আমার ছেলেবেলা- সোলেমানী মন্ত্র

তৌহিদুল ইসলাম ১ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:০৪:১৪পূর্বাহ্ন গল্প ২৩ মন্তব্য

দস্যিপনার তালিকায় পাড়ার ছেলেদের মধ্যে আমি ছিলাম এক নম্বরে। গ্রামের প্রতিবেশীদের গাছের ফল চুরি করা থেকে পুকুরের মাছ ধরাতে আমাদের সমকক্ষ আর কেউ ছিলোনা। ছিয়াশি সালের ডিসেম্বরে স্কুল ছুটিতে নানুবাড়ি গিয়েছি। উদ্দেশ্য একটাই- বড় নাতি হিসেবে পাওয়া আদরটুকুর পুরোটাই ছেলেমি দস্যিতে কাজে লাগানো।

যেই ভাবা সেই কাজ, আমার সঙ্গী ছিলো ছোট দুই মামা যারাও স্কুল পড়ুয়া। সে সময় মাথায় সবসময় গিজ গিজ করতো দুষ্টু বুদ্ধি। চোখে খেলা করতো অন্তরিক্ষের নাম না জানা সব আলোর ঝিলিক। মেজোমামার পুকুরের মাছ চুরি করে ধরার পরিকল্পনা হয়েছে আমাদের। না বলে মাছ ধরাতেই যেন আনন্দ!

কিন্তু অতি অল্প সময়ে দ্রুত বেশী মাছ কিভাবে পাওয়া যায়? একেবারে ছোট্ট মামা বলে উঠলো - আমার কাছে বশীকরণ মন্ত্রের বই আছে। সেখানে মাছ ধরার মন্ত্র আছে। কিন্তু সমস্যা হলো সে মন্ত্র আওড়াবে কে? আর মন্ত্রের মশলাপাতি যোগানোর জন্য সাহসী ছেলে লাগবে। উপায় কি?

দুঃসাহসী আমাকে আর পায় কে! বললাম - মামা তুমি সেই সোলেমানী মন্ত্রের বইটি আমাকে দাও। যা হবার হবে। মামা শুধু বললেন পারবিতো? বললাম- হু হু, দেখাই যাক। আমার মনে তখন বড়শিতে গাঁথা অনেক মাছের স্বপ্নে বিভোর। বুকটা ফুলে উঠলো বীরের মতন।

সোলেমানী মন্ত্রের বইটি মামা যোগাড় করেছে মসজীদের ইমাম সাহেবের ছেলেকে বাগিয়ে। সে যে তার বাবার বই চুরি করেছে এটা দুধের বাচ্চাও বুঝবে। অবশেষে বহুল প্রত্যাশিত সোলেমানী যাদুর বই এলো আমার হাতে! তবে সেই সময় ঘুণাক্ষরেও যদি জানতাম -জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ের সম্মুখীন হবো আমি, তাহলে সত্যি বলছি জীবনেও সেই সোলেমানী মন্ত্রের বই হাতে নিতামনা।

সোলেমানী মন্ত্রের বই

পরের দিন- সেই বইয়ের মন্ত্রের কথামত আমি আর দুই মামা হাতে বড়শি নিয়ে যাচ্ছি মেজোমামার পুকুর ঘাটে, উদ্দেশ্য মাছ চুরি করবো। মন্ত্রের শর্তমতে একমুষ্টি কবরের মাটি যোগার করতে হবে। দিন হতে হবে মঙ্গলবার মধ্যদুপুরের সময়। কবরস্থানে যেতে হবে একা। একজন বুজুর্গ মানুষের কবরের মাটি লাগবে যিনি মারা গিয়েছেন অমাবস্যার রাতে! কবরের উপরের মাটি হলে হবে না, ভিতরের মাটি লাগবে।

এরকম মৃত মানুষের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। আর আমরা ছোট, এসবের খোঁজ করলে পিটুনি নিশ্চিত। আমার ভোলাভালা নানীকে বলাতেই তিনি বললেন - পাশের গ্রামের এক নামাজী ব্যক্তি এরকম সময়ে মারা গিয়েছেন আর তার কবর হয়েছে ময়দানের মাঠ নামক এক গোরস্থানে। আর পায় কে! এই কবরস্থান একেবারে মামার পুকুরের কাছেই। তবে নানীনে কৌশলে আমাদের মাছ ধরার কথা চেপে গেলাম আমি।

সোলেমানী মন্ত্র মোতাবেক ভর দুপুরবেলা আমি কবস্থানে গিয়েছি। মামা আগেই দেখিয়ে দিয়েছে সে কবর। যেতে হবে একা, তাই মামাকে চলে যেতে বলে আমি বীরদর্পে এগিয়ে গেলাম কবরের কাছে। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। খোলা ময়দানে হু হু করে ভেসে আসা বাতাস গায়ে কাঁটা দিয়ে গেলো। ভয় লাগছে এবার, প্রচন্ড ভয়। মনে হচ্ছে কবর থেকে মৃত ব্যক্তিরা আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে।

মনে মনে ছোটবেলায় শেখা দোয়াদরুদ যা জানতাম সব পড়া শুরু করে দিয়েছি। কবরের কাছে যেতেই বুকে হাতুরীপেটা করছে। ধুক্ ধুক্ শব্দ নিজের কানে ড্রাম বাজানো শুরু করলো। যেই না কবরের চারপাশে ঘেরা বাঁশের বেড়ায় হাত দিলাম আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। পুরো শরীর কেঁপে উঠলো মনে হলো। এসবের মাঝে আমি ভুলেই গিয়েছি কবর থেকে মাটি ডানহাতে তোলার সময় যে মন্ত্র বলতে হবে সেটা! উলটোপথে দৌড়ে ছুটে পালাতে চাইলাম কিন্তু মামাদের কাছে ভীতু হিসেবে নিজেকে পরিচয় করানোর ইচ্ছেটাকে জোড় করে দমন করে চেপে রইলাম।

মাটি উপরের হোক আর ভিতরের, কবরের মাটি হলেই হলো। এই ভাবনায় নিজের অদম্য ভয়কে দূরে সরিয়ে যেই ডান হাতে কবরের উপরের মাটিকে স্পর্শ করে একমুষ্টি মাটি নিয়েছি মাথার উপর একটা দাঁড়কাক কর্কশ কাঁ কাঁ শব্দে বাজখাঁই কন্ঠে ডেকে উঠলো। আর যাই কই, ভয়ের চোটে একছুটে সেই যে দৌড় লাগিয়েছি একেবারে পুকুর ঘাটে এসে থামলাম। মুখ হা করে শ্বাস নিতে নিতে মামাকে মুষ্টি খুলে দেখালাম কবরের মাটি!

এবার বই খুলে মাটিতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে সেই মাটি ছড়িয়ে দিলাম পুকুরে। যেহেতু মন্ত্র পড়া মাটি তাই তিনজনের বিশ্বাস ছিলো বড়শিতে চারা লাগানো ছাড়াই মাছ আজ উঠবেই উঠবে। সোলেমানী মন্ত্রের জোড় যে অনেক! ঘাটে বসে পুকুরে বরশী ফেলে মাছ ধরার আশায় বসে আছি আমরা তিন সুবোধ বালক!

একঘন্টা যায়, দেড়ঘন্টা যায়, বরশীর ফনা নড়েনা। তারমানে কি? মন্ত্র কি তবে কাজ করছেনা? এক মামা বললো- তুই কবরের মাটি নিয়েছিসতো ঠিকঠাক মতন? আমি জবাবে শুধু বললাম- হু!

এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। এ সময় মেজোমামা পুকুর ঘাটে আসেন আশেপাশের ক্ষেত দেখতে। আমাদের দেখতে পেলে আজ আর আস্ত রাখবেননা তিনি।

অগত্যা বিফল মনোরথে আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম। নানু প্রচন্ড রাগারাগি করলো একা একা মাছ ধরার গল্প শুনে। যদিও সবকথা চেপে গিয়েছিলাম সেদিন। তবে রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর এসেছিলো। আর সেই জ্বরে পুরো সাতদিনের ছুটি বিছানায় কেটেছে সে বছর। বড়মামা গঞ্জ থেকে ডাক্তার নিয়ে গিয়ে ঔষধ লিখে নিয়েছিলেন বলে সে যাত্রায় রক্ষা!

নানীর মুখে শুনেছি প্রথম তিনদিন আমার কোনো হুঁশই ছিলো না। জ্বরের ঘোরে আমি নাকি বার বার কবর, মাছ, বড়শী এসব কথা বলেছি। আমার এমন অবস্থায় গ্রামের এক কবিরাজ এসে নানীকে বলেছিলেন- আমার প্রচন্ড ভয় থেকে এমন হয়েছে। তবে কিভাবে তিনি বুঝেছিলেন সেটা আজও রহস্য থেকে গিয়েছে আমার কাছে।

আমাকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য আম্মা এসেছিলেন গ্রামে। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় মেজোমামা মৃদু হেসে বললেন- মাছ খাবি তা আমাকে বললেই হতো। পুকুরেতো মাছ নেই। তোরা পাজির দল যেদিন মাছ ধরতে গিয়েছিলি তার আগেরদিনই আমি সব মাছ বেঁচে দিয়েছিলামরে! তোর মামার পুকুরের মাছ সব চলে গিয়েছে হাঁটে। মাছ না থাকলে সোলেমানী মন্ত্রে কি আর বরশীতে মাছ গাঁথে? গাঁধার দল সব!!

একথা শুনে আমি নিশ্চিত আমার প্রচন্ড জ্বর দেখে ছোটমামারা ভয়ে সব বলে দিয়েছে মেজোমামাকে। লজ্জায় মাথা লুকানোর জন্য আম্মার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন। তবে মেজোমামা বা ছোটমামারা আমার রাগী মাকে কিছুই বলেনি সেসব। পাছে তাদের আদরের ভাগ্নেকে শাস্তি পেতে যেনো না হয়।

আমরা আসার সময় মামা বিল থেকে বিশাল সাইজের তিনটি বড় রুই, নদীর চিতল মাছ দিয়েছিলেন। অথচ তাদের ভাগ্নে আজও মাছ খায়না। বছরে দু'এক টুকরো হয়তো মুখে দেই দাওয়াতের বাসায় গেলে। সেখানেতো আর না করা যায় না। কাউকে কাঁটা সহ মাছ চিবিয়ে খাওয়া দেখলে আমার হিংসে হয়। আমি কেন মাছ খেতে পারিনা!!

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ