খুব সকালে না গেলে সাতছড়ি টাওয়ার থেকে ছবি পাওয়া যায় না। পূব আকাশে সূর্যের আলো ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাখিদের কল-কাকলিতে ভরে ওঠে চারপাশ। এসময় নানা প্রজাতির পাখি খাবারের সন্ধানে বের হয়। সে কারণে সকাল ৭টায় টাওয়ারে উঠে গেলাম। একটানা ছবি তুলে টাওয়ার থেকে যখন নামলাম তখন মধ্যদুপুর।

সাতছড়িতে যেমন থাকার ভালো জায়গা নেই, একইভাবে খাবারের সমস্যায়ও পড়তে হয়। থাকার জন্য সহায় একমাত্র বন বিভাগের ডরমেটরি। খাওয়ার জন্য মাওলানা আব্দুল কাইউম হুজুরের মোস্তাক হোটেল। সেখানেও আগে থেকে খাবারের কথা বলে রাখতে হয়। অগত্যা সেখানেই গেলাম খাবার খেতে। এরপর ফিলে এলাম ডরমেটরিতে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম বনের ভিতর পুকুরপাড়ে। শুস্ক মৌসুমে বন্যপ্রাণী আর পাখিদের পানির তেষ্টা মেটাতে গহীন বনের ভিতর ছোট্ট একটি গর্ত খনন করেছিলেন তৎকালীন বনের রেঞ্জার প্রয়াত মনির খান। সেই গর্তটি এখন ছোট্ট একটি পুকুরে রূপ নিয়েছে। পুকুরের চারধারে ঘন ঝোঁপ। নানা প্রজাতির পাখি দিন শেষে পুকুর পাড়ে আসে পানি খেতে ও গোসল করতে।

ঝোপের ভিতর নিজেদের লুকিয়ে বসে আসি। সবাই চুপচাপ। কারো সঙ্গে কারো কথা নেই। এখানে বসেই কয়েক প্রজাতির বুলবুলি, উদয়ী দুধরাজ, নীল রাজা, সবুজ ঘুঘু ও কেশরী ফিঙ্গেসহ বেশ কিছু পাখির ছবি তুললাম। এরই মাঝে পুকুরের পাড়ে হেলানো বাঁশের কঞ্চির উপর এসে একটি পাখি বসলো। দেখামাত্র বেশ কিছু ছবি তুললাম। কিছুক্ষণ পর পানি পানের জন্য পাখিটি মাটিতে নামলো। এর আগে পাখিটি কখনো দেখিনি। চড়ুই থেকে ছোট আকারের পাখি, দেখতে এত সুন্দর যে মন কেড়ে নেয়। মাথার চাঁদি নীল ও পেট শিয়ালের রং। পরে জানতে পারি এই পাখির পরিচয়।

‘শিয়ালেবুক নীল চটক’ Muscicapidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত কমলা বা বাদামি পেট ও কালো চোখের ১৫ সে.মি. দৈর্ঘ্যের পোকা-শিকারী পাখি। ওজন ২১-২২ গ্রাম। পুরুষ পাখির পিঠের দিক কালচে নীল রঙের। দেহের নিচের দিক কমলা। কপাল কালো। মাথা বেগুনে-নীল। মাথার চাঁদি, ঘাড়ের পাশ, কাঁধ ও কোমর উজ্জ্বল নীল বর্ণের। শরীরের নীচের অংশ অনেকটা কমলা। ঠোঁট কালো ও ছোট। পুরুষ ও স্ত্রী পাখির চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। মেয়েপাখির পিঠের দিক ও নিচের দিক জলপাই-বাদামি রঙের। কপাল কমলা-পিতাভ। ডানা ও লেজ লাল। গলার নিচের অংশ সাদা। তবে পুরুষ ও স্ত্রী পাখির চোখ বাদামি। ৩টি উপপ্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে Niltava sundara পাওয়া যায়।

শিয়ালেবুক নীল চটক  সাধারণত পত্রবহুল বৃক্ষতলের গুল্মলতা, গভীর ঝোপ, পাতাযুক্ত দেবদারু বনে বিচরণ করে। এরা সচরাচর একা থাকে। কৃষি ক্ষেতে বা ক্ষেতের ধারের গাছের তলে জন্মানো গুল্মলতায় খাবার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পিঁপড়া ও নানা জাতের কীট-পতঙ্গ। শীত মৌসুমে রসালো পাকা ফল খায়। এরা অনবরত লেজ ঘুরায় ও লেজ মেলে ধরে। এপ্রিল ও মে মাস এদের প্রজননের সময়। প্রজননকালে পাহাড়ের শিলার গর্তে বা ফাটলে শেওলা দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখি ৩-৫টি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়ে পাখি মিলে ডিমে তা দেয়। ১২-১৫ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। বাবা ও মা উভয়েই বাচ্চা লালন করে।

শিয়ালেবুক নীল চটক বাংলাদেশে দুর্লভ পাখি। শীতে সিলেট বিভাগের চিরসুবজ বনে মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, তিব্বত, থাইল্যান্ড ও লাওসসহ দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিচরণ রয়েছে।

বাংলা নাম: ‘শিয়ালেবুক নীল চটক

ইংরেজি নাম: Rofous bellied Niltava

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ