
আমি মেয়ের বাবার হাত ধরে দৌড়াচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি কে জানে? শুধু চারদিক জোসনায় থৈ থৈ। চাঁদ যেন সূর্যের সমস্ত আলো ধার করে মুগ্ধতা মিশিয়ে জোসনার থালা উপুর করে দিয়েছে। অসহ্য সুন্দর দৃশ্য! অতি সুন্দর সবসময় সহনীয় হয়না। মাঝে মাঝে বিরক্তিকর হয়?
আমার দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে। কেন যেন পায়ের তলার বালুগুলো ভীষন গরম। শরীর কেমন যেন ঘেমে উঠছে। রাতে তো বালু গরম হবার কথা নয়! আর দৌড়ে পারছি না। মেয়ের বাবা আমাকে ছেড়ে ঘন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করছি, তবুও সে ফিরছে না।
– এই মা, মা এরকম করছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
ঝাক করে ঘুম ভেঙে গেল। গলা শুকিয়ে একেবারে খরখরে শুকনো কাট হয়ে গেছে। পুরো শরীর ঘেমে ছপছপে হয়ে আছে। ভীষন পানির তেষ্টাও পেয়েছে।
– রোদ, মা পানি খাবো!
– মা খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে? কেমন যেন করছিলে!
উত্তর না দিয়ে ঢকঢক করে পানি শেষ করে দেখলাম আমি আমার বিছানায়। এতোক্খন তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম? রোদ বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে হঠাৎই খুব শূণ্য আর একা মনে হল। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।
রোদ আমাকে খুব শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছে। যেন সে আমার মেয়ে না, আমি তার মেয়ে। আশ্রয়, প্রশ্রয়, সাহস সবটাই আছে তাতে। ছোটবেলায় সে কেঁদে উঠলে আমি যেমন করে তাকে বুকে চেপে নিতাম তেমনি আজ আমি তার শিশু হয়ে উঠেছি।
পিঠে হাত বুলিয়ে সে বলছে, – মা আমি সব জানি। আর জানি বলেই বাসায় চলে এসেছি। তুমি বাবাকে সময় দাও। সে যদি তোমাকে ভালবেসে থাকে তাহলে ফেরত আসবে। আর না চাইলে আসবে না। আমি তো আছি, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। এমন করেই বুকের ভেতর রেখে দেব।
আমার ‘নবাবু’ ফিরেছে। আমার উচিৎ ছিলো তাকে পিক করতে যাওয়া। আমি অবশ্য যাইনি; যেতে ইচ্ছে করেনি। কোথাও অভিমান লুকিয়ে ছিল। অন্ততঃ ফেরার সময় সে আমাকে জানিয়ে আসতে পারতো। নাকি কেউ পাশে ছিল বলে জানাতে চায়নি।
আর আমার না যাওয়ার অন্য কারন হলো কোথাও থেকে ফিরে গরম গরম খাবার, শাওয়ারে গরম পানি, নরম, শুকনো, পরিস্কার টাওয়েল, ট্রাউজার এসব তার চাই-ই চাই। এতোদিন এসব কে করেছে কে জানে! যে আদুরে আর সোহাগী, পান থেকে চুন খসলে বিপদ!
আমি খুব অপেক্ষায় ছিলাম মেয়ের বাবা হৈ হৈ করে বাসায় ঢুকবে। ছাদ বাগান থেকে ফুল এনে রেখেছিলাম, দেব বলে। সে ব্যাগ খুলে রাজ্যের জিনিস ছুড়ে দিয়ে বাসার বারোটা বাজাবে। এরপর তার গিফট চাইবে। অবশ্যই লুকিয়ে একটা চুমু আর ফুল। একেবারে নাছোড়বান্দা!
কতেদিন পর অথচ তার মাঝে এসবের ছিটেফোঁটা কোন উচ্ছাস নেই। সেই বিরক্ত করা মানুষটা, কোথাও থেকে ফিরলে চোখে চোখে গিলে খাওয়া, মেয়েকে লুকিয়ে বেডরুমে ইশারা ঈঙ্গিত কোনটাই নেই।
মেয়েকে জড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। মানুষটা অনেক রোগা হয়ে গেছে। স্বপ্নের সেই তরুন ছেলেটিকে রীতিমতো বয়স্ক লাগছে। ছ’ মাসেই কেমন করে এতোটা বুড়িয়ে গেল মানুষটা। কেমন মনমরা হয়ে আছে। শাওয়ার সেরে হাল্কা খেল। খাওয়ার টেবিলেও নীরব। আগের সেই হাসি, দুষ্টুমি কোনটাই নেই, চুপচাপ।
আমি তার বদলে যাওয়া দেখছি আবার ভাবছি এটা সে ঢং করছে। একটু পরেই এসে বলবে- দুর ছাই! আর পারছি না, পেট ব্যথা করছে।
রাতে আমি জানতে চাইলাম- কেমন ছিলে এতোদিন?
মেয়ের বাবা শুধু চোখ তুলে তাকালো। কোন উত্তর দিলনা।
আবার চুলে হাত দিতে দিতে বললাম- মাথা নেড়ে দেবো কি?
আবারও সে কোন উত্তর দিলনা। । শুধু পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। আমার মনের ভেতর কেমন অশনি শকুন ডেকে উঠল। আমি নির্ঘুম তার পাশে ছটফট করতে থাকলাম।
লাগেজের কাপড় চোপড় অন্যসময় অপরিস্কার, ইস্ত্রীহীন থাকে এবার তাও নেই। মনে হল, কেউ যত্ন করে গুছিয়ে দিয়েছে। ধরাম করে ফেলে দিয়ে ধোয়া কাপড় পরে তিনি ফিট বাবু হয়ে বলতে থাকেন।
– ময়লা কাপড় পরতে পরতে জীবন শেষ! তুমি ছাড়া আমার কি যে হবে?
– কিছুই হবে না! নতুন কেউ আসবে, সে দেখভাল করবে। আজকাল মেয়েদের তো বুড়ো, টাক, টাকাঅলা জামাই পছন্দ।
– তার কাছে কি আর তোমার গায়ের গন্ধ থাকবে? বুনো, পুরোনো গন্ধ কিন্তু মনে হয় আজই এডমিট হয়েছে শরীরে। নবাবু’ গা ঘেসে গন্ধ শুকতে এলো। এবার তার উদ্দেশ্য খারাপ।
– ফিল্মি হয়ে যাচ্ছো! আমি মেয়ে এসেছে বলে তাকে চমকে দিলেই তবে সে পালায়।
আর বোধহয় আমার গায়ের গন্ধ ‘নবাবু’ র দরকার নেই। অথচ ভেবে রেখেছিলাম, আমি নিজেকে তার জন্য উন্মুক্ত আকাশ বানাবো। আকাশ পাতাল ভাবছি, কূলকিনারা নেই।
ফোনে আমাকে অনেকেই অনেক কথা বলে। আমি পাত্তা দেই না। আর ভালোবাসায় জোর করার কিছু নেই।পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভালোবাসাময় সম্পর্ক হলো স্বামী- স্ত্রীর। দুজন অপরিচিত, রক্তসম্পর্কহীন মানুষ কেমন করে যেন চির আপন হয়। একসাথে বসবাস করে। ছেড়ে যেতে চাইলে বলে- তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
অথচ বাবা- মা মরে গেলে বলে না। ভাই- বোন সম্পর্ক ত্যাগ করলেও বলে না। আত্মীয়তার জামানা তো বিলুপ্তপ্রায়। বন্ধুত্বের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক।
অফিস থেকে সোজা আমার কলেজে গেটে গিয়ে অপেক্ষা করতো। আমাকে নিয়ে নদীর পাড়, রাজ্যের যতো ভাজাভুজি বাচ্চাদের মতো গিলে ফিরতাম। পরদিন প্রচন্ড এসিডিটি নিয়ে দুজন ওয়াশরুমের সামনে লাইনে। আমাকে কোনভাবেই যেতে দেবে না, এ নিয়ে রীতিমতো মারামারি। একসময় তাকে জিতিয়ে আমি অন্যকোথাও যেতাম।
অন্যদিনের মতো কলেজ থেকে ফিরে দেখি মেয়ে নেই। তাকে ফোন দিতেই সে জানালো, জরুরি ক্লাস ছিল তাই চলে এসেছে। আমার কেবলই মনে হল, ঘটনা অন্য। কারণ মেয়ের বাবা রাতে তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছে।
মেয়ে আমার মতোই চাপা স্বভাব। সে কিছুই বলেনি, আমিও জানতে চাইনি। আজ সব বুঝলাম। হয়তো আমারও ডাক পড়বে। আমি নিজেকে আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিলাম। নেবার তেমন কিছু নেই। কাপড়- চোপড় আর অনেক বই। যে বইগুলোর অধিকাংশই মেয়ের বাবার কিনে দেয়া।
আমি শেষবার গোছানো সংসার দেখে বেড়িয়ে গেলাম। চাঁদটা আজও জোছনার থালা উপুর করে দিয়েছে। ঝকঝকে ভেজা অঙ্গন আমার পেছনে ফেলে আমি গাড়িতে বসার জন্য এগুচ্ছি। ছায়া এগিয়ে আসছে, কালো জ্যাকেট গায়ে। চশমা ছাড়া চোখে কিছুই দেখিনা। উপরে চশমা ফেলে এসেছি। মনে হলো, আমার দিকে রোদোচ্ছায়া এগিয়ে আসছে। লাগেজ আর প্রসারিত দুহাত। এখন তার হোস্টেলে থাকার কথা, এখানে কিভাবে এল? আমি কি হেলুসিনেশানে চলে যাচ্ছি।
” কানা আজও চশমা ফেলে এসেছ! তাই ভরা জোছনাতেও হাতড়াচ্ছ। হাতড়াবেই তো, এই যে থৈ থৈ জোছনা ও যে আমার কাছেই ধার করা। তোমার মেয়ের কাছে। তুমি সত্যিই ভীষন বোকা, সারাজীবন বোকামী করে দাসত্ব করেছ। আর সেটাকেই ভালোবাসা ভেবেছ। তবে আজকের কাজটা করেছ বুদ্ধিমানের। তুমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত অথচ নিজেকে অসহায় ভাবতে থাকা, বয়সের চেয়ে বুড়িয়ে যাওয়া একটা বাচ্চা মেয়ে। আজ থেকে তোমাকে আমি দত্তক নিলাম। সবাই ছাড়ুক তোমায়, আমি আছি তোমার পাশে, চিরকাল থাকবো রোদমাখা জোছনা হয়ে।”
কোথাও ধীর লয়ে গান বেজে চলেছে। যেন আমাদর কথাই বলছে,,,,,,
মেরী কিসমাতোকো মিলে হাত তেরে,
ফিরতে ছে লাকিরে দিখনে লাগে।
দেখা তুমহে তো এয়ছা লাগা হ্যায়,
জ্যায়সে এ আঁখে ধারকানে লাগি।
রাহু উমরাহ ভার ম্যায় তেরী, তু মেরা!!!
যাব ম্যায় বাদল বান জাউয়ু,
তুম ভী বারিশ বান জানা
জো কাম পার জায়ে শ্বাসে,
তু মেরে দিল বান জানা,,,,
কৃতজ্ঞতা- জনাব ছাইরাছ হেলাল।
ছবি- নেটের
১৪টি মন্তব্য
রিতু জাহান
হাজিরা দিলাম। আসতিছি, কারেন্ট মামুর সাথে বোঝাপড়া করে
রোকসানা খন্দকার রুকু
বোঝাপড়া করোনা দূরত্বেই ভালো। হাতাহাতিতে আবার তিনি নাও ছাড়তে পারেন🤭🤭
রিতু জাহান
আবার গেছে,, রাত কাটবে কেমনে?
ধুর! ভাল্লাগে না। সাইপ্রাস যামু গা
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা হা🤭
ছাইরাছ হেলাল
অসহ্য সুন্দর অবশ্যই সহনীয় নয়।
অসংখ্য হিংসা শেষে শেষটায় এসে লেখাটি উতরে গেছে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সকল কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি। মাঝে মাঝে বলে দিলে লেখা যায় আরকি! শুভ কামনা 🌹
রিতু জাহান
সত্যিই তাই,, আর কাউকে ঠিক বলা হয় না স্বামী ছাড়া, তোমাকে ছাড়া একমুহূর্ত থাকা দায়,,
তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।
দারুন,, দারুন
রোকসানা খন্দকার রুকু
কৃতজ্ঞতা অশেষ রিতু🌹
বোরহানুল ইসলাম লিটন
সুন্দর সমাপ্তি!
সংসারের খেলা
এমনই বুঝি বা মেঘের ভেলা,
কখনো ছড়ায় বর্ণিল ছটা কখনো কর্কশে হেলা।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কৃতজ্ঞতা অশেষ ভাই 🌹
হালিমা আক্তার
অবশেষে নবাবু ফিরলেন। সব মান অভিমান চুকায় গেল। বিরহ নয়, এমনি মিলনের সুখে মুখরিত হোক পৃথিবী। শুভ কামনা রইলো। শুভ রাত্রি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার জন্যও শুভকামনা আপা। অনেক ভালো থাকুন।
সাবিনা ইয়াসমিন
কেউ কেউ সারাজীবন দাসত্ব করে সেটাকেই ভালোবাসা ভেবে জীবন পার করে দেয়। ভুলটা ধরার আগে, বুঝে নেবার আগেই কারো কারো দাম্পত্য চুকে যায়। গল্পের মতো সমাপ্তি দিতে পারলে অনেক সংসার বেঁচে যেতো।
ভালো লেগেছে। গল্পটা নেয়া যায়।
শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার অশেষ মেহেরবানী।🥰🥰
এত্তগুলা কৃতজ্ঞতা আমার গল্প রাখবার জন্য।।।
শুভ সকাল।।।