অসীম জীবনীশক্তি

রিমি রুম্মান ২১ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, ০২:২২:৩৫অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৬ মন্তব্য

নিউইয়র্কে আজ রৌদ্রজ্জ্বল দিন ছিল। কণকণে শীতের মাঝে আচমকা উষ্ণদিন। বড় ভালোলাগা দিন। গাছগুলো প্রায় কঙ্কালসার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গত কদিনের বৃষ্টি আর ঝড়োবাতাস কাণ্ড থেকে পাতাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেছে সহজেই। চারপাশের উঠোন, সড়ক, সর্বত্রই ঝরাপাতার হুটোপুটি। রেস্তোরাঁ, পানশালা বন্ধ, বিধায় সন্ধ্যার কিছু পর নির্জনতা নামে শহর জুড়ে। দুদিন আগে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের সতর্কবার্তা পাই মুঠোফোনে। ১৯শে নভেম্বর থেকে সকল পাবলিক স্কুল আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরকে বাড়িতে রিমোট লার্নিং এ ক্লাস করতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ চলছে। সংক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করায় এই সতর্কতা। মানুষের জীবন তো আর হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া যায় না! ছোট বাপজান রিহান স্কুটার নিয়ে বাইরে যাবার বায়না ধরেছে। তাকে নিয়ে বাইরে যাব কী যাব না এমন দোলাচলের মাঝে মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগের এক স্কুটার চালকের কথা।

সেই সময়ে দেশ থেকে একটি পরিবার নিউইয়র্কে আমাদের অতিথি হয়ে এসেছিল। তাদের নিয়ে শপিং এ গেলাম। স্ত্রী কন্যাদের কেনাকাটা শেষে ভদ্রলোক নিজের জন্যে একটি স্কুটার কিনেন। পরদিন আমরা দুই পরিবার এক সঙ্গে হৈচৈ করতে করতে আটলান্টিক সিটি বেড়াতে যাই। তখন শরত কাল। রাতের দিকে হাল্কা শীতল বাতাস বইছিল। সৈকতের কিনার ঘেসে প্রশস্ত বালুচরে আমরা হাঁটছি, গল্প করছি। সমুদ্রের গর্জন শুনছি। রাতের আকাশকে বিদ্ধ করছিল অগনিত তারা। প্রাকৃতিক এইসব উথালপাতাল ভালোলাগাকে ছাপিয়ে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট করছিল ভদ্রলোক। তিনি আটলান্টিক সিটির আলো ঝলমলে বোর্ডওয়াকে স্কুটার চালাচ্ছিলেন। বহুদূর অব্দি যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন। আবার যাচ্ছেন। অনেকটা সময় এই আসা-যাওয়ার খেলা চলে। অতঃপর বোর্ডওয়াকের কিনার ঘেসে ক্লান্ত পথিকের জিরিয়ে নেবার অপেক্ষায় অপেক্ষমান লোহার বেঞ্চিতে বসেন। একজন মধ্যবয়েসি মানুষের এমন করে স্কুটার চালানোয় আমার বিস্ময় তিনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি স্কুটারটি একপাশে হেলান দিয়ে রাখেন। বিস্তৃত হাসি হেসে বলেন, তোমার কী মনে হচ্ছে আমার বুড়োকালে ভীমরতি হয়েছে ? আমি হেডফোনের তারের প্যাচ খুলছিলাম গান শুনবো বলে। তিনি উত্তরের অপেক্ষা না করে বলেন, ' বুঝলে, এক সময় এমন একটি স্কুটারের খুব শখ ছিল। আমার ছোটবেলায় ঢাকা শহরে এত যানবাহন ছিল না। বাসার সামনের বড় রাস্তায় আমার প্রতিবেশি বন্ধু স্কুটার চালাত। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রোজ ছুটন্ত বন্ধুটিকে দেখতাম। ওর বাবা উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। অফিশিয়াল ট্যুরে বিদেশ যাওয়া-আসা করত। নানান রকম খেলনা আনতো। ওর কোনো খেলনার প্রতিই আমার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু স্কুটারটির প্রতি খুব লোভ হত। মনে মনে খুব করে পেতে চাইতাম। হাহাকার লাগত। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, আমি স্কুটার চালাচ্ছি ঝড়ের বেগে। আমার কাঁধ অব্দি ঝুলে থাকা লম্বা চুলগুলো তীব্র বাতাসে পেছনের দিকে উড়ছে। হা হা হা ...।'

তিনি আবার স্কুটার হাতে তুলে নেন। বোর্ডওয়াকের দিকে এগিয়ে যান। আমি গান শোনার আয়োজন বন্ধ করে ব্যাকপ্যাকে ফোন, হেডফোন সব রেখে চেইন আটকে ব্যাগটি কোলের উপর রাখলাম। যেন দিব্য চোখে ১০/১১ বছরের এক বালককে বাতাসের বিপরীতে তীব্র বেগে স্কুটার চালিয়ে চলে যেতে দেখলাম। যার কাঁধ অব্দি ঝুলে থাকা চুল প্রবল বাতাসে পিছনের দিকে উড়ছে। শুধু স্থানটি ভিন্ন। ঢাকার পিচঢালা পথ নয়, আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ঘেঁষে কাঠের বোর্ডওয়াক। অনেক বছর আগে তিনি যখন আমাদের অতিথি হয়ে এসেছিলেন,ততদিনে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। একজন সফল শিল্পপতি। মাথায় মস্ত টাক। কিন্তু বুকের গহিনে পুষে রাখা স্বপ্ন, সাধ পূরণ করতে ভুলেননি একদমই। অদ্ভুত না ?

ছোট্ট একটা জীবন। এক জীবনে অনেক না পাওয়া বেদনা নিয়ে আমাদের চলে যেতে হয়। সাধ এবং সাধ্য যেমন একসাথে হয় না। তেমনি মন এবং বয়সও একসাথে মিলে না। কী অসীম জীবনীশক্তি থাকলে মানুষ এমনটি করে! অথচ অনেক শখের জিনিষ সময়মত পাইনি বলে বুক ভরা হাহাকারে বিষণ্ণ জীবন বহন করে চলি আমরা অনেকেই।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ