অস্ট্রেলিয়ার গল্প

অভি ৬ ডিসেম্বর ২০১৪, শনিবার, ০২:২৯:৩৩অপরাহ্ন বিবিধ, ভ্রমণ ২৪ মন্তব্য

অস্ট্রেলিয়া অদ্ভুত এক দেশ! সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তাই মোবাইল বন্ধ করে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়িয়ে পরতাম অদেখার সন্ধানে! যে সময়ের গল্প তখন ফেসবুক, টুইটার, স্মার্টফোন ইত্যাদি দাপট দেখিয়ে বেড়াত না! মোবাইল বন্ধ করলে মোটামুটি দুনিয়া বন্ধ। কোনো এক পাবলিক হলিডে সামনে রেখে আমরা দুই বন্ধু বসে গেলাম ডায়াল আপ ইন্টারনেট আর কাগজ কলম ম্যাপ নিয়ে! দুই তিনটা রুট শর্টলিস্ট করা হলো। ১. মেলবোর্ন থেকে এডিলেড ২. মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরা হয়ে সিডনি ৩. মেলবোর্ন থেকে মাঝ বরাবর ডারউইনের দিকে যতদূর যেতে মন চায়। সবগুলো রুটেই ড্রাইভ করে যাওয়ার পরিকল্পনা, যেতে আসতে প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার। ম্যাপ নিয়ে বসে শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো মেলবোর্ন থেকে এডিলেড যাওয়া যাক, আমার বন্ধু দীর্ঘদিন সিডনিতে ছিল এটা বিবেচনায় রেখে। পরে অবস্য দ্বিতীয় রুটেও গিয়েছিলাম। সে আর এক বিরাট কাহিনী। আর একদিন বলা যাবে। মেলবোর্ন থেকে এডিলেড প্রায় ৯০০ কিলোমিটার। ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালালে ৯ ঘন্টা। বিশ্রাম সহ হয়ত ১০-১১ ঘন্টা ড্রাইভ। ম্যাপের দিকে গভীর মনোযোগে দেখে, আমি ফিরতি পথে লাইন টানলাম সমুদ্রের পাস থেকে কোস্টাল ড্রাইভ ধরে, প্রায় ৬০০ কিলোমিটার বেশি ড্রাইভ। কিন্তু ড্রাইভটা হবে আমাদের অতি প্রিয় গ্রেট ওসেন ড্রাইভ ধরে। আরও দুই পাগলাকে ফোন করলাম, তারা কাজকাম বাদ দিয়ে এক পায়ে খাড়া! রুমমেট অন্য দুজনের একজন চরম অলস, সে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবে, অন্যজন পাবলিক হলিডের ডাবল পের মায়া ছাড়তে চাইল না।

আমরা মহা উদ্যমে তখনকার লেটেস্ট মডেলের গাড়ি টয়োটা অরিয়ন ভাড়া করে ফেললাম। ১০০ কিলোমিটার স্পিড তুলতে ৪-৫ সেকেন্ড সময় নেয়। আমরা তখন দলবল নিয়ে বেল্ট বাকল বিক্রি করি ভিক্টোরিয়া মার্কেটে, অনেকটা বাংলাদেশের বঙ্গমার্কেটের মত একটা মার্কেট। কাজ শেষ করে সন্ধায়গাড়ি পিক করে দুই পিচ্চি আর আমার বন্ধুকে নিয়ে শুরু করলাম অজানার দেশে যাত্রা। অস্ট্রেলিয়া অনেক বড় দেশ, প্রায় সবগুলো শহর সমুদ্রের তীরে, মাঝখানের বাকি জায়গাটা সত্যিকার অর্থেই কিছু না! এই রুক্ষতার মাঝে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য, কিছু না থাকবার সৌন্দর্য। তার মাঝ থেকে চলে গেছে লম্বা ফ্রিওয়ে! কালো লিক লিকে এক সাপ যেন লাল মরুভূমির ভিতর একে বেকে চলে গেছে। মাঝে মাঝে পাহাড়, দুই একটা কান্ট্রিসাইড শহর। ফ্রিওয়ে পাহাড় কেটে সোজা না গিয়ে পাহাড়ের ঢাল ধরে একে বেকেচলে গেছে! মানুষ বসতিহীন এমনসব জায়গায় অস্ট্রেলিয়ানদের প্রকৃতিকে সন্মান দেখানোর জন্য এই আয়োজন আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে। কিছু কাগজের নোটই তো, কিন্তু একটা পাহাড়, একটা হাজার বছর পুরোনো গাছ অনেক বেশি মুল্যবান। লম্বা রুটের রাস্তাগুলো ফাঁকাই থাকে, আমরা গাড়িতে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছি, দুজন ড্রাইভার আমি আর আমার বন্ধু। ঘন্টাদুয়েক পর পর আমরা নিয়ম করে ড্রাইভার বদল করে নিচ্ছিলাম।

গ্রীষ্মকালে অস্ট্রেলিয়াতে লম্বা দিন থাকে। সূর্য উঠে যায় সকাল ৫:৩০ - ৬ টায়, দিনের আলো রাত ৮-৯ টা পর্যন্ত থাকে। ঘুরাঘুড়ির জন্য মহা সুবিধা! গল্প করতে করতে সূর্য ডুবে গেল দিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায়! আকাশে লালচে রং এর পেইন্টিং, রুক্ষ শূন্য লালচে মরুভূমি, লম্বা কালচে পীচ ঢালা রাস্তা চিড়ে আমরা তীব্র বেগে এগিয়ে যাচ্ছি এডিলেডের দিকে। গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠলো, দুটি হেডলাইটের আলোতে রাস্তার মার্কিং গুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে আধারে। রাস্তার এই মার্কিংগুলো রিফ্লেক্টিভ মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরী, হেডলাইটের আলোতে জ্বলজ্বল করে রাস্তা দেখিয়ে যায়। ঘুমন্ত রাস্তায় ঘন্টাখানেক পর একটা দুটা গাড়ি বিপরীত দিক থেকে তীব্র বেগে হুস করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বেশিরভাগ ইইন্টার স্টেট বিশাল সাইজের মালবাহী ট্রাক। পালা করে ড্রাইভার বদল আর ড্রাইভারের সাথে সঙ্গ দেবার জন্য কেউ না কেউ জেগে থাকছে। পিছনের সিটে ঘুম আর সামনের সিটে গান আর আড্ডা। গাড়ির এসি ঠান্ডার দিকে। লম্বা ড্রাইভের সময় ড্রাইভার ঘুমিয়ে পরবার একটা ভয়াবহ প্রবণতা থাকে। একটু গরম গরম হলে তো কথাই নাই! কখনো গাড়ির ফুয়েল, কখনো নিজেদের ফুয়েলের জন্য দাড়াচ্ছি। কফি, এনার্জি ড্রিংক, চিপস আর অফুরন্ত আড্ডাই ছিল আমাদের ফুয়েল। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে এলো, ক্লান্ত আমরা গাড়ি পার্ক করলাম জন মানবশূন্য রাস্তার পাশে। গাড় নীল রংএর অরীয়নের উপর হেলান দিয়ে কফির মগ হাতে আমরা চারজন চুপচাপ দাড়িয়ে সূর্যদ্বয় দেখলাম বিস্তিনর্ প্রান্তরে। ইতিমধ্যেই এডেলেডের কাছে চলে আসছি আমরা। কখনও পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, কখনও লোকালয়ের পাশ দিয়ে তীব্র বেগে চলে গেছে ফ্রীওয়ে।

৬-৭ বছর আগে এডেলেড শহরটা ছিল খুব ছোট। পুরো শহর ঘুরে ফেলতে ১০-১৫ মিনিট লাগত। বছর দুয়েক আগে গিয়েছিলাম এডেলেড, শহর দৈঘর্ে প্রস্থে তো বেড়েছেই, মানুষের সংখ্যাও মনে হলো কয়েক গুন। চোখ ধাঁধানো প্রানবন্ত এক শহর। আমরা প্রায় মানুষশুন্য শহর ঘুড়ে একটা ব্যকপ্যাকার হোটেল খুঁজে বের করে ফেললাম। হলিডে বলে শহর পুরা খালি। তখন এখনকার মত গুগল করা যেত না। রাস্তায় ঘুড়ে ঘুড়ে দরদাম করে রুম ভাড়া করবার মজা কি এখন বোঝানো সম্ভব? ব্যকপ্যাকার হোটেলগুলো আমাদের মত ছাত্রদের জন্য, সস্তা, বান্কার স্টাইলে বেড। ধুধু শহর দেখে দুঃশ্চিন্তায় পরে গেলাম, খাওয়া দাওয়া কই কেমনে হবে! সাথের এক পিচ্চি বললো কুছ পরোয়া নেহি! সে সাথে করে বাসায় রান্না করা এটা সেটা নিয়া আসছে! খাওয়া শেষ করে আমরা বের হলাম শহর দর্শনে! শুনছিলাম এডেলেডের অনেকগুলো বীচ ধবধবে সাদা বালির। মেলওয়ে মেলবোর্নের একটা বই, যেটাতে শহরের রাস্তাঘাটের ম্যাপ আঁকা থাকে। এডেলেডেও নিশ্চই আছে কিছু একটা। হোটেলের বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের সাথে গাল গল্প জুড়ে দিয়ে, তার কাছ থেকে একটা এডিওয়ে ধার নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম সমুদ্র দর্শনে। সাদা বালির উপরে যেনো উৎসব লেগেছে। ছুটির দিনে শহর খালি করে সব মানুষ বীচে। এর আগে এমন ধবধবে সাদা বালির সমুদ্র সৈকত দেখি নাই। আমাদের সাথের পিচ্চি দুইটা দেখি লুকাই লুকাই বিকিনি পরা সুন্দরি মেয়েদের ব্যকগ্রাউন্ড বানিয়ে খচাংখচাং ছবি তুলে ফেললো। সমুদ্রের পারে ফিস এন্ড চিপ্স দিয়ে ডিনারও সেরে ফেললাম। আরও ২-৩ টা বিখ্যাত বীচ ঘুড়ে হোটেলে ফেরত আসলাম। সাথে করে অষ্ট্রেলিয়ান বিয়ার। পরের দিন পাহাড়গুলোর দিকে নজর দেব ঠিক করে বিয়ারের প্রতি পূর্ন মনোযোগ দিলাম। বিয়ার শেষে গভীর রাতে রাতের এডেলেড দেখতে বের হলাম। অষ্ট্রেলিয়ার সব শহরই রাতে এক ভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়। হলিডে ছিল বলে শহর ছিল খুব ফাঁকা, তারপরও শহরে ছড়ানো ছিটানো তরুন তরুনীদের বিয়ার গ্লাসের টুংটাং আর হাসির কল্লোল খুব শোনা গেল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বিশাল এক নাস্তা করে ১০ টা বাজবার আগেই হোটেল ছেড়ে দিলাম। বন্ধুর যুক্তি হলো নাস্তার দাম তুলনামূলক কম, ফাটাইয়া নাস্তা করলে লান্স খুব একটা খাবার দরকার পরে না। বের হলাম পাহাড় দর্শনে। এডেলেড শহরটার চারপাশে পাহাড় আর এক দিকে সমুদ্র। শহর থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিট ড্রাইভ করলেই পাহাড় বা সমুদ্রে হাজিরা দেয়া যায়। পথে ক্রিকেটের আরেক তীর্থভূমি এডেলেড ওভালে দাড়ালাম। পাহাড়, সমুদ্র, নদী, ফুলের বাগান আর খোলা মাঠ দিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো গোছানো শহর। এডিলেড আরো বিখ্যাত পৃথিবীর নামকরা ওয়াইনের জন্য। ভালো ওয়াইন তৈরী করতে ভালো আন্গুরের দরকার হয়। এডেলেডের আবহওয়া খুব মানানসই। খুব শীত পরে আর পাহাড়ের মাঝে মাঝে ঘন কুয়াসা পরে। টসটসে রসালো আন্গুরের জন্য খুবই দরকার। শীত আবার খুব বেশি পরলে হবে না। তাই বরফ পরা এলাকাতে ভালো আন্গুর হয় না। শীত বেশি পরলে আগুন জ্বেলে ধোয়া দিয়ে গরম করা হয়, যাতে আন্গুরে ফ্রস্ট বাইট না পরে। এই কারনে ইউরোপে ওয়াইন তৈরী কষ্টসাধ্য। ফ্রান্সের তৈরী ওয়াইনের চড়া দাম। যদিও ওনেক বিশেষগ্ব মনে করেন এডেলেডের ওয়াইন কোনো অংশেই খারাপ না। একটু শহরের বাইরে গেলেই শত শত আন্গুরের বাগান, সবগুলোতেই ফ্রী টেস্ট করবার ব্যবস্থা আছে। ড্রাইভ করতে হবে তাই খুব বেছে বেছে টেস্ট করলাম। ওরা আসলে সবগুলো টেস্ট করে সবথেকে পছন্দেরটা কিনে নেয়। আমরা টেস্ট করে মানে মানে কেঁটে পরলাম। এমন ভাব যে, নাহঃ তেমন পছন্দ হলো না!

এবার ফেরার পালা, গ্রেট ওসেন ড্রাইভে সব সময় মেলবোর্ন থেকে এসে ১২ এপ্সটেপল্সে শেষ করে ফিরে যেতাম, এবার অন্য পাশ থেকে এসে পুরোটাই দেখা হয়ে যাবে। ফিরে যাওয়া সবসময় বিরক্তিকর হয়, কিন্তু এবার আমাদের আগ্রহ আর উত্তেজনার কোন কমতি ছিল না। দূরের পাহাড় আর রেইন ফরেস্ট, সারি সারি ক্রিস্টমাস ট্রি, কিছুদূর পরপর একটা দুটো ওয়াইনারী। ড্রাইভার বদল করে আমার পালা এলো। লম্বা সোজা রাস্তা ২০-৩০ কিলোমিটার চলে গেছে রেইনফরেস্টের দিকে, ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলছে, অরীয়নের ইঞ্জিন এতই ভালো কোনো শব্দ পর্যন্ত হচ্ছে না। খোলা মাঠ পুলিশ লুকিয়ে থাকবারও জায়গা নেই, আমি এস্কেলেটরে চাপ বাড়িয়ে চললাম, স্পিড মিটারে ১৮০-১৯০ ছুই ছুই, মনে হলো গাড়ি একটু কাপছে। আমার পাশের পিচ্চি উত্তেজনায় শিহরিত। এটাই আমার তোলা সর্বোচ্চ গতি, পুলিশ দেখতে পেলে কয়েক হাজার ডলার ফাইন করে দিত, লাইসেন্সে ক্যানসেল করে দিলেও অবাক হতাম না। আমরা দেখতে দেখতে রেইন ফরেস্টে ঢুকে গেলাম।পাহাড়ের উপরে ঘন জঙ্গল, নানা নাম নাজানা পাখি ডাকছে, পাহাড়ের আকা বাকা রাস্তায় আমরা ১০০কিলোমিটার গতিতে ছুটে যাচ্ছি। নেক্সট স্টপ পোর্টল্যান্ড! অবাক করা ব্যাপার হলো ভিক্টোরিয়ার প্রথম শহর ছিল পোর্টল্যান্ড, মেলবোর্ন নয়! ১৮৩৪সালে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন এডওয়ার্ড হেনরী! আরো এক বছর পর মেলবোর্ন শহরের খোজ পায় ব্রিটিশ সেটেলাররা। হিস্টরি একটু অন্য রকম হলে পোর্টল্যান্ড হতে পারতো আজকের চকচকে মেলবোর্ন। পোর্টল্যান্ড এর অজপাড়াগায় ম্যাকডোনাল্ড দেখে খুব অবাক হলাম। যাই হোক লাঞ্চ এখানেই সেরে ফেললাম। পোর্টল্যান্ড ছোট ছবির মত একটা শহর।সামনে গ্রেট ওসেন রোড। এই রাস্তার বর্ণনা লিখে বা ছবি তুলে দেয়া সম্ভব না। এই রাস্তাটা অনুভব করতে হয়। এক পাশে পাহাড়, এক পাশে সমুদ্র, ড্রাইভ করতে করতে কখনো কখনো রেইন ফরেস্ট, কখনো ছোট একটা ছবির মত শহর। আকাবাকা রাস্তায় ড্রাইভ করা খুবই বিপদজনক, একটু ভুল করলে সোজা ১০০-২০০ মিটার নিচে। বিপদজনক নিষিদ্ধ বস্তুতে মানুষের আগ্রহ সেই সভ্যতার শুরু থেকে, যে মানুষটা প্রথম নিজের হাতে আগুন জ্বালিয়ে ছিল, তারচেয়ে বিপদজনক আর কি ছিল। আমরা দুই ড্রাইভার গাড়ি চালানোর জন্য মোটামুটি ঝগড়া শুরু করে দিলাম। ড্রাইভিং সিটে একবার বসলে কেউ আর ছাড়তে চায় না।

আমরা গ্রেট ওসেন রোডের অদেখা পথে ফিরছি, আর নতুন নতুন লুক আউট আবিষ্কার করে চলছি। লুক আউট গুলো হচ্ছে প্রকৃতির বিস্ময় ওসেন রোডের ভালো করে দেখবার মত জায়গা। বে অফ আইল্যান্ডস - সমুদ্র পাহাড়ে হাজার বছর ধাক্কা দিতে দিতে একটা বে তৈরী করে ফেলেছে, যার মাঝখানে ছড়ানো ছিটানো কিছু পাহাড়ের টুকরা রয়ে গেছে, যার উপরে সহজেই দেখা যায় ঢেউয়ের আচর! লন্ডন ব্রীজ - একইভাবে তৈরী হওয়া একটা লম্বা পাহাড়ের অংশবিশেষ যার নিচ থেকে এমনভাবে ধসে পরেছে দেখতে লন্ডন ব্রীজের মতই লাগে। দা গ্রোটো - হেঁটে হেঁটে পাহাড় বেয়ে প্রায় ১০০ মিটার নিচে নেমে যেতে হয়, তারপর যেটা দেখা যায় তা যে কাউকে স্তব্ধ করে দিবে অনায়াসে! পাহাড়ের মাঝে একটা গর্তর মত, চারপাশে পাথর, সামনে যেন ফ্রেম করা মহাসমুদ্র। হঠাৎ হঠাৎ বড় ঢেউ এলে গোসোল করার জন্য বারাবারি করতে হবে না। কাকভেজা হয়েও দাড়িয়ে রইলাম বিস্মিত চোখে!

১২ এপস্টপলস - ১২ টা পাহাড়ের আংশ, আনেকটা এভাটার মুভির সেই ঝুলন্ত পাহাড়ের মত দাড়িয়ে আছে সমুদ্রের মাঝে যুগ যুগ ধরে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটা টুরিস্ম বিজ্ঞাপনে প্রথম পাতায় প্রকিতির আভুতপূর্ব এই সৃষ্টি দেখা যায়।
অ্যাপোলো বে আর লরন - ছোট দুটি অদ্ভুত সুন্দর শহর, যদি কোন দিন কিছু টাকা জমে আমি এইখানে পাহাড়ের উপরে একটা বাড়ি কিনব, আর সমুদ্রে মাছ ধরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিব। শহরদুটি রেইনফরেস্টের মাঝে, আর পাহাড়ের মাঝে দেখার মত ৭-৮ টা ঝরনাও আছে। আমি এই এলাকা মোটামুটি চষে ফেলেছি বিভিন্ন সময় ঘুরেঘুরে। কেপ প্যাটন লুকআউট - প্রায় ৩০০ মিটার নিচে বরফ শীতল দক্ষিন মহাসাগর, আর অন্য পাশে খাঁড়া পাহাড় ৪০০ মিটার, মাঝখানে রাস্তার উপরে এই লুকআউট। অনেকদিন মন খারাপের দিনে ২ ঘণ্টা ড্রাইভ করে এখানে এসে ঘণ্টা খানেক বসে ফুরফুরে হয়ে ফিরে গেছি।

এই রকম ১৫-২০ টা স্পট না দেখলেই নয়। স্পট গুলো না দেখলেও, শুধু গ্রেট ওসেন রোডের উপর ড্রাইভ করে গেলেও মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমার মনে আছে প্রথম যেবার আমি যাই, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে হা করে গিলেছিলাম। প্রথম ভালবাসার চুম্বন যেন সমুদ্র পাহাড়কে দিচ্ছে, সেই চুম্বনের ভালবাসার সৃষ্টি এই রাস্তা। এই রাস্তা কিন্তু আজকের নয়, এটা প্রথম তৈরি করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা ১৯১৯ - ১৯৩২ সালের মাঝে, পৃথিবীর সবথেকে বড় ওয়ার মেমোরিয়াল, সব থেকে সুন্দরও বটে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বাকি তিনজন অ্যাডভেঞ্চারারের সাথে আজকাল তেমন কথা হয় না, কালেভদ্রে দেখা হয়। কিন্তু স্মৃতিতে যেন বেঁধে রেখেছে আজীবন, সাথে আছে মেলবোর্ন টু এডিলেড, সমুদের তীর ধরে এডিলেড টু মেলবোর্ন আর গ্রেট ওসেন রোড। ইচ্ছে করেই কারো নাম উল্লেখ করলাম না। যাই হোক গল্পটা অনেক বড় হয়ে গেল। আমাদের পাগলামির ছোট একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। কোন এক সন্ধায় আমি আর আমার বন্ধু টি এস সি তে আড্ডা আর চা খাচ্ছি। আমি বলছি, ...... যাবি। দোস্ত প্রথম আংশ শোনে নাই। উঠে দাড়িয়ে বলল, হুম যাওয়া যায়, চল। রাতটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে পর দিন ফেরত এলাম। বেটা ভাবছে আমি বলছি "জাবি"। আর একবার তো একদম সেন্টমারটিন পৌঁছেগেছিলাম।

(কষ্ট করে এত বড় লেখা পরবার জন্য ধন্যবাদ)
- আভি মণ্ডল (মেলবোর্ন)

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ