অবন্তিকা- ৩

অনন্য অর্ণব ৩ নভেম্বর ২০১৯, রবিবার, ০৬:৫৯:২৭পূর্বাহ্ন গল্প ২৬ মন্তব্য

 

জোসেফ ফার্নান্দেজ। আমেরিকার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত শিকাগো শহরের পশ্চিমাংশের একটি ছোট্ট ছিমছাম সাজানো গ্রাম ওক পার্কে যার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। জন্মের আগেই তার আইরিস বাবা তার মাকে ছেড়ে স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। লেডি জেনিফার যখন জোসেফ কে জন্ম দিলেন তখন তিনি একটা এশিয়ান মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ থেকে আসা যে মানুষটার অধীনে তিনি কর্মরত ছিলেন তার অসামান্য মানবিক গুণাবলী লেডি জেনিফার কে মুগ্ধ করে।

১৯৮১ সালের পহেলা মে। সমগ্র শিকাগো শহর জুড়ে থমথমে অবস্থা। কিছুদিন ধরে এখানকার শ্রমিক সংগঠন গুলো খুব জোর দিয়ে মে দিবসের প্রচার প্রচারণা করতে দেখা গেছে। এবার তারা শিকাগোতে অবস্থিত আইএলও অফিস ঘেরাও করার ঘোষণা দিয়েছে। অধিকাংশ কল কারখানা অফিস হোটেল বার রেঁস্তোরার মালিকরা আইএলও কর্তৃক নির্ধারিত শ্রম আইন মেনে চলে না।

শ্রমিক ইউনিয়ন গুলোর পক্ষ থেকে এই বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে চাপ দেওয়ার জন্য আইএলও কে বারবার স্মারক লিপি দেওয়া স্বত্ত্বেও তারা কোন প্রকার পদক্ষেপ নেয়নি। এই মর্মে তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা এবারের শ্রমিক দিবসে আইএলও অফিস ঘেরাও করবে। এবং এই সংক্রান্ত বিস্তারিত লিখে লিফলেট ও বিতরণ করতে দেখা গেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের আচার আচরণ পোশাক-আশাক সহ যাবতীয় জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্য থাকলেও একটা জায়গায় সবারই মিল আছে। মানব দেহের জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার কখনো কোন তারতম্য ঘটেনি। দুনিয়ার তাবৎ মানবজাতি একই সূত্রে গাঁথা জৈবিক গঠনে গঠিত। চাই জাপান বলো আর আমেরিকা। সর্বত্রই মানুষ দুটি নির্দিষ্ট ক্রোমোজোমের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলাফল মাত্র।

নারীর প্রসব যন্ত্রণা বাংলাদেশে যতটা অনুভূত হয় উন্নত বিশ্বের আধুনিক সভ্য সমাজে তার চেয়ে একটুও কম হয় না।কারণ পার্সিয়ালিটি কথাটা প্রকৃতির অভিধানে অনুপস্থিত। প্রকৃতির কাছে সবাই সমান। অন্ধ বধির কালো কুৎসিত আর যোগ্যতা অযোগ্যতা এসব কেবল মানুষের পার্থিব বৈসাদৃশ্য মাত্র। প্রকৃতি তার প্রতিটি সন্তানকে সম-স্নেহে সমাদৃত করে।

সেদিন খুব ভোরে জেনিফার তার প্রথম সন্তানের প্রসব বেদনা অনুভব করে। যতো সময় গড়িয়ে বেলা বাড়তে থাকে ততই জেনিফারের তলপেটের ব্যথাও বাড়তে থাকে। একা জেনিফার বুঝে উঠতে পারে না তার এখন কি করা উচিত। তার বাড়ি থেকে ওক পার্কের আউটার ওয়ে প্রায় পাঁচশো গজের একটা স্বল্প পরিসরের দূরত্ব। দূরের রাস্তায় শ্রমিকদের ঝাঁঝালো স্লোগান সমৃদ্ধ মিছিলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

জেনিফার তার রেস্তোরাঁর মালিক কে ফোন করে সবকিছু খুলে বলেন। সবিস্তারে শোনার পর মিস্টার আশ্রাফ চৌধুরী নিজের গাড়ি নিয়ে চলে আসেন তার বাড়িতে। সাথে মিসেস আশ্রাফকেও নিয়ে আসেন। তারপর দু'জন মিলে জেনিফার কে নিয়ে যান ইলিনয়ের সবচেয়ে পুরোনো আর বিখ্যাত রাশ ইউনিভার্সিটি এন্ড মেডিকেল সেন্টারে। সেখানেই জেনিফার জন্ম দেন তার নারী জীবনের প্রথম সনদ এই জোসেফ ফার্নান্দেজ কে। টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির দ্বিতীয় দশকে এসে আজ সেই ফার্নান্দেজ দুনিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক জায়ান্ট সানহেইট এর চীফ।

ছোট বেলায় ফার্নান্দেজ তার মায়ের সাথে প্রায়ই লেক মিশিগান এর তীরে বেড়াতে যেতেন। সানডে ছিলো ফার্নান্দেজ এর খুব প্রিয় একটি দিন। এই দিন মা ছেলে মিলে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো শিকাগোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ট্যুর এলাকা লেক মিশিগান এর নেভী পিয়ার -এ। এটা সেটা কেনাকাটা কখনো মিলেনিয়াম পার্ক, কখনো বা ক্লাউড গেইট হয়ে বিকেলে মিশিগানের ঠান্ডা বাতাসে বসে জেনিফার তার কিশোর ছেলেকে গল্প শোনাতেন।

বাবা ক্রিস্টোফার ফার্নান্দেজ এর হিপোক্রেট আচরণ আর তার বাঙালি প্রভু মিস্টার আশ্রাফ চৌধুরীর অসাধারণ জীবন পরিক্রমায় অনন্য মানবিকতার গল্প। জেনিফার তার ছেলেকে বলতেন কিভাবে একজন মানুষ তার জন্মভূমি ছেড়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কতটা অদম্য স্পৃহা আর অটল লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলে এমন সফল হওয়া যায় সেই সব গল্প বলতেন।

জেনিফার তার কর্মজীবনে আশ্রাফ চৌধুরীর মানবিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য সে নিজেও বাংলা ভাষা শিখেছেন এবং তার ছেলে কিশোর ফার্নান্দেজ কে ও বাংলা ভাষা শিখিয়েছেন। কিন্তু কর্তব্যের ক্ষেত্রে পাষাণ সদৃশ আশ্রাফ চৌধুরী কখনোই জেনিফার এর আবেগের কাছে ধরা দেননি। তিনি জেনিফার কে বলেছিলেন যে, জেনিফার যদি চায় তো সে অন্য কাউকে পছন্দ করতে পারে। তাতে মিস্টার চৌধুরী তার সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতা করবে।

নানান ভাবে চেষ্টা করেও যখন জেনিফার দেখলো যে সে এক অবাস্তব স্বপ্নে বিভোর, যা কখনোই হবে না তখন সে তার রাস্তা থেকে সরে আসে। তার ভুল বুঝতে পারে এবং বাকী জীবনে এই মানুষটার প্রতি তার হৃদয়ে যে প্রেমের আবির্ভাব হয়েছিল সেই প্রেমের আরাধনা করেই কাটিয়ে দেন। এই আশ্রাফ চৌধুরীর অসামান্য অবদানের উপর ভর করেই সেদিনের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ থেকে নিজেকে এবং ছেলেকে টেনে বের করে এনেছেন জেনিফার।

মায়ের মুখে বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতির এত্তো প্রশংসা শুনতে শুনতে রোবটিক চরিত্রের ফার্নান্দেজ ও তার হৃদয়ের বাম অলিন্দে বাঙালিদের জন্য একটা সফট কর্ণার আবিষ্কার করে ফেললেন। নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে সেই কোমলতা কখন যে এতোটা পাকাপোক্ত দেয়াল দ্বারা সংরক্ষিত হয়েছে তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে নি। তারপর যখন কর্মজীবনে এসে আমেরিকার বাইরের মানুষদের সাথে তার বিভিন্ন সময় উঠা বসা করতে হয়েছে তখন সে আনমনে হয়তো এমন একটি সুন্দর মুহূর্তের জন্যেই অপেক্ষা করেছিলো।

চাঙ্গি বিমানবন্দর থেকে অবন্তিকাকে নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে হোটেল মারিয়ানা বে স্যান্ডস এ গিয়ে পৌঁছতে সময় লাগলো মাত্র পঁচিশ মিনিট। এই পঁচিশ মিনিটে তারা দুজনের কেউ একটাও কথা বলেনি। অবন্তিকা মাঝে মাঝে দক্ষিণের সাগরের দিকে তাকালেও একবার ও পাশের সিটে বসা তার বসকে তাকিয়ে দেখেনি। কিন্তু পুরোটা পথেই তার মন পড়ে ছিলো এই সুদর্শন যুবকের কাছে। কেমন হবে এই মানুষটার সাথে মিটিং।

এর আগে অসংখ্য দেশী বিদেশী সিনিয়র জুনিয়র মালিক অধীনস্থ অনেকের সাথেই অসংখ্যবার বিভিন্ন বিষয়ে মিটিং করতে হয়েছে। কত কত মিটিং শেষে বসের অনুরোধে অবন্তিকা কে মদপান করতে হয়েছে। কখনো বা বস-এর সু-দৃষ্টির জন্যে ড্রিঙ্কস করে রাতে বিছানায় গা এলিয়ে শুইতে হয়েছে।

প্রথম প্রথম ঘেন্না লাগতো, বমি আসতো। কখনো কখনো সেন্সলেস ফিল হতো। সারারাত ধরে একটা অপরিচিত অচেনা অজানা মানুষের শরীরের শ্লেষ্মা নিজের দেহাভ্যন্তরে নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছে নির্বিবাদে। সহস্র সংকোচ আর ভয়কে সাফল্যের সিঁড়িতে রূপান্তর করতে জীবনে কত কি না করেছে এই অবন্তিকা। সেই ধারাবাহিকতার কথা মাথায় রেখেই আজকের এই সিঙ্গাপুর ট্যুর। অথচ এ কেমন মানুষ যে অবন্তিকার এতো কাছে থাকা স্বত্বেও একবার ও ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো না। তার শরীরের রূপের প্রশংসা করলো না। প্রথম দেখাতেই একটা সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস টেনে অবন্তিকার শরীরের গন্ধ অনুভব করেনি এমন তো আজ অবধি এই প্রথম।

হোটেলের পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে, নিজেই নেমে গিয়ে অবন্তিকার দরজা খুলে দিল ফার্নান্দেজ। ব্যাক ডোর ওপেন করে লাগেজ নিয়ে অবন্তিকাকে বললো- লেটস গো টু রিসেপশন ফার্স্ট। আফটার রিপোর্টিং ইউ মে গো টু ইউর স্যুইট বিসাইডস মী এট সেভেন্থ ফ্লোর। স্যুট ৭১৩ ইজ রিজার্ভড ফর ইউ।

লিফট থেকে বেরিয়ে অবন্তিকাকে তার রুমের দরজা খুলে দিয়ে ফার্নান্দেজ বললো, প্লীজ আফটার রিফ্রেশিং টেক সাম রেস্ট। উই হ্যাভ নো মিটিং টুডে। ইফ ইউ ওয়ান্ট ইউ মে গো আউট টু ভিজিট দ্যা সিটি। ইফ এ্যানি ইমার্জেন্সি দেন মেক এ কল টু মী। থ্যাঙ্ক ইউ।

অবন্তিকা তার রুমে প্রবেশ করে। প্রথমেই ফ্রেশ হয়ে। তারপর একটা ব্ল্যাক কফির অর্ডার করেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। একটা বিষয় তার কোনো মতেই হিসাবে মিলছে না। জোসেফ ফার্নান্দেজ এর সাথে তার মিটিং তো আরো দুদিন পর। তাহলে এতো তাড়াতাড়ি তাকে কেন আসতে বলা হলো?

কোম্পানীর উপর মহল থেকে ফার্নান্দেজ কি একাই আসছে এখানে? নাকি আরো কেউ আসছে। হোটেলের রিসেপশন এর লগ বইতে তার নামের আগে পিছে আরো চারজনের নামে চারটা স্যুট বুক করা দেখলো। তার মধ্যে একটা জোসেফ ফার্নান্দেজ এর নামে। আর বাকী যে তিনটা ওরা মনে হচ্ছে এখনো রিপোর্ট করে নি। তাহলে ওরা এখনো এসে পৌঁছায় নি?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কলিং বেলের মৃদু শব্দে সম্বিত ফিরে পায় অবন্তিকা। ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। অবন্তিকা কফি খেয়ে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে একটা বাংলা চ্যানেল সেট করলো। ওখানে গান হচ্ছিলো। বিখ্যাত শিল্পী কুমার শানুর কন্ঠে সেই গানটা...

এ জীবন কেন এতো রং বদলায়....

অনন্য অর্ণব
নিকেতন, গুলশান, ঢাকা
২৪/১০/২০১৯

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ