অবন্তিকা- ৪

অনন্য অর্ণব ৪ নভেম্বর ২০১৯, সোমবার, ০১:৩৪:৫০অপরাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

 

কত উত্থান কত পতন কত হাহাকার আর উল্লাস ঘন মুহূর্তের সমন্বয়ে সজ্জিত মানুষের জীবন। কখনো সফলতার চরম শিখরে কখনোবা পাহাড়সম সমস্যার অন্তরালে চাপা পড়ে মানুষ হারিয়ে যায় কালের অতল গভীরে। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, ভালো থাকার, ভালো রাখার- আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।

জীবনে চলার পথে একেকটা ধাপে মানুষ পরিচিত হয় সম্পূর্ণ অজানা অচেনা অন্য মানুষের সাথে। যেখানে স্বপ্নের সোনার কাঠি অবচেতন মনের দ্বার খুলে হাতছানি দেয় সেখানে সুতীব্র ব্যাঘ্র হুঙ্কার মনে হয় সুরেলা কন্ঠের মোহাবিষ্ট সুর। মানুষ মোহিত হয়ে ছুটে যায় ভয়াল সেই কালান্তরিত সুরের টানে।

অসাধ্যকে সাধন করা, দুর্ভেদ্য কে ভেদ করা দুর্গমতার প্রাচীর ভেঙে বিজয়ের নিশানা তুলে ধরা- এ সবিই যেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ চির নূতনের অভিসারে অনন্ত অভিযাত্রী। সৃষ্টির আদি হতে অদ্যাবধি মানুষ কেবলি অস্থির, কেবলি বিবর্তনের পক্ষপাতী। আর এই বিবর্তনের হাত ধরে আদিম পাহাড়ের গুহা থেকে মানুষ পৌঁছে গেছে আজকের আধুনিক সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে।

এটা সত্য যে সব কিছুরই রিভার্স মোশন আছে। আপনি যখন শুন্যে একটা তীর ছুঁড়ে মারবেন তখন সেই তীর ধনুকের কাছ থেকে প্রাপ্ত বলের শূন্য বিন্দুতে যাওয়া পর্যন্ত উপরে উঠতে থাকবে- তারপর আবার সে অভিকর্ষ ত্বরণের টানে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসবেই। স্যার আইজ্যাক নিউটন এর মতে প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

মানুষের যখন উত্থান শুরু হয় তখন সে উঠতেই থাকে, উঠতেই থাকে। দুনিয়ার কোন কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারে না। ছলে বলে কৌশলে মানুষ তার কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করবেই। বাট একটা সময় মানুষ খেই হারিয়ে ফেলে।
অতীত ভেসে উঠে বর্তমানের আয়নায়, মানুষ ফিরে যায় বিদঘুটে কালো অন্ধকার অতীতের গহ্বরে। তারপর আবার ফিরে আসে বর্তমানে, মানুষ দেখতে পায় অতিদূর ভবিষ্যত এবং নিথর নিস্তব্ধ একটা শবদেহ।

কারো কারো ক্ষেত্রে তখনই অনুশোচনার শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ সেটা আয়নার প্রতিবিম্ব ভেবে এড়িয়ে যেতে চায়। কালের পরিক্রমায় কেউ সেটা মনেই করতে চায় না যতোক্ষণ পর্যন্ত হৃদস্পন্দন সক্রিয় থাকে। সবাই তো আর একই চিন্তা চেতনার হয় না।

হোটেলের বারান্দায় পায়চারী করতে করতে নিজের অজান্তেই অবন্তিকা ফিরে যায় অল্প-দূরের অতীতে। এইতো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটা চাকরির জন্য প্রথম ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো একটা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানিতে। তার প্রার্থীত পদটি ছিলো হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার। কোম্পানির এমডি নিজেই নাকি সাক্ষাৎকার নিবেন।

কি জানি হয়, কি প্রশ্ন করে কয়টা প্রশ্ন করে- সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো কি না এসব ভাবতে ভাবতে আগের রাতে অবন্তিকার ঘুমই হলো না। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে একগ্লাস ঠান্ডা পানি আর এক কাপ চা খেয়েই বের হয়ে গেলো অবন্তিকা। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা গুলশান দুই নাম্বারে অফিস। সকাল দশটায় ইন্টারভিউ থাকলেও মরার ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়ে অবন্তিকা পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে দশটা ছুঁই ছুঁই। হন্তদন্ত হয়ে অফিসের নিচে গিয়ে পৌঁছল অবন্তিকা।

গেটে ঢুকতেই উর্দি পরা এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাবেন?

অবন্তিকা সালাম দিয়ে সবিনয়ে বলে -
আমি অবন্তিকা। অবন্তিকা চৌধুরী। জনাব মুহিত চৌধুরীর সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে সকাল দশটায়।

উর্দি পরা লোকটা হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলে-
ম্যাডাম এখনতো সাড়ে দশটা বাজে। আপনি ইন্টারভিউর দিনেই আধাঘণ্টা লেট।

অবন্তিকা বুঝতে পারে না তার এখন কি বলা উচিত?
এই লোকটাই বা কে? দারোয়ানের মতো ইউনিফর্ম পরা থাকলেও দারোয়ান যে নয় এতে কোন সন্দেহ নেই। ফ্রন্ট ডেস্কে বসা দুজনের গায়ে ও একই ইউনিফর্ম। তাছাড়া এই লোকের চেহারার গঠনে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। এই লোক কখনোই দারোয়ান হতে পারে না।

অবন্তিকা আবারো সবিনয়ে বলে- সরি স্যার আই নো দ্যাট আই হ্যাভ থার্টি মিনিট লেট। বিকজ দেয়ার ওয়াজ হেভি ট্র্যাফিক ইন দ্যা রোড। মে আই অ্যালাউ টু মাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট অর....

অবন্তিকার কথা বলার দৃঢ়তা দেখে সেই ভদ্রলোক সম্ভবত কিছুটা হাল্কা হওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর ফ্রন্ট ডেস্কের একটু দূরে সোফায় বসতে বলে নিজেও আরেকটা সোফায় বসলেন। তারপর অবন্তিকার কাছে জানতে চাইলেন-

আপনি তাহলে মানব সম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতে চাচ্ছেন?
অবন্তিকা সম্মতি সূচক জবাব দেয়- জ্বী স্যার ।

আপনার একাডেমিক পারফরম্যান্স দেখলাম। বেশ ভালো করেছেন। ফ্যামিলিতে কে কে আছেন?

জ্বী ধন্যবাদ স্যার। ফ্যামিলিতে আমি, আমার মা, তিন ভাই আর দুই বোন। ভাই বোনেদের মধ্যে আমি সবার ছোট।

আপনার বাবা নাই ?

না স্যার। বাবা গত হয়েছেন চার বছর আগে।

সো স্যাড। আপনার পার্সোনাল ভিউ কি ? আই মিন আপনি কি করতে চান? যদি এই কোম্পানিতে আপনার চাকরি হয় তো কোম্পানির স্বার্থের জন্য আপনি কতটা কি করতে পারবেন?

অবন্তিকা একটু ঘোরের মধ্যেই পড়ে যায়। মনে মনে ভাবে এই ব্যাটা তুই কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিস নাকি যে তোর কাছে সব বলতে হবে ? আমি এইচ আর ম্যানেজার পদের জন্য দরখাস্ত করেছি। চাকরি হলে আমি হবো তোর বস। আর তুই কিনা আসছিস আমার ইন্টারভিউ নিতে? সাহস কতো ব্যাটার ?

চৌধুরী সাহেব অবন্তিকার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চোখে চোখ রাখে। বুঝতে পারে অবন্তিকা তাকে এসব বলতে চায় না। চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞেস করে- কি ভাবছেন ?

না কি কিছু না স্যার।

কিছু না মানে কি? কিছু তো অবশ্যই ভাবছেন। আমি জানি আপনি কি ভাবছেন? আপনি ভাবছেন আমি কেন এসব প্রশ্ন করছি তাই না?

অবন্তিকা তথমত খেয়ে বলে না স্যার কি যে বলেন। আপনি নিশ্চয়ই এই প্রতিষ্ঠানের এমন কেউ একজন যিনি আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার রাখেন।

- তা হয়তো ঠিক বলেছেন। যা হোক, আপনার জ্ঞাতার্থে একটা কথা বলে রাখি- এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা খুব সহজ আবার খুউব কঠিন ও বটে। আপনি কি পারবেন সবসময় সর্বাবস্থায় উপর মহলকে সন্তুষ্ট করতে? অবশ্য এখানে এইচআর অফিসারের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। এমডি নিজেই ওসব দেখতে পারেন। তবে অফিসের একটা পোস্ট খালি থাকলে কেমন দেখায় না?

তাই একজন কাউকে নিয়োগ দেয়া আর মাঝেমধ্যে এমডির মনোরঞ্জনের জন্য ও কাউকে হাতের কাছে পাওয়া। অবশ্যই এটা হাই ডিমান্ড পে-এবল। আমি শুনেছিলাম আপনার আগে যিনি এই পোস্টে ছিলেন তাকে নাকি তার প্রথম ডেটিংয়েই একটা লাখ টাকার হীরের নেকলেস গিফট করেছে।

লজ্জায় ঘৃণায় সদ্য ইউনিভার্সিটি ছেড়ে আসা অবন্তিকার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো না এই জানোয়ারকে এখন কি বলা উচিত? পা থেকে জুতো খুলে সমান তালে ওর দুই চোয়ালে মারবে না কি করবে অবন্তিকা কিছুই ভাবতে পারছে না।

ওদিকে অবন্তিকা এটাও জানে তার এখন কিছু একটা করা খুব জরুরি। ঘরে বৃদ্ধা মা, এতো দিন বাবার পেনশনের টাকায় সে পড়াশোনা করেছে। এখন পড়াশোনা শেষ। নিজেকে তো কিছু করতেই হবে। আর কতোদিন মায়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে ? তাছাড়া একটা অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি তো আছেই। জীবনে চলতে গেলে টাকার বিকল্প নেই। টাকার গায়ে বৈধ অবৈধ হারাম হালাল লিখা থাকে না। টাকা যখন যার তখন তার কথাই শোনে।

অবন্তিকার লজ্জায় লাল হওয়া মুখের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চৌধুরী সাহেব বললেন, সরি আমি মনে হয় বেশি বলে ফেললাম। মাপ করবেন- আপনার সমস্ত কাগজপত্র দেখেছিলাম তো। দেখে মনে হলো আপনি খুবই মেধাবী। আপনার সামনে একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত পড়ে আছে। কে বলে আজ আপনি যেই প্রতিষ্ঠানের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন একদিন এই প্রতিষ্ঠানের আপনি একজন গর্বিত এমডি হবেন না? কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি অর্জন করতে পারলে এখানে প্রমোশন খুব তাড়াতাড়ি হয়।

যাই হোক এ কথা বলে চৌধুরী সাহেব পাশের রুমে ঢুকে গেলেন। অবন্তিকা মিনিট পাঁচেক বসে থেকে যখন চলে যাবে তখনই তার সেল ফোনে একটা কল আসে। এটা চৌধুরী সাহেবের নাম্বার, অবন্তিকা আগে থেকেই জানতো। সালাম দিয়ে অবন্তিকা কিছু বলার আগেই চৌধুরী সাহেব বললেন অবন্তিকা আপনার ইন্টারভিউ শেষ। আপনার চোখের ভাষায় আমি বুঝতে পেরেছি আপনি চাকরিটা করতে চাচ্ছেন। আজ সন্ধ্যায় হোটেল ওয়েস্টিনে আসবেন আপনার সারপ্রাইজ গিফট আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে যাবেন।
আগামীকাল থেকে আমাদের বনানী অফিসে আপনি অফিস করবেন। না চাইলে আমাকে টেক্সট করতে পারেন। ধন্যবাদ।

অবন্তিকা সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলো পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে কতটা লড়াই করে বাঁচতে হবে। তারপর টানা দু'বছর ঐ কোম্পানিতে চাকরি করেছিলো অবন্তিকা। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন চৌধুরী সাহেবের মনোরঞ্জক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে হতো। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল কোম্পানির মার্কেটিং এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের প্রধান তারেক ভূঁইয়ার সাথে। অবন্তিকার জীবনে প্রথম অবৈধ পথে আসা বৈধ পুরুষ এই তারেক।

ভাবতে ভাবতে অবন্তিকা রুমে এসে সোফায় গা এলিয়ে বসে। গতকাল জার্নি করে আসার কারণে রাতে আর কোথাও বের হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দশটা বেজে গেছে। বিছানায় থেকেই সে দেশে ফোন করে মেয়ের সাথে কথা বলেছে। খোঁজ খবর নিয়েছে মায়ের ও। তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তার অর্ডার করে ভেবেছিল ফার্নান্দেজ উঠেছে কিনা একটু খবর নেবে। কিন্তু সে কি ভাববে তাই আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।

অবন্তিকা ভাবলো আজ একটু বের হবে। প্রথমে বীচে যাবে। তারপর একটু শপিং করতে যাবে। দেন সন্ধ্যায় সুযোগ থাকলে হাল্কা ড্রিঙ্কস করবে। অবশ্য ফার্নান্দেজ যদি কোন মিটিং কল না করে তবেই এসব করার সুযোগ পাবে। ভাবতে ভাবতেই ফার্নান্দেজ ফোন করলো-

হেলো অবন্তিকা, হাউ আর ইউ ?

ইয়েস জোসেফ আই অ্যাম ফাইন। হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?

ফাইন,,,ফাইন। সো.. হোয়াট, হ্যাভ ইউ এনি প্ল্যান টুডে ?

নো অ্যাক্সুয়ালি আই হ্যাভ নো স্পেশাল আউটডোর টুডে। বাট ইফ ইউ ওয়ান্ট টু গীভ মী কম্পানি টু সী সামথিং ইন বীচ ড্রাইভ ওয়ে ওর নিয়ারবাই শপিং মল ওর ফ্যামাস রেস্টুরেন্ট হা হা হা। দেন আই মে গো...অবভিয়াসলি ইফ ইউ হ্যাভ মোর টাইম স্যার।

ওকে ওকে। গেট রডি আপটারনূন এট ফোর পিএম। উই উইল গো এজ ইউ ওয়ান্ট লেডী। সী ইউ সুন। বাই।

অবন্তিকা ও বাই বলে ফোন রেখে দেয়। তারপর সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা বিলেতী মানুষের উত্তর বাহু ধরে সিঙ্গাপুরের বীচ ড্রাইভ ওয়েতে হেঁটে যাওয়ার কল্পনা করতে করতে কোথায় যে হারিয়ে যায় অবন্তিকা নিজেও জানে না।

© অনন্য অর্ণব
উত্তরা, ঢাকা
২৯/১০/২০১৯

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ