আজ রুপার বিয়ে………………………

নিশীথের নিশাচর ২৫ অক্টোবর ২০১৩, শুক্রবার, ১২:৫৪:৫৪পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, গল্প ২৪ মন্তব্য

বৃষ্টি হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই। ঝির ঝির বৃষ্টি। ভিজিয়ে দেবার মত না। এই বৃষ্টি তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাবে পুরোপুরি ভিজতে। তাই তেমন আমলে নিতে মনে চাইলো না এই বৃষ্টি কে। অবশ্য বৃষ্টি হলেও ভালোই হবে। ভিজতে মন্দ লাগবে না এখন। সারাদিন মেঘ করে ছিল, মাঝে মাঝে এরকম ঝির ঝির বৃষ্টি। আজ বুঝি আকাশের মন ভালো হবে না, এরকম চলতেই থাকবে। যদিও আমাকে কে কোন আবেগ বা মায়া ছুঁয়ে যেতে পারে না। আমার বাবার কড়া নির্দেশ সবরকমের আবেগ ও মায়ার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে আমাকে।
আজকে হঠাৎ করেই কেন জানি আমার আবেগে মন ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মায়া উথলে উঠতে চাইছে কারো জন্য। দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে মন খারাপ করে পুকুর পাড়ে বসে বসে পানিতে মাছের উপস্থিতি জানান দিতে বুদ বুদ ওঠা দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি তো হিমু আমার এই কাজ করলে চলবে না তাহলে নিজের সাথে প্রতারণা করে ফেলবো এসব করতে গেলে, হিমুর তো এসব করা মানায় না।
এগুলো সাধারণ মানুষের কাজ। আমি তো অসাধারণ আমি মহাপুরুষ। যদিও আমি নিজেকে অসাধারণ দাবী করি কিন্তু আদৌ কতটুকু অসাধারণ হতে পেরেছি নিজের কাছে, সেটা সন্দেহাতীত। তবুও আমি আজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, নিজের জাগ্রত আবেগ গুলো, কারো জন্য অনুভূত মায়া গুলো থেকে দূরে পালাতে এসব ভাবছি। তবে একদিক থেকে ভালো হয়েছে। আর কেউ থাকলো না আমার। যে কি না আমাকে মনে করবে অসম্ভব ভালোবাসা নিয়ে, যে কি না মাঝে মাঝেই আমার জন্য ভরা পূর্ণিমা রাতে পথ চেয়ে থাকবে। আমি এই সব কি ভাবছি ?? না এই সব ভাবা যাবে না আমাকে মহাপুরুষ হতে হবে এই সব ভাবলে আমার চলবে না। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে কখন অফিসার্স ক্লাব এর সামনে চলে এসেছি, খেয়াল নেই। ঢুকে খেয়ে আসা যায়, সবাই তো সবার মত ব্যস্ত থাকে। কেউ খেয়াল করবে না তেমন একটা।
আমি খাওয়া শেষে ভাবলাম খেলাম যখন তখন বর আর কনে কে দেখে আসা যায়। অবশ্য খাওয়ার সময় বেশ কয়েকবারই আমাকে সন্দেহ করা হয়েছে, সবাই বাঁকা চোখে বার বার তাকিয়েছে তবে কেউ তেমন প্রশ্ন করেনি। নিজের মতই খেয়ে উঠে পড়েছি। আমার এই সবের কোন তোয়াক্কা নেই। আর আমার পা যে খালি, সেটা দেখার সময় এখানকার মানুষের নেই। পায়ের দিকে তো দূরের কথা, কেউ তো পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের দিকেই চেয়ে দেখছে না। সবাই ব্যাস্ত কেউ আড্ডা, কেউ বা খাওয়া দাওয়া তে ব্যাস্ত। আমি বর আর কনে কে দূর থেকে এক পলক দেখেই বেরিয়ে এসেছি। কেন যেন ভালো লাগছিলো না ।

নাহ্‌।একটা সিগারেট আর এক খিলি মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান হলে মন্দ হতো না। সাধারণত আমি তেমন সিগারেট খাই না। তবে মাঝে মাঝে খাই। তাছাড়া এমন শাহী খানা দেওয়ার পর এক খিলি পান আর একটা সিগারেট খুব বেশিই তৃপ্তি দিতে সক্ষম। কিন্তু এইটা বড়লোক এবং সমাজের উচু স্তরের বিয়ের আয়োজন এই খানে খাবার শেষে পান পাওয়া টা রীতিমত এভারেস্ট জয় করার শামিল। খুব ইচ্ছা করছে সিগারেট খেতে কিন্তু আমার আবার সেই পকেট বিহীন রুপার দেয়া হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দেয়া আর পকেট না থাকায় আমার কাছে টাকা নেই । তাই আমি চাইলেও সিগারেট খেতে পারছি না। তবে এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ কাজ করছে না। অবাক করা বিষয়, একটু আগেও তো আমার মস্তিস্কে আবেগ আর মায়া নিয়ে দ্বিধা চলছিল। এখন ওগুলো কেটে গিয়েছে বলা চলে। যাক, হাফ ছেড়ে বাঁচা গেলো। মানুষ চাইলেই নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, একটু স্বার্থপর হতে হয় শুধু। কিন্তু, আমি হিমু আর হিমু তো এসবের ধার ধারে না। তাই আমি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করার প্রয়োজন মনে করি না। যেখানে আবেগ থাকে, সেখানে নিয়ন্ত্রণ এর প্রশ্ন আসে। আবেগই তো নেই, নিয়ন্ত্রণ কিসের। রূপা কে একদমই ভালো লাগছিল না বিয়ের শাড়িতে। এটা খেয়াল হতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের অনুষ্ঠান এর মধ্যমণি বউ, তারপর জামাই এর নাম। কিন্তু যদি বউ কে সেরকম না লাগে, তাহলে কি করে হবে! অবশ্য রূপার আসল রূপ তো নীল শাড়ি তেই। আমাকে যখন রূপা বিয়ের দাওয়াত এর কার্ড টা হাতে দেয় তখন সে তেমন কিছু বলেনি। শুধু একটা কথাই বলেছে, সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। সেই সুখী হয় যে সময় ও পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে বা চলে। এটা বলেই চলে যেতে নিচ্ছিলো রূপা। আমি ওকে থামায়, থামিয়ে বলেছিলাম রুপা তুমি আর কোনদিন নীল শাড়ী পড়বে না এইটা আমার তোমার কাছে শেষ চাওয়া। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি পারলে আমায় ক্ষমা করো। তোমার অনেক বার বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি কিন্তু এইবার আর ভাঙ্গতে মন চাইছে না। আমি চাই তুমি বিয়ে করে সুখী হও। আমি জানি তুমি আমার কোন কথা রাখবে না তারপর ও বলি আর কোনদিন আমাকে ভেবে জোছনা রাত কেঁদে কেঁদে পার করবে না, আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে না চোখে কাজল দিয়ে নীল শাড়ী নীল চুড়ি আর খোপায় শিউলি ফুলের মালা দিয়ে। এখন হতে তোমার যার সঙ্গে বিবাহ হচ্ছে তাকে সাথে নিয়ে তার পছন্দ মত সেজে জোছনা বিলাস করবে। আমি কথা গুলো বলার সময় জানালার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম। আমার সাহসে কুলায়নি রুপার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে তার কারন রুপার চোখে আমার প্রতি যে মায়া আর ভালোবাসা আছে তা সামনাসামনি উপেক্ষা করার মত মনের শক্তি তখন আমার ছিলো না। তাই আমি রুপার চোখের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলেছি কঠিন কিছু অপ্রিয় কথা। আমি হিমু আমি মহাপুরুষ হতে চাই, আমার এই আবেগ মায়ায় জড়ালে চলবে না। তবে এই পৃথিবীতে খুব কম পুরুষ আছে যারা সুন্দরী নারীর চোখে তার জন্য আবেগ ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারে ?? আমার মনে হয় আমি সেই পুরুষ যে এই কঠিন আবেগ ভালোবাসা উপেক্ষা করেছি। আমি কথা গুলো বলার সময় রুপা একটা টু শব্দ ও করে নাই একদম চুপ করেছিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম রুপা কেঁদেছিলো আর আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিলো আজ সারা রাত রুপা বালিশ ভেজাবে আর নিরবে কাঁদবে। আর কেউ আমার জন্য জোছনা রাতে নীল শাড়ী নীল চুড়ি কপালে নীল টিপ চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে খোপায় শিউলি ফুলের মালা দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে না। আর কেউ আমার কাছে বাদলা দিনের প্রথম কদম ফুলের জন্য আবদার করবে না। আর কেউ আমাকে পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী উপহার দেবে না।আর কেউ আমার এই মহাপুরুষ হবার সাধনা কে পাগলামি বলে আমার সাথে রাগ করবে না। আজ হতে আর কোনদিন তরঙ্গ ষ্টোর হতে ফোন করা হবে না।
আমি এই সব কি ভাবছি ?? আমার এই সব ভাবলে চলবে না। আমি তো বেঁচে গেছি। আমার মহাপুরুষ হতে আর কোন বাধা রইলো না। রুপা চলে গেছে। আমি জানি না, আমার বলা কথা গুলো রূপা শুনবে কি না।
হয়তো শুনবে নয়তো শুনবে না। তবে সে জানে, যেটা হয়েছে সেটা ভালো হয়েছে।
রূপার সংসার হবে, বাচ্চা হবে। আমি যখন রূপার বাসায় যাবো, তখন রূপার বাচ্চারা আমার দিকে ছুটে আসবে চিৎকার করতে করতে। বলবে, তুমি কি সেই পাগল হিমু মামা তোমার গল্প সব সময় আম্মু আমাদের বলে ।
তুমি নাকি চাঁদের আলো খাও হিমু মামা ?? চাঁদের আলো খেতে কেমন মিষ্টি না ঝাল ?? আচ্ছা এইটা কি চিপসের প্যাকেটের মত বিক্রি হয় ?? আমাদের চাঁদের আলো খাওয়াবে হিমু মামা ??
“হিমু মামা আমাদের জন্য কি এনেছ ?’’ আমি উত্তর দিবো, “ তোমাদের জন্য বড় বড় দুটো ইলিশ মাছ এনেছি, মাওয়া ঘাট থেকে। কাঁচা চিবিয়ে খাও, দেখবে কত মজা। ’’ নদীর পারে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে, ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে। আজ সেখানে যাবো। বৃষ্টি টা বাড়তে শুরু করেছে। যাক, ভালোই হল। ভিজতে ভিজতে যাবো মাওয়া ঘাটে । একটু থমকে দাড়ালাম। মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠলো চোখ টা বন্ধ করে দেখি রূপার চেহারা ভেসে উঠে। একটু আগে দেখে আসা রূপা না। শেষ যেবার রূপা কে নীল শাড়ি তে, নীল টিপে, চোখে গাঢ় কাজল, আর খোপায় শিউলি ফুলের মালা দেয়া যে রুপা, সেই রূপা। না মস্তিক বিভ্রম করছে।
আমার হাতে একটা প্যাকেট। সে প্যাকেটে রূপার জন্য আমার সব আবেগ,মায়া, ভালোবাসা ভরা। প্যাকেট টা রূপা কে দিয়ে আসলাম। রূপা সেটা নিয়ে হাসি মুখে নিয়ে চলে যায় অন্যদিকে ফিরে। কিছুই বলে না।
চোখ খুলতেই নিজেকে ভারমুক্ত মনে হল আমার। মনে হচ্ছে, বৃষ্টির মাঝে আরেক সতেজ হিমুর জন্ম হল। যার কোন রূপা নেই। যে সত্যিকার অর্থেই সকল আবেগ,মায়া,ভালবাসা থেকে মুক্ত।
মহাপুরুষ হবার সাধনায় আবার আমি গন্তব্য বিহীন হাঁটতে শুরু করলাম...

বিঃদ্রঃ উৎসর্গ হুমায়ন স্যার কে আর পৃথিবীর সকল হিমুর রুপাদের কে আর রাতুল কে আমাকে এই লিখার আইডিয়া টা দেবার জন্য।।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ