তাদের সাথে পড়তে পড়তে আমিও এ সিরিজের ভক্ত হয়ে যাই। আমার এক মামাতো ভাই থাকত মালিবাগ কলোনীতে । সেও আমার পাঠাগারের ভক্ত ছিল। তার জন্য কিনতাম মাসুদ রানা সিরিজ। আমি পড়তাম কিন্তু এ সিরিজটা আমার তেমন ভাল লাগতো না।

হুমায়ুন্ আহমেদের ছোট ভাই জাফর ইকবাল উনি তখন সাইন্সফিকশ আর ছোটদের বই লিখতেন। তার বইগুলোও আমার খুব পছন্দের ছিল। বই মেলাতে যখন কোন বই বেরুত আমি যেতে না পারলেও তা সংগ্রহ করতাম। এক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করত খিলগাঁও চৌরাস্তার কয়েকটি লাইব্রেরী। ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরী তার মধ্যে অন্যতম। লাইব্রীর মালিক ফরিদভাই মাইডিয়ার লোক। আমার জন্য যত কষ্টই হোক উনি বই যোগার করতেন ফাস্ট এডিশন। মেলায় যাবার আগে উনি আমার জন্য বই নিয়ে এসেছেণ এমনও হয়েছে। তার কাছে আমি সত্যই কৃতজ্ঞ। কিছুদিন আগে খিলগাতে গিয়ে দেখলাম ছাত্রবন্ধু লাইব্রীটি এখনও আছে । ফরিদ ভাইও আছে।আল্লাহ তাকে নেক হায়াত দান করুন।

আমরা তখন থাকি খিলগাঁও সিপাহীবাগে সোনালী ব্যাংকের সিবিএ নেতা মোহম্মদুল্লাহ চৌধুরীর বাসায়। সেখানে আমার এ সংগ্রহ শালাটি নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন ঐ এলাকার কিছু বই প্রেমীর সাথে আমার পরিচয় হয়। তাদের একান্ত সহযোগীতায় আমারা সবাই মিলে ভ্রাম্যমান পাঠাগার কার্যক্রম শুরু করি। সেটা ১৯৯৬ কি ৯৭ সালের কথা। রিতিমত ফরম তৈরি করে রেজিষ্ট্রেশন করে ফি জমা দিয়ে সদস্য করা হতো আর প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট চাঁদা দিতে হতো। বই পড়ার আগ্রহ আছে এমন যারা পেশা জীবি বা সময়ের অভাবে বই সংগ্রহ করে বই পড়তে পারতো না তাদের জন্য আমাদের এ কার্যক্রম। বাড়িতে বাড়িতে বা এলাকার দোকানে দোকানে আমরা বই বিলি করে সেখানে পাঠক তৈরী করেছি। আজ সবই স্মৃতি। আমাদের এ উদ্যোগের অনেক বছর পর আবু সাইদ স্যার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ভ্রাম্যমান পাঠাগার কার্যক্রম শুরু করে।

বই মেলা আসে বই মেলা যায়। আমাকে ছোয় না তার রেশ। হুমায়ুনকে হারিয়ে বই কেনার আগ্রহটাই যেন শেষ। বই পড়ার আগ্রহটা থাকলেও পুরনো বই আর কাহতক পড়া যায়। হিমু সিরিজ বা মিসির আলী সিরিজের জন্য অপেক্ষার সেই শিহরন আজ নেই। একুশে বই মেলায়ও তাই আজ যেনো পানসে আমার কাছে । কিসের যেনো অভাব বোধ হয়।কোথায় যেন কেউ নেই।

 

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ