আমাদের বীর
মাঠে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ধাক্কা এখনো কাটেনি। ড্রেসিং রুমে বেশ থমথমে আবহাওয়া। দলের খেলোয়াড়ের সাথে টিম ম্যানেজার উত্তপ্ত গলায় কথা বলছেন। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী একজন তরুণ খেলোয়াড়। সাথেসাথে শোরগোল থেমে গেল।
গতমাসে আঠারোতে পা দেওয়া এই তরুণ আজকের ঘটনার নায়ক। টিম ম্যানেজার নড়েচড়ে বসলেন, ইশারায় বসতে বললেন। তরুণ এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তরুণের চেহারায় অসাধারণ একটা দীপ্তি; কিছুক্ষণ বিহ্বল তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন ম্যানেজার। দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের দিকে তাকিয়ে উর্দুতে বললেন- ‘আজকের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন। আমি নতুন করে কিছু বলতে চাচ্ছি না।’

সবাই খানিকটা উত্তেজিত, প্রত্যেকের দৃষ্টি তরুণ খেলোয়াড়ের দিকে। টিম ম্যানেজার একবার সবার দিকে নজর বুলিয়ে নিলেন, তরুণকে বললেন- ‘রকিবুল, তোমার বক্তব্য কী?’
-‘আমি আজ যেটা করেছি, সেটাই আমার বক্তব্য!’ তরুণের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।
-‘এর পরিণতি কী হতে পারে তুমি জানো?’
রকিবুল সরাসরি ম্যানেজারের দিকে তাকালেন, বললেন- ‘জানি!’
ডান দিকে বসেছিলেন দলের অন্যতম খেলোয়াড় জহির আব্বাস, বললেন- ‘তুমি ব্যাটে যেটা লাগিয়েছিলে সেটা আসলে কী?’
-‘স্টীকার।’
-‘কিসের? একটু দেখাও তো।’
রকিবুল ব্যাটটা দেখালেন, সেখানে স্পষ্ট বাংলায় লেখা ‘জয় বাংলা’!
জহির মজা পেলেন মনে হল। সামনের দিকে ঝুকে এলেন, ‘এটা তোমাদের ভাষায় লেখা, তাই না? কী লেখা এখানে?’
রকিবুল বাংলায় পড়ে শোনালেন।
উল্টোদিকে বসা ছিলেন সাঈদ আহমেদ, ইনি সিনিয়র খেলোয়াড়। উঠে এলেন, রকিবুলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন- ‘এই কথাটার মানে আমি জানি। কিন্তু এর জন্যে তোমাকে অবশ্যই সাজা পেতে হবে।’
সাঈদ আহমেদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। একে একে সবাই চলে গেলেও স্থির বসে রইলেন দলের একমাত্র বাঙালি খেলোয়াড় রকিবুল হাসান। তাঁর মুখে একই সাথে খেলা করে যেতে লাগলো আশু শাস্তির ভয় আর প্রদীপ্ত দেশপ্রেম।

এই ঘটনার সময়কাল ‘৭১। ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ তারিখ। ঢাকা স্টেডিয়ামে টেস্ট ম্যাচে মুখোমুখি কমনওয়েলথ একাদশ এবং পাকিস্তান একাদশ। পাকিস্তান একাদশের হয়ে খেলছেন রকিবুল হাসান; দলের এগারোজন খেলোয়াড়ের মধ্যে তিনিই একমাত্র বাঙালি। রকিবুল মাঠে নামার আগে সতীর্থ খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছেন পাকিস্তানের তলোয়ারের ছবি আঁকা ব্যাট হাতে। দুঃসাহসী রকিবুল অসাধারণ একটা কাজ করে ফেললেন। ব্যাটের তলোয়ারের ছবির জায়গায় জয় বাংলার একটা স্টীকার লাগালেন।

নিজেদের মাঠ, গ্যালারীরে সিংহভাগ বাঙালি দর্শক। দরাজ বুকে অসীম দেশপ্রেম নিয়ে মাঠে পা ফেললেন রকিবুল। দর্শকদের মধ্যে হঠাৎ যেন জোয়ার বয়ে গেল। মুহুর্মুহু করতালিতে ঢাকার আকাশ মুখর হয়ে উঠলো। রকিবুল তাঁর ব্যাট উচিয়ে ধরলেন। পুরো স্টেডিয়াম এবার ফেটে পড়লো। জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা! রকিবুল ভুলে গেলেন পাকিস্তানি হায়েনারা নখর বসাতে মুখিয়ে আছে!

এরপর যা হওয়ার কথা, তাই হল। রকিবুলের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা হল, ওয়ারেন্ট জারি হল। এই বোঝা তাঁকে বয়ে বেড়াতে হল মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টা মাস।

আমাদের বেজন্মা
সেই পাকিস্তান, পাকিস্তানের ক্রিকেট দল আজ (৩০ নভেম্বর, ২০১২) খেলছে। ফেইসবুকে জনৈকা তৃষা খানম স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘pray for pakistan’; যে বাংলায় রকিবুল জন্মেছেন, সেই বাংলাতেই নুন খেয়ে বড় হয়েছে এইসব বেজন্মা তৃষা খানমেরা। পাকিস্তানি বীর্য বয়ে বেড়ানো এই বেজন্মারা স্টেডিয়ামে দু’হাত উচু করে প্ল্যাকার্ড ধরে থাকে, শরীর দুলিয়ে নাচতে থাকে। প্ল্যাকার্ডে লেখা জ্বলজ্বল করে, ‘Marry me Afridi!’

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ