অভাব

সুলতানা সোনিয়া ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, রবিবার, ১২:৪৪:১৬অপরাহ্ন বিবিধ ১ মন্তব্য

সকাল বেলায় কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলতেই দেখি,বাড়িওয়ালা মুখ বাঁকা করে বললেন, ভাড়া দেবার মুরোদ নেই বাসা আটকে রেখেছো কেন? আগামী মাসেই বাসা খালি করো। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বললাম, চাচা আর কয়েকটা দিন সময় দিন, আমি আপনার পাওনা টাকা সব দিয়ে দেবো। বাড়িওয়ালার ঝাক্কাস মার্কা ঝাড়ি দিয়ে দিনটা শুরু করলাম। মাকে বললাম, এক কাপ চা দাওতো,মা বললেন, চিনি নেই।মনটা বিষণ্ন হয়ে গেলো। মানুষের জীবনে ‘‘অভাব’’ একটা বড় অভিশাপ। এইসব অভাবের গায়ে লাথি মেরে খুব বৃত্তশালী হতে ইচ্ছে করছে আজ। যদিও আগে কখনো বৃত্তশালী হবার ইচ্ছা আমার কোন কালেও ছিলো না।
আজ ২ মাস হলো আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিয়েছি বললে ভুল হবে। ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আমাদের অফিসের জি.এম. তার খালাতো ভাইকে আমার পদটি দেবার জন্য আমার পিছনে উঠে পড়ে লেগেছিলেন।
আমার প্রায় সব কাজেই ভুল ধরা আর সেই ভুলগুলোকে এমডি স্যারের কাছে উপস্থাপন করাটাই ছিলো জি এম স্যারের প্রধান কাজ। বেশ কয়েকমাস যাবৎ চেষ্টা করার পর অবশেষে তিনি সফল হলেন। একদিন সকালে এমডি স্যার আমাকে ডেকে বলরেন, আপাতত তোমার পদে আমার লোকবলের প্রয়োজন নেই। সেই থেকে প্রায় ২ মাস হতে চললো আমি বেকার। পরিচিত অপরিচিত অনেকের কাছেই গেছি একটা চাকরির জন্য। কেউ কেউ বায়োডাটাও জমা রাখলেন। কিন্তু চাকরি?সেতো সোনার হরিণ। এই একটি মাত্র চাকরি আমার পরিবারের সবার মুখে অন্ন তুলে দেয়। মায়ের জমানো কিছু টাকায় সংসার চলছে। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছিনা। ছোট বোনটার বই কিনে দিতে পারছি না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। ইচ্ছে করছে মরে যেতে। কিন্তু পর্বতসম ইচ্ছাশক্তি নিয়েও কেন জানি মরতে পারছিনা। পরক্ষণেই ভাবছি। আমি আত্মহত্যা করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? তখন ঘরের অসুস্থ মা, আর স্কুল পড়ণ্ডয়া বোনটাকে তো রাস্তায় নেমে ভিক্ষা করতে হবে।
আজ নীলার জন্মদিন। ফোন করে এটা শুভেচ্ছা জানাবো তাও পারছি না। মোবাইল ফোনে ১০ টাকা ব্যালেন্স ভরার মুরোদও আজকাল আমার নেই।
জানি নীলা ভীষণ রেগে আছে। ইচ্ছা করছে পুরো পৃথিবীকে চিৎকার করে বলি,টাকার কাছে ভালোবাসাও পানশে। অভাব সেখানে প্রবল, ভালোবাসা সেখানে দুর্বল।
সারা ঢাকা শহরকে আজ গিলে খেতে ইচ্ছে করছে। ক্ষুধায় আমার পেট চোঁচো করছে। রাশেদ, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। ভাবছি একবার ওর কাছে যাবো। শুনেছি ব্যবসা করে শহরের নামকরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে ও- একজন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি ওর সাথে। যথারীতি ওর অফিসে হাজির হলাম। সাজানো গোছানো ছিমছাম অফিস ওর। ২ ঘণ্টা বসে থাকার পর অবশেষে রাশেদের দেখা মিললো।
আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো রাশেদ, আমি ভেবেছিলাম এতো বড় বৃত্তবান লোক,নিশ্চয়ই আমাকে দেখে মুখ বাঁকাবে। কিন্তু আমার ভাবনাটা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। দামি গাড়িতে চড়িয়ে রাশেদ আমাকে নিয়ে গেলো শহরের এক দামী রেস্টুরেন্টে। পেট পুরে দামি দামি খাবারগুলো অকৃতজ্ঞের মতো গিলে যাচ্ছিলাম। কারণ ঘরে আমার মা, আর বোনটি অর্ধাহারে আছে। খেতে খেতে রাশেদকে আমার বর্তমান পরিস্থিতিগুলো বললাম। ও আমাকে সাহস দিয়ে বললো, এতো ভাবিস কেনরে? আমি কি মরে গ্যাছি; আমার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা গুঁজে দিয়ে বললো,কাল একবার আমার অফিসে আয়। একটা প্রশান্তির ঢেঁকুর তুলে রাস্তায় বেরুলাম। অথচ একটু আগেও এই শহরটাকে আমার গিলে খেতে ইচ্ছে করছিল/ মাত্র কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী মনে হচ্ছে। সোজা চলে গেলাম বইয়ের দোকানে। বোনের নতুন ক্লাসের বই কিনলাম। ব্যাগ ভরে বাজার করলাম। মোবাইল ফোনে টাকা ভরে নিলার মান ভাঙালাম। পরেরদিন যথারীতি রাশেদের অপিসে হাজির হলাম। রাশেদ আমাকে বললো, ওসব চাকরি বাকরির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। যারা কেবল দুবেলা দু মুঠো ডাল ভাত খেয়ে দিনযাপন করতে চায় চাকরি হলো তাদের জন্য। বললো ব্যবসা কর। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ব্যবসা? টাকা পাবো কোথায়? রাশেদ বললো, বড় হতে হলে সিঁড়ি দরকার। তুই চাইলে আমি তোর সিঁড়ি হতে পারি। রাশেদের কথাবার্তা আমার কাছে অবাক লাগছে। অবিশ্বাস্যও লাগছে কিছুটা। তবু রাশেদই আমার একমাত্র ভরসা।
এক অনিশ্চয়তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার সামনে পেছনে ডানে বামে কোন পথ খোলা নেই। হঠাৎ নীলার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মনে হল,এখনো কবুল বলিনি। কেবল আংটি পড়ানো হয়েছে। একদিকে আমার অনিশ্চিত জীবন। অন্যদিকে নীলার অপেক্ষা। সব মিলিয়ে মাথাটা ঘুরে উঠলো। আমি আর কোনকিছু চিন্তা না করেই রাশেদের হাতটা ধরে বললাম-আমি রাজি। তুই শুধু আমাকে এই ‘অভাব’ নামের দায় থেকে বাঁচা। নিজেই টের পেলামনা কখন আমি অভাব নামের এক অভিশাপ থেকে বাঁচতে ঢুকে পড়েছি হাজারটা পাপে। নেশাদ্রব্য পাচারকারী হিসেবে আমার নাম স্মার্গলীন জগতের অনেকেরই জানা। সেই পুরোনো বাসা বদলে উঠেছি নিজের কেনা নতুন ফ্লাটে। মা, আমার কাছে অনেকদিন প্রশ্ন করেছেন, বাবা তুই কি ব্যবসা করিস? এত টাকা তুই ভিাবে কামাস? আমি শুধু মাকে বলি, মা ও-তুমি বুঝবেনা।
গতকাল রাতে মা স্ট্রোক করেছেন। স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করালাম। নামী দামী চিকিৎসকদের কল করা হল। তারপরেও বাঁচানো গেলোনা মাকে। এই প্রথম আমি উপলব্ধি করছি, মা ছাড়া পৃথিবীর সকল সন্তানই অসহায়। বাবার মৃত্যুর পরেও এই অনুভবটা আমার ভিতর কোনদিন কাজ করেনি।
ছোট বোনটাকে শান্ত্বনা দিবো নাকি নিজেই শান্ত হবো বুঝতে পারছি না। এতো কষ্ট পাচ্ছি কেন আমি? তবে কি আমার মা, মৃত্যুর আগে বুঝে গিয়েছিলেন যে তিনি অসৎ টাকায় দিনযাপন করছেন?
প্রচণ্ড একটা অপরাধবোধ কাজ করছে আমার ভিতর। আগামীকাল মায়ের কুলখানি। হাজার হাজার টাকা খরচ করে মিলাদের আয়োজন করেছি অথচ কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আমার মায়ের আত্মাকে কষ্ট দিচ্ছি। অনুশোচনায় ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হচ্ছিলাম। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন মাকে হারিয়ে ছোট বোন পারুকে নিয়ে।
হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় নীলার ফোন। আমার মতো একটা ক্রিমিনালকে বিয়ে করে নীলা অন্তত ভুল করতে চায়না।
একজন সরকারি অফিসারকে বিয়ে করলো নীলা। আমি আরো একধাপ একা হয়ে গেলাম।
কিছুদিন পর আমার ছোট্ট বোনটি পারু এস এম সি পরীক্ষা দেবে। ভালো ভালো শিক্ষক, কোচিং কোনকিছুই বাদ দিলাম না। ওকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি ভালো রেজাল্ট আমার চাই। আমার কথা রাখতে পারু ও প্রানান্তকর চেষ্টা চালালো। অবশেষে স্টার মার্ক পেয়ে পারু পাশ করলো। ওকে ভালো কলেজে ভর্তি করালাম। আর আমি ব্যস্ত আমার অবৈদ ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে। ইতোমধ্যে আমার পাচারের তালিকায় আরো কিছু নেশাদ্রব্য যুক্ত হয়েছে। দিন দিন আমার উপার্জনের মাত্রা বাড়তেই লাগলো।
এখন আমার আর অভাব নেই। হুম্ম, কিছু অভাব আছে বটে! আমার মায়ের অভাব,আমার নীলার অভাব। দামী দামী মদে ডুবে থেকে ভুলে যাই এসব অভাবের কষ্ট।
আজ দুদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম বৃষ্টি আমার মন খারাপ করে দেয়। পারুর ঘরে মায়ের একটা ছবি টাঙানো আছে। পারু কলেজে গেছে, এই ফাঁকে মায়ের ছবির কাছে গিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম আনমনে। কখন যে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে টের পাইনি। টিস্যু খুঁজতে পারুর টেবিলের কাছে গেলাম। কিন্তু একি চোখে পড়লো আমার? পারুর টেবিলে/ বইয়ের ভাঁজে ছড়ানো ছিটানো ইয়াবা ট্যাবলেট। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো।
কি মুখ নিয়ে আমি দাঁড়াবো ওর সামনে? যে আমি দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের নেশার জগতে নিয়ে আসি, তার বোন যদি নেশা করে তাতে তো অবাক হবার কিছু নেই। তবু কেন এত অনুশোচনা হচ্ছে আমার? নিজেকে মহাপাপী মনে হচ্ছে। জানি, আমাকে ক্ষমা করবে না কেউ-না নীলা/ না আমার বোন পারু/ না আমার মৃত মা/ না আমার দেশ/ না আমার বিবেক।
দরজায় টকঠক আওয়াজ। পারু বাসায় ফিরেছে। রাতে খেতে বসে পারুকে অনেক বোঝালাম। খুব কাঁদলাম ওকে জড়িয়ে ধরে।
পারু বললো ভাইয়া, আমি ভালো হতে চাই। ফিরে আসতে চাই স্বাভাবিক জীবনে। সকালে ওকে নিয়ে বেরুলাম। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ওকে ভর্তি করিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, পারু সুস্থ জীবনে ফিরে আসলে আমি ভালো হয়ে যাবো। অবৈধ ব্যবসা থেকে বেড়িয়ে আসবো। তিনমাস চিকিৎসা শেষে পারু সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলো।
আমি ব্যস্ত হলাম আমার প্রতিজ্ঞা পূরণে। আমার অবৈধ সম্পত্তিগুলো ট্রাস্ট করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভালো হবার পথে একের পর এক বাধা আসতে শুরু করলো। ফোনে একের পর এক হুমকি।
আমার ব্যবসায়িক পার্টনাররা আমার ভালো হবার পথটাকে রুদ্ধ করতে চাইছে বারবার। তবু আমি আমার প্রতিজ্ঞা পূরণে অনড়। ইতোমধ্যে আমার এক দুসম্পর্কের খালাতো ভাই আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছে। পারুকে দেখে খুব পছন্দ করলো।
আমিও আর অমত করলাম না। পারুর কাল ফ্লাইট। ও আমেরিকা চলে যাবে ওর স্বামীর সাথে।
রাত ১১টা। আমার বাড়ির দারোয়ান এসে বললো স্যার নিচে আপনাকে কয়েকজন সাদা পোষাকধারী লোক ডাকছে। আমি নিচে নেমে এলাম। আমাকে তারা চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে চললো। একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে গাড়ি থামলো। নিমিষেই কয়েকটা বুলেট এসে আমার বুকটাকে ঝাঝড়া করে দিলো। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।
ক্রমশ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে..

 

0 Shares

একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ