
গান শুনছি-
ইয়ে নাজার ভি আজিব থী,
ইছে দেখে থে মানজার সাবি
দেখকে তুঝে ইক দাফা,
ফির কিছি কো না দেখা কাভি
মেরা পেহলা জুনুন, তু মেরা পেহলা জুনুন, ইশক আখরি হ্যায় তু,,,,,,
কিছু কিছু গানের কথা এত মধুর যে শুনতেই ইচ্ছে করে। মন খারাপ থাকলে আরও ভালো লাগে। সকাল থেকে অনেকবার শোনা হয়ে গেল। বয়সের সাথে সাথে নাকি গানের টেস্টও বদলে যায়। আমার কাছে তা মনে হয় না। কথা ও সুর সুন্দর হলে গান শোনার আসলে কোন বয়স নেই।
আজ আমাদের ছুটির দিন। বৃষ্টি মাখা সকাল। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। যদিও অনেকদিন ধরে আকাশ তার জলের থালা উপুর করে দিয়েছে তবুও শীত আর বৃষ্টি আমার কখনোই বিরক্ত লাগে না।
‘নবাবু’ আমার মেয়ের বাবা ‘শুভসকাল’ দিয়ে আধবোজা চোখে বাচ্চাদের মতো টলতে টলতে ওয়াশরুমে গেলেন। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না কাল রাতে আমাদের এতো বড় ধরনের একটা কনট্রাক্ট সাইন হয়ে গেছে। আমাকে দেখেও মনে হচ্ছে না কারণ আমিও রীতিমতো মেয়ের বাবার পছন্দের কালারের শাড়ি পরেছি।
আমি জানি এ মানুষটা এখুনি বের হয়ে ধোয়া তোলা চিনি, দুধে পারফেক্ট কফি চাইবে। তার বয়স যতো বাড়ছে ততো তিনি ঢঙগী আর আবদারী হচ্ছেন। যেমন- ছুটির দিনে আমাকে শাড়ি পরতে হবে, করল্লার জুস খাওয়ানোর সময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থাকতে হবে আরও আছে বলছি সেসব।
তবে তাকে যে আমি ‘নবাবু’ ডাকি এটা মনে মনে, সে জানলে ঢঙ্গে আরও বেহুস হয়ে যাবে। আর অন্য কারণ হলো এ বয়সে ‘জীবন’ নামে ডাকাটা কেমন যেন অশোভন লাগে। বিশেষ করে ডাকলেই মেয়ে শয়তানী মিচকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে তখন রীতিমতো আমার মাথা কাটা যাবার জোগার। আর ‘সারোয়ার’ নামটা অনেক বড়। ডাকা যায় না।
পুরুষের মন নাকি পেট থেকে শুরু হয় তাই অধিকাংশ সময়ই রান্না আমি করি। আজ মেয়েটাকে ছুটি দিয়েছি। মাসে আমার ছুটির দিনগুলোতে ওকে ছুটি দিয়ে দেই কারণ ছুটি পাওয়া তার অধিকার। ওরও সংসার আছে, তাদের সময় দেবে, একটু ভালোমন্দ রান্না করে খাবে।
– নাহিদ, আজ কি রান্না? ও, পাপদা মাছের টলটলে ঝোল, চিকেন দোপেয়াজা আর করল্লা ভাপা সাথে লাল আটার রুটি। আমি এসব মোটেও খাবো না। আর কি দরকার ছিল তোমার এতো কষ্ট করার? আমরা দুজনে বৈশাখীতে গিয়ে খিচুরী আর গরুর লটপটি খেতাম!
– তোমার ডায়াবেটিস কতো মনে আছে? এমনিতেই চিনি খাও। ওসব খাওয়া যাবে না।
– তো,কি খাওয়া যাবে? নবাবু দুষ্ট হাসিতে এগিয়ে এলো।
– উহুম, সাতসকালে শুধু কফি!
মানুষটাকে আমি অদ্যপান্ত পড়তে পারি। তাকে যতোটা ভালোবাসি, তার চেয়ে বেশি খেয়াল রাখি তার সুস্বাস্থ্যের। এতোটা কেয়ারে সে মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হয়। তবুও আমি সেটাই করি। আমার কাছে তার বেঁচে থাকা জরুরী। কথা বলা মানুষটাকে আমার ভীষন জরুরী।
এবার আমার গান শুনে মেয়ের বাবা মন্তব্য করলেন- এতো যে রোমান্টিক গান শোনো, তবুও তো তোমার কোন উন্নতি হয় না। সাতসকালে হিন্দি গান না শুনে বাংলা শুনবা ‘ তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন। দুজন দুজনার কতো যে আপন,,,, আমিও থাকলাম গানও হলো। কি বলো?
আমি হাসলাম। মানে আমার সবটাতে তাকেই রাখতে হবে! আর রোমান্টিসিজম যে কি, কাকে বলে আমরা অনেকেই বুঝি না। আর ‘নবাবুর’ রোমান্টিকতা হলো বুড়ো বয়সের ভিমরতি।
কথার ফাঁকে ‘নবাবু’ কোমরে হাত গলিয়ে ফেলেছেন। পেট থেকে এখন তার হাত এদিক সেদিক যাবে! দিনে দিনে মানুষটা শরীর ছোঁয়ার বাহানা খোঁজে কেন বুঝি না! মেয়ে ভার্সিটিতে যাবার পর তার এসব সমস্যা আরও বেড়েছে।যার জন্য সারাখ্খন আমাকে ভয়ে সিটকে থাকতে হয়। তার সাথে খিটমিট লেগেই থাকে।
তো, বিদ্যা বালান হলে হয়তো গলতে শুরু করতেন। আমি অতোটা রোমান্টিক না। আমার চিন্তা রুটি পুড়ে যাবে? পোড়া রুটি খেলে তাহার এসিডিটি হবে। অতিরিক্ত তেল চর্বি খেয়ে খেয়ে অলরেডি তিনি ডায়াবেটিস বাঁধিয়ে ফেলেছেন। এজন্য তাকে করল্লার জুস খাওয়াতে হয়।
বেলুন হাতে নিতেই তিনি পালালেন। বয়স তার বায়ান্ন। দেখে বোঝার উপায় নেই। লম্বা পাচঁ দশ, বাদামী ফরসা মানুষটা দিনে দিনে কেমন যেন বয়স কমে গ্লেজি হচ্ছেন।
পুরুষের পঞ্চাশের পর আবার যৌবন ফিরে আসে। বিয়ের প্রথম প্রথম যেরকম শরীর ছোক ছোক করে তেমনি একটা অবস্থা হয়। এদিকে বউ এর বয়স হয়ে যাওযায় তার শরীর ছোঁয়া ব্যাপারটা অতো ভালো লাগে না। যে সব পুরুষের সহনশীলতা কম এ সময়ই তারা দ্বিতীয়বার ভুল করে ফেলে। কেউ অল্পবয়সী কাউকে বিয়ে করে, কেউ পরকীয়া করে, কেউ পতিতালয় যায়।
আমার মেয়ের বাবার চলছে এই কঠিন সময়। আমি তাকে সামলাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছি। মেয়েটা থাকলে হয়তো কিছুটা কন্ট্রোল হতো। তিনি আবার বাসা থেকে ভার্সিটি করতে নারাজ তাই হোস্টেলে থাকেন।
সামনের মাসে মেয়ের বাবা টুরে যাবেন। আমি একা হয়ে যাবো। বিরক্ত করারও কেউ থাকবে না এটা ভাবতে খারাপ লাগছে। আবার গিয়ে করবোই বা কি? আর এসব জায়গায় আমি ঠিকঠাক না। সবার সাথে সহজ হওয়া, সাজুগুজু করা এসব আমার হয় না। আমি সাধারন জীবন যাপন পছন্দ করি।
বেশ ক’বছর আগের ঘটনা মনে পড়লো-
মেয়ের বাবার অফিসের সবাই পিকনিক এরেন্জ করেছে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হলো জম্পেস সাজগোজ করে যেতে হবে। জয়া আমার কলিগ কিন্তু তার ছোটবোনের মতো। জয়ার সাথে গেলাম পার্লারে চকচকে হতে। তিনঘণ্টা ধরে প্রায় লেংটো করে হাতে, পায়ে, মুখে চললো কঠিন ঢলাঢলি।
মনে হল,বাহ্! ঘুমানোর জন্য ইহা দারুন ম্যাসেজ! আমি ঘুম ভালোমতো দিয়ে উঠে দেখি আমার শ্যামলা বদনে বেশ একখানা গ্লেজ এসেছে।
খুশি মনে মাথার পেছনে তাকালাম- আল্লাগো আমার ইকরি মিকরি চামচিকরি চুল গেল কই? এই জয়া, জয়া।
জয়া সমস্ত শিখিয়ে দিয়ে উধাও হয়েছে। অবশ্য তার তেমন দোষ ছিল না। মেয়ের বাবা আগেই তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। যে কোন মূল্যে আমাকে মোমসুন্দরী বানাতেই হবে।
প্রেমের সময় আমার এই আধা বয়কাট তার ভীষণ পছন্দ ছিল। তাই বলে এখন? আমি রীতিমতো পঁয়ত্রিশ পার হওয়া একজন মা, একজন মহিলা।
কোনমতে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে হিজাব কিনে বাসায় ফিরলাম। মেয়ের বাবা সে রাতে আর বাসায় ফেরেননি। আমারও আর পিকনিকে যাওয়া হয়নি। তার কলিগদের বউদের ময়দামাখা ছবিতে ফেসবুক ভেসে গিয়েছিল।
আর জয়া, বহুদিন তাকেও কলেজে খুঁজে পাইনি। আমাকে দুরে দেখেই সে উধাও হয়। তখন থেকেই নবাবুর স্টাইলিস্ট বউ এর বদলে হিজাবী খালাম্মা বউ। হিজাবী বউ পেয়ে আমার ‘নবাবুর’ অনেকদিন খুউব মন খুব খারাপ ছিল। আমারও মন খারাপ লাগে আমি কেন চাইলেও তার মতো হতে পারি না।।।
,,,,,পরের পর্বে সমাপ্ত। আপাতত গান শুনুন-
ছবি- নেটের।
৮টি মন্তব্য
খাদিজাতুল কুবরা
দারুণ গল্প লিখেছ। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা। আহা সংসার, দাম্পত্য! হাতা খুন্তি, পিঁড়ি, বেলুন, হাঁড়ি পাতিলের ঠনাঠন তবুও মধুর!
রোকসানা খন্দকার রুকু
গান শোননি?? হেডফোন দিয়ে শুনতে হবে!!
আর গল্প পরের পর্বও আছে!!! নবাবু মালয়েশিয়া যাবে, ফিরবে তারপর।।।সাথেই থাকো।।।
হালিমা আক্তার
সৈয়দ মুজতবা আলীর শিষ্য। হাসতে হাসতে শেষ। রম্য হলে ও বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। একদিন এক পার্লারে এক ভদ্র মহিলাকে দেখেছিলাম। মেয়ে বিয়ে দিয়ে সে তখন শাশুড়ি। ময়দা মাখা হলেও ভালো ছিল, তার চেয়েও বেশি কিছু।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
গানটা সুন্দর। হেড ফোন দিয়ে শুনলাম। যদিও হিন্দি বুঝিনা। শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
এতো বড় কমপ্লিমেন্ট আশা করিনি। কমেন্ট লেখার নব্বইভাগ উৎসাহ যোগায়। আর আপনার কমেন্ট ১০০ ভাগ।
গান শুনতে শুনতে বুঝে যাবেন।
পাশে থাকুন আর অনেক ভালো থাকুন আপা।
রেজওয়ানা কবির
অনেকদিনপর তোমার লেখা পড়লাম। রম্যের মাঝেই আগলে রাখার অনুভূতি লুকিয়ে রয়েছে। কেউ কারো মতো হলেই যে ভালোবাসা বেশি তা নয় একেকজনের প্রকাশ একেকরকম বুঝে নেয়াটাই খুব কঠিন। ভালো লিখেছো,শুভকামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
রেজওয়ানা কবির ফিরছে এটা দেখেও আনন্দ লাগছে।।।জীবনের কোনকিছুই ফেলনা নয়, শিক্ষা সবখানেই।।।শুভকামনা অনেক অনেক।।।
ছাইরাছ হেলাল
গান শুনতে শুনতে পড়ছিলাম, পরের পর্ব দেখে থমকে গেলাম,
অপেক্ষায় রাখলেন!
গল্পের গল্প সুন্দর হইছে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আসলে গান শুনতে শুনতেই পড়তে হবে।।।
লেখা যেমনই হোক গানের কারনেই সুন্দর লাগবে।।।আমিও আপনার কমেন্টের অপেক্ষায় ছিলাম। কৃতজ্ঞতা অশেষ।।।