পৃথিবীতে যত প্রাণীকূল আছে তার মধ্য সম্ভবত কুকুরই হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রভূ ভক্ত প্রাণী। সেই আদি কাল থেকে মানুষের সঙ্গে কুকুরের সখ্যতা এবং আজ অবদি তা বিদ্যমান। কুকুর নিয়ে প্রেম বিরহের নানান চিত্র আমরা পত্রিকার পাতায় পড়েছি। তার কয়েকটি চিত্র আমি তুলে ধরলাম।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে লন্ডনের সংবাদ পত্রে ফলাও করে প্রকাশ করে এই ঘটনাটি। লন্ডনের বাসিন্দা রবার্ট মার্টিন পেশায় টেলিভিশন মিস্ত্রী। একটি বাড়ীতে গিয়ে তিনি টেলিভিশন মেরামত করার সময় ঐ বাড়ীর একটা বেয়াড়া কুকুর তাকে বারবার বিরক্ত করছিলো, এক পর্যায়ে তিনি অসহ্য হয়ে কুকুরের কান কামড়ে দেন। কুকুরটিও তাকে ছেড়ে কথা বলেনি, সেও মার্টিনের নাকে খুব কষে একটা কামড়ে দেয়। এতে মার্টিন রাগে আগুন হয়ে ছুটে বাড়ী থেকে গুলি ভর্তি রাইফেল নিয়ে এসে কুকুরটিকে মারতে উদ্যত হন। কিন্তু কুকুরের মালিক কুকুরটিকে বের করে দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মার্টিন কুকুর ছেড়ে মালিকের প্রতি রাইফেলের নল ধরেন। ঐ সময় একজন পুলিশ ঘটনা স্থলে এসে মার্টিনের হাত থেকে রাইফেল উদ্ধার করে কুকুর মালিককে প্রাণে বাঁচান। ঘটনা শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত মার্টিনকে কুকুর কামড়ানোর অপরাধে তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন।

১৯৭৭ সালের অক্টোবরের শেষ অথবা নভেম্বরের প্রথম দিকে বার্মাতে কুকুরের সম্মানে একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। “হান খাওয়াদ্দি” নামে রেঙ্গুনের একটি পত্রিকার পাতায় স্থান পাওয়া ঘটনাটি বিষয় বস্তু ছিলো, একটি কুকুর আপার বার্মার একটি বৌদ্ধ মঠে দীর্ঘ দিন থেকে বসবাস করে আসছিলো। ১২ বছর বয়সী কুকুর বার্ধক্যের ভার সইতে না পেরে মৃত্যু বরণ করলে উক্ত মঠের মোহান্ত বৌদ্ধ ধর্মানুসারে এই “অসাধারণ” কুকুরটিকে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেন। কুকুরটির মৃতদেহ বিশেষ ভাবে নির্মিত একটি কাঠের কফিনে স্থাপন করার পর কুকুরের বয়স অনুসারে ১২ জন বৌদ্ধভিক্ষু উক্ত কুকুরের মরদেহের শান্তির জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠ করেন। কুকুরটিকে সমাধীস্থ করার জন্য পূর্ণ মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মিছিল সহকারে কফিন গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ৫০০ লোকের উপস্থিতিতে কুকুরের প্রতি তাঁরা শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে কুকুর বিষয়ক আরেকটি ঘটনা এরকম, ফান্সের প্যারিসে এক ভদ্র লোক তাঁর পাশের বাড়ীর জনৈক মহিলার একটি কুকুরকে গাড়ী চাপা দিলে কুকুরটি মারা যায়। মহিলা তাঁর প্রিয় কুকুরের এই মর্মান্তিক মৃত্যুকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মাথায় খুন চাপে। মহিলা ঐ ভদ্র লোককে তাঁর ঘরের দরজাতেই শর্ট গানের গুলিতে হত্যা করেন। কুকুরের জন্য তার দরদ যে কত গভীর তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে উত্তর ইংল্যান্ডের বাসলিতে একটি পার্কে কুকুর নিয়ে বেড়ানোর জন্য জনৈক হারবার্ট জনসকে আদালত জরিমানা করে। তিনি জরিমানার অর্থ দিতে অস্বীকার করায় আদালত তাঁকে কারাবাসের নির্দেশ দেয়। মিঃ হারবার্ট বলেন, আমার প্রিয় কুকুরের জন্য আমি জরিমানা দেবোনা, এর চেয়ে বরং আমি ৫ দিন জেল খেটে আসব। মিঃ হারবার্ট তাই করেন কিন্তু জরিমানা দেননি।

কুকুর প্রেমে মত্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়। ফ্রান্সের আন্দ্রে বেসিন নামক এক ব্যক্তি প্রিন্স নামের এক কুকুর পোষতেন। প্রাণ প্রিয় কুকুরটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করান। তারপর কুকুরটি সেরে উঠে, কিছুদিন পরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে সেবার আর রক্ষা পায়নি কুকুরটি। প্রিন্স নামের এই কুকুরের মৃত্যু সহ্য করতে পারেননি আন্দ্রে বেসিন। প্রিন্সের বিয়োগে তিনি নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলান। একটি চিরকুটে লিখে যান “প্রিন্স বেঁচে নেই, আমিও নেই”।

এবার স্বদেশের একটি খবর দিয়ে কুকুর বিষয়ক সংবাদের ইতি টানবো। ১৯৭৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি কুকুরের জন্য শোক দিবস পালন করা হয়। এ উপলক্ষে ঐদিন স্কুলের নিয়মিত বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়। তৎকালীন সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বব নামের কুকুরটিকে কে বা কারা হাত পা বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। ববের অকাল মৃত্যুতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, অন্যান্ন শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে শোকের ছায়া নামে। কুকুরটি দীর্ঘ দিন থেকে রাতে স্কুল পাহারা দিত এবং দিনের অধিকাংশ সময় প্রধান শিক্ষকের পায়ের কাছে বসে থাকতো।

কুকুর বিষয়ক সংবাদ থেকে চোখ সরিয়ে এবার আসুন আমাদের দেশের ফুটপাতে চোখটা স্থাপন করি। স্ট্রিট লাইটের হলদে আলোয় নিজের ছায়াকে একটু ভালো মত পরখ করে স্মৃতিতে ধারণ করি, তারপর ফুটপাতের ধূলো মাখা এক চিলতে জায়গাতে ঠাঁই নেয়া মানুষের কোন একজনকে আবার স্ট্রিট লাইটের আলোতে ফেলি, একটু ব্যবধান বের করার চেষ্টা করি তাঁর আর আমার মধ্যে। না কোন ব্যবধান নেই, আমার মতো তাঁরও দুটো হাত, দুটো পা, একটি মাথা, কোন অমিল খুজে পাইনি। আমারই সহজাতক অথচ তাঁরা সহায় সম্বলহীন হয়ে ফুটপাতে আশ্রিত। আসন্ন ভয়াভহ শীতে আমরা যখন লেপ বা কম্বলের ঊষ্ণ তাপে যখন সুখ নিদ্রায় নাক ডাকাবো তখন হয়তো তাঁরা শীতের তীব্রতায় কূঁকড়ানো শরীর নিয়ে আর্তনাত করবে। সূর্য্যের আহ্ববানে হয়তো রাতটা পার করে দিবে কিন্তু সকালের সূর্য্যের নরম আলো পেটের ক্ষুধা নিভাতে পারেনা। বিত্তশালীরা হর্ষ চিত্তে যখন প্রিয় কুকুরকে পাশে রেখে নরম রুটিতে মাখন লাগিয়ে সকালের নাস্তায় ব্যস্ত তখন যদি ঐ না খাওয়া ফুটপাতের বাসিন্দাটি তাঁর দ্বারস্থ হয় কুকুরের মুখ থেকে খসে পড়া এঁটো খাবারের আশায়, তখন ঐ বিত্তশালীরা চিত্তকে কিঞ্চিত সংকুচিত করে তাকে দূর দূর তাড়িয়ে দেন। গুলশান, বারিধারায় ক্যানাল ক্লাব খুলে প্রিয় কুকুরকে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠেন আর গেটে ঝুলিয়ে দেন কুকুর হইতে সাবধান। এই সাবধান বাণী ফুতপাতের ঐ হাত পেতে খাওয়া লোকদের জন্য যার অর্থ হলো আমার প্রিয় কুকুরের পাতে ভাগ বসাতে এসোনা। শূন্য হাতে ফিরে যাওয়া ঐ লোকটি হয়তো কুকুরের মোলায়েম মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ধ্বিক্কার দেয় আর নিজের কাছেই প্রশ্ন করে আমরা কি কুকুরের চাইতেও অধম ? কুকুর হয়ে জন্মালে হয়তো একটু সুখের পরশে পৃথিবীর নির্ধারিত সময়টা পাড়ি দেয়া যেত।

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১০ই ডিসেম্বর ২০০৯ ইংরেজী

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ