মাস্কটের সিক্সথ ফ্লোরের নোকিয়া কেয়ারে ওকে পেয়ে আমিতো অবাক ! কখনো
দেখা হতে পারে আমাদের, কিংবা হবে কখনো, এ ছিলো কল্পনার অতীত ।
ভেবেছিলাম এড়িয়ে যাবে । যায়নি, অবাক করে এগিয়ে এসে বললো,
আরে, তুমি যে এখানে ! কেমন আছো ? কোথায় আছো ? প্রশ্ন অনেকগুলো !

আট বছর পাঁচ মাস পর পুনর্বার আমাদের দেখা-হাঁটা, পাশাপাশি । ওর হাজব্যান্ড
নামিয়ে গেছে ওকে । অফিসিয়াল জরুরি কী এক কাজ সেরে তুলে নেবে, জানালো ।
খানিক আলাপচারিতার ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে মুখ ফুটে বললাম, মিনিট পাঁচেক দূরত্বেই
থাকি । চাইলে চলো । ওখানেই গল্প করা যাবে খানিকক্ষণ-, দেখেও আসলে
কেমন থাকি, কোথায় থাকি, এসবই আরকি । চাইলো না, খানিকবাদে কী যেন
খানিক ভেবে বললো, -আচ্ছা, চলো । ঠিক একটায় পৌঁছে দেবে কিন্তু এখানটায় !

বেডরুমটায় বসেই ওর অনুসন্ধিৎসু চোখ ঘুরে ঘুরে দেখছিলো সব । দেখছিলো
দেয়ালে টাঙ্গানো ক্লোজআপ ছবিটা আমাদের । তোলা প্রথম বিয়ে বার্ষিকীতে ।
আমার ওর । দেখছিলো, নিজের হাতে সাজিয়ে যাওয়া ফার্নিচা্র গুলো । মুখোমুখি
বসে ছিলাম । আলতো পায়ে হেঁটে কাছে গিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকালো খানিকক্ষন ।
তাকালো, যেভাবে তাকাতো আমাতে । বসে ছিলাম, পাশে গিয়ে মৃদু হেসেই
বললাম, এই সেই ব্যাস্ততা । অনেকটা দিন যত্ন-টত্ন নেয়া হয়নি তেমন । ময়লা
জমেছে, কিছুটা স্পটও। খানিকটা ঝাড়-মোছ করলেই ব্যাস আগের মতই চকচকে ।
শুনে চুপ ছিলো কিছুটা সময় । চোখ থেকে চশমাটা খুলে তারপর তাকালো আমার
দিকে । তাকিয়ে ছিলো খানিকটা সময়ই । আগ বাড়িয়ে তাই জানতে চাইলাম, কী
দেখছো অমন করে ? কিচ্ছুটি বললো না, অবাক করে দিয়ে জানতে চাইলো শুধু, আচ্ছা,
বিয়ে-থা করলেনা কেনো আর ? শুনে ভেতরে কেমন যেন খানিকটা মোচর দিলো ।
বেরুতে চাইলো হৃদয় চিরে জন্মাধিক দীর্ঘ মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস কোনো। কিছু বুঝতে না
দিয়েই হাসিমুখে বললাম ওকে, কিছু ব্যাপার বোধহয় একবারই ভালো, কিছু বোধহয়
আর না হওয়াই ! আবেগটা আড়াল থেকেও বুঝি নাড়া দেয় ! বুঝতে পারি বেশটাই ।
তাকাতেই দেখি, চোখে-মুখে ওর বর্ষা মেঘের ছায়া পড়েছে । প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলি তাই,
তোমার প্রিয় রং চা আমারো বেশ প্রিয় এখন । এখানটায় বসো, খানিকক্ষণ, বানিয়ে আনছি ।

ওর প্রিয় রং চা । আমার তেমনটা পছন্দ ছিলো না । ওর সাথে খেতাম । তিন-চারবার দিনে।
কবেযে প্রিয় হয়ে গেলো আমারও ! চুমুক দিতে গিয়ে কথাচ্ছলে জানতে চাইলাম, খানিকটা অজান্তেই,
আচ্ছা ছেলে মেয়ে হলো কী তোমার ? খানিকক্ষণ চুপ হয়ে ছিলো । অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছিলাম আমিও,
ধ্যাত বলে ফেললাম কী ! এরপর হলো যেটা, কল্পনাতে ছিলোনা, ছিলোনা স্বপ্নেও । ডান হাতে
আলতো স্পর্শ করে ডান হাতটা আমার মলিন মুখে বললো, আমরাতো দু’জন দু’প্রান্তে চলে যাচ্ছি ।
যাব খানিক পরেই । আকাশের মতই শান্ত ও নিরুপদ্রব বয়ে যাবে জীবন । দেখা হবেনা, হবেনা
বোধহয় কখনোই । তাই যদি সম্ভব হয়, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমায় । আমি বুঝিনি । বুঝতে
চাইওনি ! খানিক থেমে থেমে বলছিলো । বললো, ব্রিটেন থেকেও ডাক্তার বলেছে । প্রবলেম আমারই ।
বলতে গিয়ে ওর চোখ বার বার ছল ছল করছিলো অশ্রুতে, উঠছিলো বারবার ! কেবলই তখন মনে
হচ্ছিলো, আহ এতই কেনো বিচিত্র জীবন, কেনো এতই ! যার জন্য ফ্যামিলির পীড়াপীড়িতে পড়ে
আমাকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করলো সুদূরের ব্রিটেনে । কী পেলো ও আমাকে ছেড়ে গিয়ে, আর আমিইবা ?

ঘড়ির কাঁটাটা তখন প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই । তাই বলতেই হলো ওকে, সময়তো প্রায় শেষ হয়ে আসছে, চলো
উঠি । তখন, ওর অনুসন্ধিৎসু চোখ যেন শেষবারের মত দেখে নিতে চাইলো পুরো বেড রুমটা আমার, দেখে
নিচ্ছিলো যেন । শেষটায় এসে যেন আঁটকে রইল দেয়ালে টাঙ্গানো আমাদের ক্লোজআপ ছবিটায়, আমাদের
যুগলবন্দীতে শেষবার । পুরো রিক্সায় আমার সাথে কোনো কথা বলেনি ও, বলেনি একবারও আর । কেবল
রিক্সাটা মাস্কটের সামনে পৌঁছুলে, হাত নেড়ে বিদায় জানালো শেষবার । আমিও হাত নাড়লাম । ও চলে যেতেই
চোখে বারবার ভেসে উঠছিলো দেয়ালে টাঙ্গানো আমাদের ক্লোজআপ ছবিটা, কেবলই ক্লোজআপ ছবিটা আমাদের!

0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ