অর্কিডের সারাবেলা

রোকসানা খন্দকার রুকু ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, সোমবার, ০৭:৪৭:৪৮অপরাহ্ন গল্প ১৫ মন্তব্য

কিছুদিন পরপরই আমার ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। ঘুম হয় না বলেই মন খারাপ আর ঝিম মেরে বসে থাকি। কোন কিছুতে মজা পাইনা। অকারন মেজাজ খারাপ হতে থাকে।
ডা: মজুমদার আগে থেকেই আমার ট্রিটমেন্ট করেন।
তিনি জানতে চাইলেন,- অর্কিড, প্রেমে পড়েছ নাকি? এ বয়সে তো মানুষ মরার মতো ঘুমায়! আর তোমার ঘুম হয়না! এটা কোন কথা? কি ওষুধ দেবো বলো? তার চেয়ে প্রেসক্রিপশানে লিখে দেই প্রফেসর অর্কিড আহসান প্রেমে পড়েছেন!
ডা: মজুমদারের সাথে কথা বললেই মন ভালো হয়। তিনি বেশ সহজ ও সাবলীল। আমি ডা: মজুমদারের কথায় লাজুক হাসি দিলাম। এমন ভান করলাম, যেন সত্যিই প্রেমে পড়েছি। তার কথা বেশ ভালোও লাগলো। যাক! এখনো তাহলে প্রেমের বয়স আছে?
খুশিতে পার্লার আন্টিকে বললাম,- আন্টি একটু ভালো করে ডলাডলি করে দাও তো। গাল- মুখ যেন চকচক করে। চোখে- মুখে যেন প্রেম প্রেম একটা ভাব আসে।
পাঁচশো টাকায় আন্টি ‘ডায়মন্ড’ ডলা দিল। তারপর থেকে
সর্দি লেগে নাক- মুখ সব বন্ধ। কথাও বোঝা যায় না। নাক দিয়ে কথা বের হয়ে যায়।
দুপুরে ভাবী ফোনে বলেছে, কলেজ থেকে ফেরার সময় যেন কলা নিয়ে আসি। আমি কলা কিনতে বেমালুম ভুলে গেলাম। কলেজ মোড়ে এসে বারবার মন বলছিল, কি যেন কেনা দরকার! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ঘুরেফিরে পাশের টকটকে গোলাপ ফুলের দোকানেই চোখ যাচ্ছে। অগত্যা তারই একগোছা গোলাপ কিনে বাসায় ফিরলাম।ঠিক তখনই কলা কেনার কথা মনে পড়ল।
সমাধান করতে ভাগনাকে ফোন দিলাম- বাবা তোমার ’মামীমা’ রোজা রাখবেন। আমাকে কলা কিনতে বলেছিলেন, ভুলে গেছি। তুমি কষ্ট করে নিয়ে আসিও।
ভাগনা ‘মামীমা’ না শুনে, শুনেছে ‘নানীমা’। তাই নরম দেখে চম্পা কলা নিয়ে এসে নানীর হাতে দিল।
মা তো অবাক, - আমি কখন কলা আনতে বললাম? শীতের সময় আমি কি কলা খাই? এমনি আমার এ্যাজমা।
ভাগনা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে উপরে চলে গেল। আমি অসহায় নাক নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বই এর প্রুফ দেখতে হবে। সম্পাদক সাহেব বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। বইয়ের প্রুফ দেখতে বসেছি, সিলেটি আমার নাক দিয়ে বের হয়ে যাওয়া কোন কথাই বোঝেন না।
রেগে গিয়ে বললেন,- দুরো আপনার কথা কিছুই বোঝা যায় না। যান তো, নাক পরিষ্কার করে আসেন?
ডা: মজুমদার তো সকাল সকাল ঘুমুতে বলেছেন। কিন্তু ওঠার সময় যেহেতু বলেননি তবুও কষ্ট করে সকালে উঠে হাই তুলতে তুলতে মাকে ‘শুভ সকাল’ জানালাম।
মা উত্তরের বদলে কটমট করে তাকাল। ডাইনী ভদ্রমহিলার তাকানোতে বুঝলাম- ঘটনা খারাপ।
গজর গজর করে বলছেন- কতোদিন পর জামাই এলো। বেচারা না খেয়েই চলে গেল। এভাবে সংসার হয়? বয়স বাড়ে; তবুও সংসারী হতে পারলে না। ঘড়ি দেখেছ?
ঘড়িতে দেখি সকাল ৯.৪৫ বাজে। ও গড, পরীক্ষার ডিউটি ছিল। ব্রাশ করারও সময় নেই, মাস্কে মুখের গন্ধ ঢেকে কোনমতে জিন্সের সাথে জামাটা গলিয়ে কলেজে হাজির।
সিনিয়র স্যারের আটবার ফোন কলের হিসাব বাদ দিয়ে পালিয়ে রুমে ঢুকতেই, তার সাথেই দেখা।
-আচ্ছা তোমার কি বয়স হয় না? এমন করে কেউ ঘুমায়? ফোন পর্যন্ত ধরো না! এভাবে চাকরী থাকবে?
মনে মনে বলি- আপনার চাকরী করতে চায় কে? আমার বয়স হয়েছে, কাজ ভালো লাগে না। আমি খালি ঘুমাতে চাই।
বিকেলে আদা চায়ে কাটবাদাম খাচ্ছি। ছেলে কিসমিস খাবে, তাকে বেছে বেছে দিচ্ছি। কি সুন্দর কুটকুট করে খাচ্ছে! অসাধারন দৃষ্য! এটাই আমার সেরা সময়। ও যদি কোনদিন আর বড় না হতো! কি ভালো হতো! বাচ্চারা অযথাই বড় হয়। ছেলেকে একটা চুমু দিতে মন চাইলো।
বললাম- সোনা, তুমি তো আমার নাটস্ পটের সব কিসমিস খাও? তার বদলে আমাকে একটা চুমু দাও।
সে কিছুটা এগিয়ে এসে, কি ভেবে মুখ সরিয়ে নিলো!
-কি হলো?
-তুমু( চুমু) দিবোনা। তুমি মুখের কিসমিস খাবে।
আমি এতোটা লোভী জানতাম না। ওকে চুমু দিতে গিয়ে মুখ থেকে কিসমিস বের করে খাবো! সারাদিনে প্রথম হাসলাম। এটা সে আমার কাছেই শিখেছে। চকলেট খেতে গেলে তারটা আগেই শেষ হয়। তখন সে আমার মুখে মুখ লাগিয়ে চকলেট বের করে খায়।
ডা: মজুমদার বলেছেন নিউরো পেশেন্টদের সকাল সকাল ঘুমোতে হয়। জামাই সন্ধ্যা হলেই ডাকবাংলো থেকে ভারী গলায় ফোন দেন।তিনি কাজে এসেছেন নাগেশ্বরীর দুধকুমার নদীতে। কাজ আর ডাকবাংলোর চেয়ে আমাতেই তার মনোযোগ বেশি। আমি ঠিক তার ভারী গলার মতলব বুঝতে পারি! আর ঘনঘন হাই তুলতে থাকি। সরকারী কাজ ফেলে এতো কি?
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন,- বুঝতে পারছি! আর একটা বউ আনতে হবে?
আমি উদাস ও নির্বিকার উত্তর দেই,- ভালো তো, তোমার বউ, আমারও বউ হবে। মাঝেমাঝে আমারও গা- পা টিপে দেবে। রান্না করে খাওয়াবে!
জামাই বলে- পাগল! শুধু ফোনের শব্দ ঘটাস!
শুয়ে শুয়ে ক্যাটরিনা কাইফের বিয়ের ভিডিও দেখছিলাম। ভাবছি, বিয়ে আর প্রেমে বোধহয় বয়স বলে কোন কথা নেই। নাকি শেষ সময় এসে একটা গতিতে পৌঁছানো দরকার তাই সবাই বিয়ে করে? আজ থেকে কিছু বছর পরে হয়তো সকল নিয়ম- রীতি থাকবে কিন্তু মানুষ আর বিয়ে করবে না। আর সবচেয়ে বেশি মেয়েরা একা থাকা পছন্দ করবে! কারন পুরুষ তার একগুয়েমী আর পুরুষ সেজে থাকবার ব্যাপারটা ছাড়তে পারবে না।
কিছুদিন আগে ট্যাক্সের কাগজ তৈরিতে উকিলের কাছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি উকিল আঙ্কেল নেই, তার ছেলে আছেন। আগে পরিচয় হয়নি। স্মার্ট বয় ঝটপট সব কাজ করলেন।
তারপর থেকেই আমার আন- নোন কল আসে। যতোবার ব্লক করি, ততো নতুন নাম্বারে নানা ভঙ্গিমায়, নানা বাহানায় আমার প্রশংসায় তিনি ভাসিয়ে দেন। আমি বুঝতে পারি তার বাহানা আসলে কথা বলার জন্য কিংবা দুদিন পরে অন্য কোন অফার দেবার জন্য। আমার সব খবরই জানেন; কিভাবে জানেন জানিনা। আমার কাছে এইসব পুরুষরা ফায়দা লোভী বলে মনে হয়। এদের পাত্তা দেয়া ঠিক না। চরিত্রে কালি লেপার জন্য এরা পাশে পাশে থাকে।
আমি উকিলের সাথে মোটেও জমাতে চাচ্ছি না। তবুও তিনি নিয়ম করেই ফোন দেন; সকাল-দুপুর- সন্ধ্যা।
আজও তিনি ফোন দিয়ে ক্যাটরিনার বিয়ের ভিডিও দেখতে বাগডা দিলেন। অনিচ্ছায় ফোনটা পিক করে, আমি ঘন ঘন হাই তুলতে লাগলাম!
-আপনার সমস্যা কি? আমি ফোন দিলেই হাই তোলেন? নাকি সবসময় এমনই।
-কোন সমস্যা নেই! আমি বিবাহিত, তাছাড়া আপনার সাথে আমার কোন কথাও নেই, থাকতেও পারেনা।
-ভাইয়া তো আপনার সাথে থাকেনা, একটু কথা বললে কি হয়। আমার ভালো লাগতো।
-আমার ভালো লাগে না কথা বলতে। অযথা, আজাইরা বকর বকর।
বেচারা এবার ভীষন রেগে গেলেন। মাসখানেক ধরেই আমাকে পটানোর অনেক চেষ্টা করছেন। কোনভাবেই ফায়দা করে উঠতে পারছেন না। হঠাৎ বলেই ফেললেন আপু কিছু মনে করবেন না, আপনার সম্পর্কে আমার একটা ধারনা হয়েছে। মহিলারা দেখি পুরুষদের সাথে কথা বলায় বেশ আগ্রহী। আপনি কেন যেন এমন! কথা বলতে চান না। আর সবসময় দেখি মেয়েদের সাথেই চলাফেরা করেন? দেখা করতে চাইলাম তাও বোনসহ আসতে চান! আপনি কি ’লেসবি’?
রাগে আমার চেয়াল শক্ত হয়ে গেলো। চুপ আছি, শক্ত একটা জবাব খুঁজছি। নারীদের উত্তক্ত করার নতুন ট্রেন্ড বের করেছে কিছু পুরুষ। এদেরকে কঠোর জবাব দেয়া জরুরী!
বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করলাম- মাদার...দ’, তুই কি আমারে মাহি পাইছিস। আমি অর্কিড, কিন্তু তুলতুলে নরম না শক্ত। ভাবিস না যে মুরাদ টাকলার মতো ফোন দিয়ে ‘ লেসবি’ বলবি আর আমি কিছু না বলে শুনে যাবো। প্রুফ করার জন্য তোর সাথে লটর- পটর করব। তুই যা বলবি তাই শুনবো? মেয়ে/ মহিলারা সবাই সস্তা, সহজলভ্য না। এবার তোদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
আর আমি যদি লেসবিয়ান হয়েও থাকি তাতে তো তোর সমস্যা হবার কথা না। সমস্যা হবে আমার নিজের, আমার পরিবারের।নিজের ফায়দা লোটার জন্য যা খুশি বলবি? চোয়াল ভেঙ্গে একদম হাতে ধরিয়ে দেবো।
একজন নারী বিধবা, ডিভোর্সী, অবিবাহিত, স্বামী থেকে দুরে থাকা যেটাই হোক না কেন? তোদের কিছু পুরুষের সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। নারীর যদি তোদের কোনটাতেই সমস্যা না থাকে। তাহলে তোরাও নারীদের তাদের মতো থাকতে দে।এতো সমস্যা কেন?
আর শোন, তুই তো উকিল! আইনের বই খুলে দেখিস মেয়েদের উত্তোক্ত করার সাজা কি? কতো ধারায় পরে!
তোদের মতো এইসব পুরুষরা ফায়দা লোভী। তোদের পাত্তা দিলেই একসময় নারী নষ্টা- ভ্রষ্টা। আর না দিলেও সমস্যা। আসলে তোরা নারী চরিত্রে কালি লেপার জন্য পাশে পাশে থাকিস। কাল আমি তোর বাপের কাছে যাবো। আর তোর ঠ্যাং দুটো ছিঁডে হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসবো।
ফোনটা কেটে দিলো জঘন্য একটা গালি দিয়ে। আমার রাগে নি:শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল।
আজ ডা: মজুমদারের সকল টিপস্ বিফলে গিয়ে চোখ থেকে ঘুম উধাও হলো। ডা: দিয়ে আসলে সব হয় না। সুস্থ- সুন্দর থাকার জন্য পারিপাশ্বিক পরিবেশ খুবই জরুরী। যেটা আমাদের সমাজ নামক একটা ব্যবস্থা আছে; সেখানে নেই। কিছু মানুষ থাকতে দেয়না। তবে পরিবর্তন কোন একদিন অবশ্যই আসবে!!!

ছবি- নেটের

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ