
অবাকের আম্মুকে কাজে সাহায্য করার জন্য বাসায় এক আপু থাকে অবাকের, তার নাম রেহানা। অবাকের আম্মু অবাককে বলল যে, ‘’আজকে থেকে স্কুলে তোমার সাথে রেহানা আপু যাবে’’।
অবাক মনে মনে ভাবে যে স্কুল আসলে যেমনটা ভেবেছিলাম অতটাও খারাপ না, যেহেতু এতদিন হয়ে গেলো এখনো কেউ মুসলমানি করাতে আসছে না তাই একটু আশ্বস্ত হল আম্মুর কথায় । অবাকের সাথে এখন রেহানা আপু স্কুলে গিয়ে বসে থাকে । অবাকের ভয় আগের থেকে একটু কমেছে, রোল কলের উত্তর এখন নিজেই দিতে পারে ।
কিছুদিনের মধ্যে স্কুলের ১ম সাময়িক পরীক্ষা ঘনিয়ে এলো, এখন আবার নতুন আরেক কাহিনী । ভিজিটররা বলে গেলো যে, রেহানা আপাকে পরীক্ষার সময় আর বেঞ্চে বসে থাকতে দেয়া হবেনা, তাছাড়াও ব্যাপারটা কেমন না ! কোনো অভিভাবকই এরকম বেঞ্চে বসে থাকেনা অবাকের রেহানা আপা ছাড়া। কি আর করা , অবাকের সাথে চুক্তি হয়েছে রেহানা আপা একেবারে চলে যাবেনা তবে জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকতে হবে তার। কেউ অবাককে মুসলমানি করিয়ে দিতে ছুরি নিয়ে আসলে অবাক যেনো তাকে ডাক দিতে পারে সেরকম পজিশনে জানালার পাশে থাকতে হবে তার। অবাককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রেহানা আপা গিয়ে দাড়ালো জানালার পাশে । অবাক উকি দিয়ে দেখলো ঠিক আছে সবকিছু, ভয়ের কোনো কারন নেই । এরকম করে ১ম সাময়িক পরীক্ষা দিলো তারপর ২য় সাময়ি্ক, দুটো পরীক্ষাতেই অবাক ১ম স্থান অধিকার করার জন্য ওর বাবা-মা যেমন খুশি হল তেমনি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।
সবশেষে বার্ষিক পরীক্ষা দিলো অবাক। আজকে অবাকের ফলাফলের পালা । ফলাফল ঘোষণা হল এবং বার্ষিক পরীক্ষাতেও ১ম স্থান অধিকার করে শিশু শ্রেনী থেকে প্রথম শ্রেনীতে এখন অবাক। এতদিন অবাকের রোল ছিলো ৩৪ । এখন থেকে তার রোল হল ১ । এই রোল নিয়ে অবাকের মন খুবই খারাপ, তার অন্য বন্ধুদের রোল কারো ২ কারো আবার ১৫ কিন্তু তার রোল কেনো এত কম হবে। সবাই তাকে বুঝিয়ে বলল যে, ‘’রোল ১ তাদেরই হয় যাদের ফলাফল সবার থেকে ভালো হয়’’ । অনেক বুঝানোর পরে সে বুঝতে পারলো যে রোল ১ যারা পরীক্ষায় বেশি নম্বর পায় তাদেরই হয় তাই বলে অন্যরা যে খারাপ ছাত্র এমনটা নয়, শুধু বেশি নম্বর অনুসারে ১ তারপরে ২ এরকম ভাবে ক্রমানুসারে সাজানো হয় । ইতিমধ্যে অবাককে বাবা-মা অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুন্নাতে খাতনার ব্যবস্থা করলো। ডাক্তারও অবাককে ভুলিয়ে ভালিয়ে এই অসাধ্য সাধন করল।
মুসলমানির (সুন্নাতে খাতনা) ১ সপ্তাহ পরে অবাক আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলো, , , ,
এখনও রেহানা আপা গিয়ে অবাকের জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকে কিন্তু অবাক একটি বারের জন্যেও তাকায় না এখন আর ওদিকে । অবাকের আম্মুর ধারণা অবাক হয়তো এখনও একা স্কুলে যেতে ভয় পায় তাই সে রেহানাকে আর নিষেধ করেনা ওর সাথে স্কুলে যেতে। অবাকের ভয় যে নিজের অজান্তেই কেটে গেছে অবাক টেরই পায়নি । এছাড়াও তার ভয়ের প্রধান কারন তো ছিলো মুসলমানি সেটাও এখন আর নেই। অবাক তার ক্লাসের বন্ধুদের সাথে হাঁসি ঠাট্টা করে আর রেহানা আপা ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । রেহানা আপারও একটা ছেলে ছিলো অবাকের মতই দেখতে, নাম ছিলো তার ‘’মানিক’’, সে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে আরো ২ বছর আগে। বেঁচে থাকলে হয়তো তার ছেলেও এখন স্কুলে পড়ত, অবাকের মতই মিষ্টি করে কথা বলত , পরীক্ষায় ১ম হতো। এগুলো অবাকের দিকে তাকালেই তার চোখে ভেসে ওঠে আর কখন যে চোখের কোন থেকে টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরে টেরই পায়না রেহানা আপা, তখন সে সাথে সাথে চোখ মুছে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার জানালার পাশে দাড়িয়ে দেখতে থাকে অবাককে। রেহানা আপার মায়া জন্মে গেছে অবাকের জন্য, অবাককে না দেখে এখন আর সে থাকতে পারেনা। অবাককে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকাল সকাল বাসায় এসে বসে থাকে । বন্ধুরা অবাককে নিয়ে সবসময় মজা করে, অবাককে ভীতুর ডিম বলে ক্ষ্যাপায় বন্ধুরা, কারন তারা জানে যে অবাকের জন্য প্রতিদিন এক মহিলা এসে জানালায় দাড়িয়ে থাকে যেন সে ভয় না পায় এজন্য। অবাকের খুব রাগ হয় এজন্য। স্কুল ছুটি হলে অবাকের হাত ধরলে সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘’হাত ধরতে হবেনা আমি একাই যেতে পারবো বাসায়’’। রেহানা আপা কিছু না বুঝে অবাকের পেছন পেছন বাসায় আসে। এদিকে বাসায় এসেই অবাক আজকে একটা কথা বলে অবাক করে দেয় সবাইকে । অবাক বলে ‘’আম্মু আমার সাথে এখন আর কারো যেতে হবেনা আমি ভয় পাইনা এখন আর স্কুলে’’। আম্মু শুনে তো খুবই খুশি সাথে সাথে অবাকের বাবাকেও ফোন করে জানালো এই খুশির কথা। সবাই খুশি হলেও রেহানা আপার মুখ টা কালো হয়ে গেলো । সে যে অবাকের মধ্যে তার মৃত ছেলের ছায়া খুজে পেয়েছিলো । এতদিন তার মনেই ছিলোনা যে দু বছর আগে সে তার আদরের মানিক কে হারিয়েছিলো। রেহানা আপা তবুও তার অভ্যাস আর ছাড়তে পারেনা, সে চুপি চুপি যায় অবাকের স্কুলে, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে অবাককে। হঠাত একদিন অবাক দেখতে পেল তার রেহানা আপাকে , দেখেই অবাকের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেলো তার উপর । অবাক এক দৌড়ে তার কাছে এসে বলল এই তোমাকে না বলেছি আমি আর স্কুলে ভয় পাইনা, যাও এখান থেকে চলে যাও আর কখনো আসবেনা । রেহানা আপা ‘’ঠিক আছে আব্বু’’ বলে কোনো শব্দ না করে মাথা নিচু করে চলে যায় সেখান থেকে। রেহানা আপা হেটে যাচ্ছে তবুও কেন যেন তার পা আজকে আর এগুচ্ছে না । তার বুক ফেটে কান্না চলে আসছে । সে একসময় একটা গাছের পাশে গিয়ে বসে পরে। তার বুকের বাম পাশটা আজকে খুব ব্যাথা করছে । হয়তো কাউকে তিনি বলতেও পারবেনা তার এই ব্যাথার কথা ।
অবাকের বাকি দিনগুলো দারুণভাবেই কেটে যেতে থাকে। প্রতিটা ক্লাসে ভালো ফলাফল করতে করতে একসময় সে অনেক বড় হয়ে যায়। তার ছোট বেলার পাগলামো গুলো মনে পরলে এখন নিজেই মনে মনে হাসে ।
এভাবেই অবাকেরা ছোটবেলা থেকে পরম স্নেহ আর ভালোবাসা নিয়ে অনেক বড় হয়ে যায়, শুধু সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যায় রেহানা আপারা ।
Thumbnails managed by ThumbPress
২৬টি মন্তব্য
শাহরিন
অবাকরা এভাবেই একদিন বড় হয়ে যায়। অসংখ্য মানুষের ভীড়ে রেহানা আপাদের কথা প্রায় ভুলে যায়। এমন সময় মনে পড়ে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
শাফিন আহমেদ
ভবিষ্যতের সব অবাকদের মনের মধ্যে রেহানা আপাদের অবদান আর ত্যাগের কথা যেনো মুছে না যায় এই আশা করি । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য ।
শামীম চৌধুরী
যাক মুসলমানি হওয়াতে যে অবাকে ভয় কেটেছে সেটাই সবচেয়ে বড় পাওনা অবাকের আম্মুর। আর রেহানা আপারা আছে বলেই অবাকের আম্মুরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন।
শাফিন আহমেদ
হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, তবে প্রথম প্রথম স্কুলে সব শিশুরাই এরকম একটু আধটু ভয় পায় আবার কিছু কিছু এর ব্যতিক্রম, পরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়ার পরে ভয় কেটে যায় ।
অনেক ধন্যবাদ শামীম ভাই আপনাকে লেখা দুটো সময় নিয়ে পড়ার জন্য আর আমাকে এরকম উৎসাহ দেয়ার জন্য ।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি দেখছি এসেই, আসলাম, লিখলাম, মাত করে দিলাম!!
লেখা-সৌন্দর্য যে ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তাতে ব্রেভো বলতেই হচ্ছে।
লিখুন এবং লিখুন, সময়ের সুযোগ নিয়ে ব্যস্ততার ফাঁক গলিয়ে/বেড়া টপকে হলেও একান্ত নিজ আনন্দ-মনে,
পাঠক আপনার সাথেই থাকবে।
লেখার টুইষ্ট-টি সুন্দর হয়েছে।
এভাবেই রেহানারা হারিয়ে যায় সময়-স্রোতে।
শাফিন আহমেদ
অস্ংখ্য ধন্যবাদ সবসময় মন ভালো করে দেয়া মন্তব্য করার জন্য। সময় বের করে লেখার চেষ্টা অব্যহত থাকবে ।
নাজমুল হুদা
অবাক অবাক করেই বড় হয়ে যায় । শুধু রেহানা আপারা স্মৃতি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আরো কোনো অবাকের বাসায় বাসায়। তবুও রেহানা আপারা ভালো থাকুক সমাজে
দারুণ অনুভূতি ভালো লেগেছে
শাফিন আহমেদ
রেহানা আপারা এমনই হয়। তাদের ভালোবাসা আর ত্যাগ কখনো কারো চোখে পরেনা । ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য । শুভ কামনা ।
শিরিন হক
ভালো লাগলো।বেশি করে লিখুন।
শাফিন আহমেদ
চেষ্টা অব্যহত থাকবে । ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য ।
তৌহিদ
আপনি দারুন গল্প লিখেন শাফিন ভাই! আপনার এই ধারাবাহিক লেখার দুটো পর্বই পড়লাম। চমৎকার লেখনশৈলী আর দারুন শব্দচয়ন আপনার। সোনেলায় স্বাগতম জানাই।
রেহানারা আছে বলেই অবাকের মতন শিশুরা বেঁচে থাকার ভরসা পায়। গল্প ভালো লেগেছে ভাই। সোনেলায় লিখুন। আমরা আপনার লেখা পড়তে চাই।
শুভকামনা রইলো।
শাফিন আহমেদ
অসংখ্য ধন্যবাদ তৌহিদ ভাই আপনাকে দুটো পর্বই সময় নিয়ে পড়ার জন্য। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো সময় বের করে বেশি বেশি লেখার আর লেখার উন্নয়ন করার।
তৌহিদ
শুভকামনা ভাইগ্নাভাই ☺☺
সাবিনা ইয়াসমিন
একদম প্রথম ক্লাসে রোল এক হওয়াটা খুবই লজ্জাজনক,, সবার কত বেশি থাকে আর তাকে কেন এক দিবে!! বাচ্চাদের মনে এই ব্যাপারটা নিয়ে কত অভিমান হয়। যদিও পরে সে ঠিক বুঝে যায় এক হওয়া কত আনন্দ আর গর্বের। 😊😊
রেহানা আপার প্রতি অবাকের আচরন দোষনীয় ছিলো না। শিশুমনে তার তখন নিজের আত্মসম্মান বোধটাই প্রবল আকারে ধারন করা ছিলো। পরে কখনো তার মনে রেহানার আপার মায়াভরা ভালোবাসা অবশ্যই মনে পরবে। কারন স্নেহ-মমতার স্মৃতি কখনো বিলুপ্ত হয়না।
অসাধারণ লিখলেন। ভক্ত পাঠকের তালিকায় আমার নাম এখনই এড করে রাখুন। আপনার লেখা নিয়মিত পড়তে চাই। লিখুন বেশি বেশি করে। শুভ কামনা অফুরন্ত রইলো। 🌹🌹
শাফিন আহমেদ
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার মন্তব্য দেখেই বোঝা যায় আপনি কত সুন্দর করে খুঁটিয়ে লেখাটি পড়েছেন । আর অবশ্যই রেহানা আপার প্রতি অবাকের এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল, আমার মনেও এই বিষয়টা কাজ করেছিল যেটা আপনি সহজেই বুঝে গেলেন। শুভ কামনা আপনার জন্যেও , আপনার লেখাও বেশি বেশি পড়তে চাই।
মনির হোসেন মমি
খুব সুন্দর ভাবে সমাপ্ত করলেন। শিশু কিশোরদের নিয়ে এমন লেখা আরো চাই।
শাফিন আহমেদ
ধন্যবাদ মমি ভাই। ইন শা আল্লাহ্ চেষ্টা অব্যহত থাকবে ।
মনির হোসেন মমি
সোনেলায় আপনার এটা প্রথম লেখা।আমার কাছে কেবল মনে হচ্ছে সোনেলা আপনাকে পায়নি কেন আরো আগে। আপনার এ লেখাটি আমাদের ছোট শিশু কিশোর বেলার কথা মনে করে দেয় যা এখন আমার সন্তানদের মাঝে খুজে পাই। আর সাহিত্যাঙ্গনে শিশু কিশোরদের নিয়ে লেখা যত বেশী পাওয়া যাবে তত বেশীই আমাদের সন্তানরা উপকৃত হবে।
শাফিন আহমেদ
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাই। আমারো আফসোস হয় এই ভেবে যে, আগে আসলে সোনেলায় আমি আরো কিছু লিখে সংগ্রহ করতে পারতাম আমার জন্য আর পাঠকদের জন্য। হয়ত এতদিনে আপনাদের সবার লেখা পড়তে পড়তে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হতো লেখার কৌশল সম্পর্কে। অবশ্যই সময় বের করে লেখার চেষ্টা করবো এবং শিশু কিশোরদের নিয়েও লিখবো।
মনির হোসেন মমি
হুম শুভ কামনা রইল।
আরজু মুক্তা
আমার তো খুব ভালো লাগলো ছেলেটি একা একা কিছু করতে চায়। শিশুদের আত্ম সম্মান বোধ বেশি।প্রথম থেকে ওকো ছেড়ে দিলে ও আরও আত্মপ্রত্যয়ী হতে শিখতো।
বাহিরের শিশুরা নিজের কাজ নিজেই শিখে ফেলে।
আমরা পিছিয়ে থাকবো কেনো?
শুভকামনা
শাফিন আহমেদ
ওর মনের মধ্যে যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল সে জন্যেই ওর সাথে গিয়ে স্কুলে বসে থাকা লাগতো , পরে পরিবেশের সাথে মিশে ভয় কেটে গেছে।
জাহিদ হাসান শিশির
ওহ এটা শেষ পর্ব। প্রথম থেকে পড়তে হবে তাহলে।
শাফিন আহমেদ
অবশ্যই ভাই ।
জিসান শা ইকরাম
দুই পর্ব একসাথেই পড়লাম।
চমৎকার সমাপ্তি লেখাটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
লেখা চালু থাকুক।
শুভ কামনা।
শাফিন আহমেদ
অসংখ্য ধন্যবাদ দুটি পর্বই সময় নিয়ে পড়ার জন্য। নিজের কিছু ব্যস্ততার জন্য লেখার সময় বের করতে হিম শিম খাচ্ছি। খুব শীঘ্রই ফিরবো।