আত্মপ্রবঞ্চনা

তৌহিদুল ইসলাম ২৮ জুন ২০২০, রবিবার, ০৯:০৬:৪৯অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৮ মন্তব্য

সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আর সামাজিক উঁচু-নীচুর বিচার আমার চারপাশে শেওলাপূর্ণ বদ্ধ জলাধারে কামার্ত ব্যাঙের মত কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে বারংবার। প্রেম-প্লাবনে বদ্ধ জলাশয়ে যে জোয়ার-ভাটা এসেছে কোন মাঝির সাধ্য নেই সে ঘাটে নৌকা ভেড়ায়। ডুবে যাবার সম্ভাবনা শতভাগ জেনেও ঘাটে পানি খেতে আসে সব প্রবঞ্চকের দল। আমার কি দোষ! নিজের পূর্বপুরুষরা আগেই যে স্খলিত হয়েছে নিষিদ্ধ গন্ধমের মোহে!

গুরুদেব বলেছিলেন নশ্বর পৃথিবীতে গ্লানি, কদর্যতা দেখে মানুষকে এত ছোট ভেবোনা; তাদের মহান বলেই জেনো। ক্রমে ক্রমে মেঘ সরে যাবে, নবযুগের প্রভাত আসবে; তোমরা যাত্রা করো। এ কথার অর্থ আমরা কেউই বুঝিনি সেদিন। কেউই বিশ্বাস করতে চায় না তাঁর কথা। বলে এসবই আত্মপ্রবঞ্চনা। আমি নিশ্চিত ছিলাম গুরুদেবই সঠিক পথ দিশারি অথচ গুরুদেবের বর্ণিত সে মানবতা আজ আর বেঁচে নেই।

রাজশক্তির দম্ভ, হিংসা যথেচ্ছচারিতায় আমাদের নৈতিক অধঃপতনের যে বীজ বপিত হয়েছে যুগে যুগে সে বৃক্ষের ফল গলাধঃকরণে সব পথিক আজ বিপর্যস্ত। মানবতা এখন স্বার্থপর কুহকের মত দিবানিশি আমাদের স্বপ্নে আসে। কেবল প্রভাতের প্রাণচাঞ্চল্যের মধ্যে এক অশরীরী সুক্ষ্ম স্বর যেন আমার কানে কানে বলে গিয়েছিল- চলো সবে সার্থকতার তীর্থে। অগন্য মানুষ নারী-পুরুষ, শিশু, রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, মূর্খ-পন্ডিত, ইমাম-পুরোহিত সকলের সম্মিলিত সীমাহীন শোভাযাত্রা সেই যে শুরু হল সেটাই ছিল মানুষের সত্যান্বেষণের প্রথম যুগ।

দুর্গম পথ অতিক্রম করতে করতে কত দিনরাত চলে গেল, হতাশায় ডুবে আত্মপ্রবঞ্চকেরা গুরুদেবকেও হত্যা করে বসলো একদিন। শোভাযাত্রীদের মধ্যে দেখা গেল তীব্র প্রতিক্রিয়া। সেদিন আমি আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের বলেছিলাম তোমরা যাকে হত্যা করেছ তার বীজ প্রোথিত রয়েছে আমাদের মাঝেই। আমরা যে মৃত্যুঞ্জয়! চলো এবার ইহলোক জয় করে ফিরি লোকান্তরে। কিন্তু কি আশ্চর্য! আদর্শের অভিধানের পথ খুঁজতে গিয়ে যেন আজ নিজেই আমি প্রবঞ্চিত।

শুনেছি মহাপুরুষেরা সকলেই শিশুরুপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই শিশুর জন্মেই এক নব যুগের সৃষ্টি হয়। মানবতার গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয়, মানুষ ফিরে পায় নিজের সত্যদর্শন আর সনাতন আদর্শ। তাদের আগমনী বার্তার নতুন বানীতে মুখরিত হয় করুণা মৈত্রী; রচিত হয় প্রেম উপাখ্যান। অথচ শোভাযাত্রী প্রবঞ্চকেরা নিজেদের মাঝে পশুশক্তির বিকাশে অন্তরস্থিত লোভ, হিংসা, কামে ভেসে গুরুদেবরুপে জন্মান্তরিত সে শিশুটিকে তারা নিজেরাই বিনষ্ট করেছে।

সংসারের নানান আবিলতায়, বিভৎসতায় সে রুদ্ধদৃষ্টি তবুও মাঝে মধ্যে আলোকের ইঙ্গিত খোঁজে। জানি একদিন সব কদর্য কুয়াশা কেটে যাবে। গুরুদেবের কথায় বিশ্বাস করেছিলাম, আত্মপ্রবঞ্চকের কালিমা আমার দেহ থেকেও হয়তো একদিন মুছে যাবে। যুগ যুগান্তরের এই বিশ্বাস পূর্ণতা লাভ করেছে অসীমের যাত্রায়। আমার মাঝে বেঁচে থাকা শিশুটিকে আমিও যে অঙ্কুরেই গলাটিপে হত্যা করেছি নিজের হাতে।

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ