আনিকার কবুতর

আমির ইশতিয়াক ৪ জানুয়ারি ২০১৬, সোমবার, ০৪:৪৯:৫১অপরাহ্ন গল্প ৪ মন্তব্য

সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আনিকা। তার পুরো নাম আফরিন সুলতানা আনিকা। আব্বু-আম্মু আদর করে ডাকে আনিকা। এই বয়সেই পোষা প্রাণীর প্রতি তার অনেক দরদ। এইতো কিছু দিন আগে আনিকার আব্বু তার নামে আকিকা দেয়ার জন্য একটি খাসী কিনে আনলেন। খাসী দেখে আনিকা খুব খুশি হয়। এই খাসী সে পালবে। কিছুতেই এই খাসী জবেহ করতে দিবে না। রাতে ঘুমানোর আগে আনিকা তার আব্বুকে বলছে, আব্বু আমার খাসী তুমি জবেহ করবে না। আমি তাকে জবেহ দিব না। যদি তুমি জবেহ কর তাহলে কিন্তু আমি খুব কান্না করব।
মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আনিকার আব্বু ইশতিয়াক আহমেদ বললো, ঠিক আছে আম্মু। এখন ঘুমাও।
আনিকা ঘুম থেকে উঠার আগেই খাসীটি আল্লাহর রাস্তায় জবেহ করে দেয়া হল। সকাল বেলা আনিকা ঘুম থেকে উঠে খাসীর মাংস কাটতে দেখে সেকি কান্না! কাঁদো কাঁদো স্বরে আব্বুকে বললো, আব্বু তুমি আমার কথা রাখনি। তোমার সাথে আড়ি।
তারপর থেকে আনিকা সারাদিন তার আব্বুর সাথে কথা বলেনি।
কিছুদিন পরই আসল কোরবানির ঈদ। আনিকা তার আব্বু-আম্মুর সাথে ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে গেল। তার দাদা ভাই বড় একটি গরু আনলেন কোরবানি দেয়ার জন্য। আনিকা গরু দেখেতো খুব খুশি। সে তখন দাদা ভাইকে বলছে, দাদা ভাই, এই দাদা ভাই!
আনিকার দাদা শরীফ আহমেদ বললেন, কি দিদি ভাই কিছু বলবে?
আনিকা মাথা ঝাকিয়ে বললো, হ্যাঁ।
– বল কি বলবে?
– দাদা ভাই এই গরুটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এটা পালবো।
– এটা পালার জন্য আনিনি দিদি ভাই। এটা ঈদের দিন কোরবানি দিব।
– কোরবানি কি দাদা ভাই?
– আল্লাহ রাস্তায় জবেহ করব।
– কি বললে! আমি এটা জবেহ করতে দিব না। আমি এটা পালবো। বলেই কান্না করতে লাগল।
নাতনীকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য শরীফ আহমেদ বললেন, কাঁদে না লক্ষ্মী দিদি ভাই। ঠিক আছে তুমিই পালবে। এটা জবেহ করব না।
কিন্তু দাদা ভাইও সেই কথা রাখেনি। ঈদের দিন অন্য ছেলে-মেয়েদের মতো আনিকাও যখন আনন্দ করছে ঠিক সেই মুহূর্তে দাদা ভাই তার প্রিয় গরুটি কোরবানি দিয়ে দিলেন। এই দৃশ্য দেখে তখন আনিকা প্রচ- কেঁদেছে। আনিকা তার দাদুকে বলছে, দুাদু আমার দাদা ভাই আমার কথা রাখেনি। আমার প্রিয় গরু জবেহ করে দিয়েছে। আমি আর তোমাদের বাড়িতে আসব না।
আনিকার প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কেউ বুঝে না। আব্বু যেমন বুঝে না। দাদা-দাদুও বুঝে না। তাই তাদের প্রতি আনিকার রাগ।
আনিকা যেই ঘরে থাকে সেই ঘরের কোণে চড়ুই পাখি বাসা বানাইছে। সেই বাসায় ইতিমধ্যে দুটো ছানা হয়েছে। প্রতিদিন চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দে আনিকার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠেই আনিকা আব্বুকে বলে, এই আব্বু!
আনিকার আব্বু ঘুমের ঘুরে বলে, কি আম্মু। বল কি বলতে চাও।
– আব্বু আমাকে একটি চড়ুই ছানা এনে দাও। আমি পালব।
– চড়ুই ছানা আনলে ছানার মা কান্না করবে।
– কান্না করবে না। আমি ভাত খাওয়াব। চাউল খাওয়াব। গম খাওয়াব।
আনিকার মা ইয়াছমিন তার আব্বুকে বললো, এই শোন না। সে যখন পাখি পালার এত শখ একটি কবুতর এনে দাও না।
– কবুতরতো সে পালতে পারবে না।
– আমি পালব। তুমি একটা খাঁচা ও কবুতর এনে দাও।
– ঠিক আছে তাই করব।
আনিকা এবার খুশি হলো। আব্বুকে গলায় জড়িয়ে ধরে চুমো দিয়ে বললো, তুমি আমার লক্ষ্মী আব্বু।
পরদিন ইশতিয়াক আহমেদ আনিকার জন্য একটি কবুতর ও খাঁচা এনে দিল। কবুতর দেখে আনিকা কত যে খুশি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
সেই থেকে আনিকা কবুতরকে লালন পালন করতে লাগল। আনিকা কবুতরকে খুব আদর করে, ভালোবাসে। তাকে গম, চাউল খাওয়ায়। পানি খাওয়ায়। কখনো কখনো তাকে ধরে চুমো খায় আর বলে, লক্ষ্মীসোনা কাঁদে না। তখন কবুতর বাক-বাকুম করে ডাক দেয়। আনিকা তখন হেসে তার আম্মুকে বলে, দেখ আম্মু আমার কবুতর আমার সাথে কথা বলে।
কবুতর নিয়ে আনিকার ব্যস্ত দিন কাটে। সারাক্ষণই কবুতরের যত্ন করে। একটু চোখের আড়াল করতে চায় না তাকে।
এভাবে যখন আনিকার দিনগুলো ভালোই চলছিল তখন হঠাৎ করে শখের কবুতরের অসুখ হলো। কিযে হলো কবুতরের কেউ বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে খাওয়া বন্ধ করে দিল। কিছুতেই কোন খাবার কবুতরকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। আনিকার আব্বু-আম্মু অনেক চেষ্টা করল। জোর করে হা করিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেগুলোও সে ফেলে দেয়। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ইশতিয়াক আহমেদ। আনিকার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখ মলিন। তার চেহারায় কান্নার ছাপ ভেসে উঠল। আনিকা তার আব্বুকে বলছে, ও আব্বু, আব্বু তুমি আমার কবুতরকে ডাক্তার দেখাও।
আনিকার কথায় ইশতিয়াক আহমেদ পশু ডাক্তারের নিকট গেলেন। ওখান থেকে ঔষধ এনে খাওয়ালেন কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে। এভাবে একদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কবুতর খুবই দুর্বল হয়ে গেল। কবুতর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। হঠাৎ করেই খাঁচার ভেতর শুয়ে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে আনিকা তার আম্মুকে ডাকছে, আম্মু… ও আম্মু… দেখ আমার কবুতর যেন কি করছে।
আনিকার মা দ্রুত কবুতরের খাঁচার কাছে এসে খাঁচা খুলে কবুতরটি হাতে নিলেন। কবুতরটি হাতে নিতেই মরে গেল। এ দৃশ্য দেখে আনিকা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল। তার কান্নায় বাড়ির আশে পাশের লোকজন জমে গেল। একটা বোবা পাখির জন্য ছোট্ট একটি মেয়ে যে এত কাঁদতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগছে প্রতিবেশীদের কাছে।
আনিকার আম্মু মরা কবুতরকে ফেলে দিতে চাইছিল কিন্তু আনিকা দেয়নি। সে এটা তার আব্বুকে দেখাবে।
কিছুক্ষণ পর ইশতিয়াক আহমেদ বাসায় আসলেন। আব্বু আসায় আসতেই আনিকা বলছে, আব্বু, এই আব্বু আমার কবুতর মরে গেছে। বলেই কাঁদতে লাগল।
আব্বু আনিকাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, আম্মু তুমি কেঁদ না। তোমাকে আমি আরেকটি কবুতর এনে দিব।
– না আব্বু। আমাকে এই কবুতর এনে দাও।
– ঠিক আছে। কালই তোমাকে কবুতর এনে দিব।
এই বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে কবুতরটিকে ফেলে দিতে গেলেন কিন্তু আনিকা বলছে, আব্বু তুমি এটা ফেলে দিবে না। এটা কবর দিয়ে দাও। আমার নানা ভাইকে যেভাবে কবর দিয়েছে সেভাবে করব দিয়ে দাও। আমি প্রতিদিন আমার কবুতরের করব দেখব।
আদরের মেয়ে আনিকার কথামতো ইশতিয়াক আহমেদ সত্যিই কবুতরটিকে তার বাড়ির সামনে যেখানে বসে আনিকা পুতুলের বিয়ে দেয় সেখানে কবর দিয়ে দিলেন।
২৩/১২/২০১৫খ্রি:

0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress