ইতিহাসের পাতা ভরে উঠতে বেশী দিন সময় লাগে না। আজকের যা বর্তমান কালকে তাই অতীত বা ইতিহাস।বিষয়ের গুরুত্বের ওপর ইতিহাসের মর্যাদার মান নির্ভর করলেও ইতিহাস সেই বিষয়গুলো যে বিষয়গুলো জীবন হতে গত হতে থাকে।তাই আমাদের জীবনের ইতিহাসগুলোও তেমনি-জন্মের শুরুতে এক ইতিহাস পৃথিবীতে আসা প্রথম কান্নার শব্দে তৈরী হয় আরেক ইতিহাস।অতপর ক্রমান্নয়ে শিশু হতে কিশোর,কিশোর হতে যুবক যুবতী,যুবক-যুবতীর সংমিশ্রণে পারিবারিক বন্ধনে শুরু হয় আরেক নতুন ইতিহাস।এরপর সবশেষে আবারো শৈশবের স্মৃতি ধরে বৃদ্ধতায় জীবনের শেষ ইতিহাস।
আমরা যখন খুব ছোট ছিলাম।বয়স বার কি তের তখন আদর্শ লিপি পড়েই বড় হয়েছি। সেই আদর্শ লিপি বইটি আজ ইতিহাসের পাতায় ঠায় করে নিয়েছে। বইটিতে ছিলো শিক্ষণীয় কিছু বাক্য যা আজও মনে পড়লে আমাদের মনে এক রোমাঞ্চকর অনুভুতির দোঁল খায়। তার নাম শ্রী শ্রী সীতানাথ বসাকের ১২ পৃষ্ঠার পাতলা সেই নিউজপ্রিন্টের বই
“আদর্শ লিপি”।

আমাদের পূর্বে ছিলো মদন মোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশু শিক্ষার প্রথম ভাগ- রাম সুন্দর বসাকের -‘বাল্যশিক্ষা’। এটা ছিলো শিশুদের প্রথম পাঠ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় ভাগ বর্ণ পরিচয় ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয়। সেসময়ে এই বইগুলোর ছিলো এক চেটিয়া প্রভাব। ঢাকার ‘সুলভ যন্ত্র’ ছাপা খানায় প্রথম ছাপা হয় বাল্য শিক্ষা । ঢাকার ইমামগঞ্জে ছিল সুলভ যন্ত্র। পরে তা বাবুবাজারে স্থানান্তরিত হয়।

এর পরেই আমাদের সময় আমরা পাই সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শলিপি ও সরলবর্ণ পরিচয়। সেই আদর্শ লিপি আর আজকের শিশু শিক্ষার বইগুলো দেখলে রাজ্যের অমিল খুজেঁ পাই। আজো আমাদের ভাবায়;একজন মানুষকে মানুষের মত মানুষ হতে কি এক অদৃশ্য শক্তি ছিলো সেই আদর্শলিপি বইটিতে।আমাদের প্রথম শিক্ষাগুরু ছিলেন তুলনামুলক ভাবে মায়ের প্রধান্য বেশী।সেই মা যখন আমাদের জোর গলায় সূর করে পড়াতেন…
৴অ’তে- অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ,
৴আ’-তে আলস্য দোষের আকর,
৴কিংবা ‘গুরুজনকে মান্য কর-মিথ্যা বলা মহাপাপ,দরিদ্রকে অন্নদান কর ইত্যাদি।
বাক্য গঠনে ছিলো ৴‘খেলায় মজিয়া শিশু কাটাইও না বেলা, সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা।
শিশুদের মনে এই জীবন সাফল্যের জন্য জীবন যাপনের যে নিয়মাবর্তীতা গেথে গেল তা আর ভুলবার নয়- আমরা যারা আদর্শলিপি মনে প্রানে ধারণ করে বড় হয়েছি তা আজও সততা,নিষ্ঠা,সহমর্মিতা,ভদ্রতা আর কর্মঠের পরিচয় জীবনে বহন করে আছে।দুএকজন যারা ব্যাতিক্রম তারা আদর্শলিপি পড়েছিলেন সত্য তবে তা কেবলি পরীক্ষায় সাফল্য আনতে মানুষ হতে নয়।

উপদেশ মুলকের মধ্যে ছিলো:
৴‘মিথ্যাবাদীকে কেহ বিশ্বাস করে না।
৴‘পরিশ্রম কখনো নিষ্ফল হয় না।
৴‘অহংকারই পতনের মূল।

এছাড়াও অক্ষরে অক্ষরে ছিলো মানুষ হবার সংকেত।
৴ক’তে-কটুবাক্য বলা অনুচিত। ৴খ’তে- খলকে বিশ্বাস করো না।৴ গ’তে- গর্ব করা ভালো নয়।৴ জ’তে-জনক-জননী অতি পূজ্য ইত্যাদি
লেখাপড়া করে যে-গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে ইত্যাদি মনকে আজো স্মৃতি কাতর করে তুলে।

এ ছাড়াও সে সময় বইগুলোতে ছিলো নীতিবান হওয়ার পূর্ব সতর্কময় কিছু নীতি কথাও।
যেমন- ৴কটু কথা যেবা কয়-তার কাছে কেবা রয়।।
৴‘মিঠা কথা মুখে যার-সবে বশ সদা তার।

আরো ছিলো নতুন ভোঁরের ভাবনায় সেই বিখ্যাত কবিতাটি—

৴পাখী সব করে রব, রাত্রি পোহাইল।
৴কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।

আদর্শ লিপির বর্ণগুলো যখন মা বাবা আমাদের প্রথম শিখাতেন সেই সঙ্গে অক্ষরগুলোর সুন্দর হাতে লেখার অভ্যাসটাও করাতেন চক মাটি দিয়ে কাঠের কালো জমিনে শ্লেটে।অক্ষর লেখা শিখতে গিয়ে-অ আ ক খ ইত্যাদি জোর করে লিখতে গিয়ে হঠাৎ ধাক্কায় চকগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যেত।মনে হচ্ছিল মন চায় যা চায় হাত যেন চলে তার উল্টো দিকে।
অনেক সময় শ্লেটে চকে লেখা ভুল হলে বা অনুরূপ না হলে তা হাতের তালুতে মুছতে গিয়ে যখন অখেয়ালে মনের অজান্তেই কপালে শিক্ষাশ্রম ঘাম মুছতে চকের পাউডার নাকে মুখে গালে লেগে যেত।আবার মুছতে মুছতে কালো শ্লেটটা সাদাই হয়ে যেত।অতপর টুকরো কাপড়ে জল মিশিয়ে আবারো পরিষ্কার করে লেখা শুরু করতাম।কাঠের শ্লেটের পাশাপাশি চীনা মাটির কাঠের ফ্রেমের শ্লেটও এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল।ওটার দাম বেশী হওয়া এবং ভেঙ্গে যাবার ভয়ে কাঠের শ্লেটই বেশী ব্যাবহৃত হত।

সে সময় আমাদের প্রথম কবিতা ছিলো এক আদর্শীক কবিতা।যার পরতে পরতে রয়েছে মানুষ হয়েও প্রকৃত মানুষ হবার শপথ।
মদন মোহন তর্কালঙ্কারের
শিশুর প্রার্থনা-
"আমার পণ"
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,
এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,
কিছুতে কাহারে যেন নাহি দিঈ ফাঁকি।
ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে,
সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।

আদর্শলিপির ১০তম পৃষ্ঠায় আরো ছিলো  স্বামী বিবেকানন্দের শ্রুতি মধর শ্লোক।
“স্রষ্টার বন্দনা”
‘করিলেন যিনি এই জগৎ সৃজন...যা সৃষ্টি কর্তা ও বয়োজেষ্ঠদের প্রতি ভয় মান্যতা সন্মান ইত্যাদি শিশুকাল হতেই মনে গেথে যেত।আজ সেসব বইও নেই, কেউ পড়েও না-কেউ পড়ায়ও না।আধুনিকতার নামে ডরিমন,মন্টু পল্টু এর জীবন শিক্ষার কলকব্জাগুলোতে আধুনিকতার ছোয়া পেলেও জীবনে প্রকৃত মানুষ হবার আধুনিকতা হতে ক্রমশত সন্তানেরা দূরে সরেই যাচ্ছে। সরকারের চাপিয়ে দেয়া বইয়ের ভারে কান্দিকুজোঁ হয়ে যাওয়া শিশুদের নিকট হতে কেবলি রেজাল্টের উচ্চাকাঙ্খাই করছি পক্ষান্তরে তাদের মানবিক হবার বিষয়টাকে ক্রমশতঃ এড়িয়ে যাচ্ছি।যার প্রভাব ওদের জীবনেতো পড়েই বরং সমাজেও এর প্রতিক্রীয়া দেখতে পাবো বা পাচ্ছি।

আমাদের সময় আমরা আমাদের বয়োজেষ্ঠদের যথেষ্ট সন্মান করতাম।বসাবস্থায় কেউ কাছে এলে সালাম দিয়ে দাড়িয়ে যেতাম,তার কথা বলার সময় চোখ দুটো মাটির দিকে নজর দিয়ে মনযোগ সহ শুনতাম।আমার মতে আমাদের এ অভ্যাসটা সেসময় মা বাবা শিক্ষাগুরু পড়ানোর আদর্শলিপি আর মক্তব্যে হুজুরদের পড়ানো আদর্শীক বইয়ের অক্ষর শব্দ বাণীর কারনে আমাদের মনের ভেতর হয়তো এমন ভাব অবগত হত।নতুবা আজকালও আমরা মা বাবা হয়েছি,সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণ করানো জন্য সর্বোচ্চ দামী শিক্ষকের দারস্থ হই শুধু যদি মা বাবা বা শিক্ষাগুরুর কারনে মানুষ মানুষের মত মানুষ হত তবে আজ কেন তার নমুনা দেখিনা তাই ভাল বইও জীবনকে আদর্শীক করাতে একটা ফ্যাক্ট কাজ করে।

আজ কাল যে ভাবে ছোট ছোট ছেলেরা রাস্তাঘাটে ওপেনলি স্মুকিং করে তা ছিলো সেসময় কল্পনাতীত।ব্যাবহারে অন্য দিকটি নাই বা বললাম।মাঝে মাঝে যখন মনে জিদ চাপিয়ে রাখতে না পেরে ওদের কাছে প্রশ্ন কেনো এতোটা অধপতনে? তখন ওদের উত্তর শুনে মনে হয় ঐরকম প্রশ্ন করাটাই হয়তো আমারই ভুল ছিলো।

তাই শিক্ষার চেয়ে জরুরী নিজের সন্তানদের মানবীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ভাবে গড়ে তুলা।নতুবা সন্তানে এমন মানবীয়হীন শিক্ষায় ফলাফল গিয়ে দাড়াবে একপেশী ভাবে।সন্তান হয়তো উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবনকে নিয়ে যাবেন বিলাসীতার চরম সীমানায় কিন্তু আপনি আমি মা বাবাদের ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রমের মত একটি অপ্রত্যাশিত জীবনে।সমাজে তার হয়তো অঢেল সম্পদ আর ক্ষমতার উচ্চ শিখরে পৌছতে সময় লাগবে না কিন্তু সমাজে বেড়ে যাবে সামাজিক অবক্ষয়ে অসংখ্য ধারার অপরাধের প্রবনতা। সুতরাং সন্তানদের শুধু শিক্ষায় শিক্ষিত ভাবে গড়ে তুলা নয়,গড়তে হবে মানবীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে।

------------------------------

ছবি ও তথ্য
নিজস্ব ও অনলাইন।

102 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress