অন্তরালের সে – ২

দিপালী ২২ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:০৬:৫১পূর্বাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

... ... নিতুকে আমি ছোট বেলা থেকেই চিনতাম। মায়ের এক বান্ধবীর মেয়ে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হত। তাছাড়া মাঝে মাঝে আন্টির সাথে আমাদের বাসায়ও বেড়াতে আসত। তখন নিতুর প্রতি কোন রকম আকর্ষণ বা অন্য রকম কিছু লাগত না। এরপর আঙ্কেলের ট্রন্সফার হয়ে গেলে নিতুরা চিটাগাং চলে যায়।

চিটাগাংই নিতু লেখাপড়া করে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর নিতুর সাথে আমার আবার দেখা হয় ইউনিভার্সিটিতে। আমার দুজনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে ভর্তি হই। আমরা সমবয়সী ছিলাম। চুলচেরা হিসেবে নিতু আবার বয়সে আমার চেয়ে সাত মাসের বড়। মায়ের প্রথম আপওিটা ছিল এই বয়স নিয়ে।

মৌটুসি দম বন্ধ করে রাতুলের কথা শুনছিল। রাতুল থামতেই মৌটুসি বলল-

: আজকাল বয়স নিয়ে কেউ কি এতটা মাথা ঘামায়? সমবয়সী এমন কি বেশি বয়সী মেয়ে হলেও কেউ কিছু মনে করে না। নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়াটাই মূল কথা।

: নিতুর গায়ের রং শ্যামলা। মা চাইতেন তাঁর একমাত্র পুত্রবধুটি হবে সুন্দরী। আমাদের দেশে সৌন্দর্যের প্রথম মাপকাঠি হল গায়ের রং। বয়স আর গায়ের রঙ নিয়ে মায়ের সাথে আমার মতামত, পছন্দের অমিল থাকলেও নিতুর প্রতি আমার ভালবাসাটা যে অকৃত্রিম ছিল, নিতুকে যে আমি প্রচন্ডভাবে চাইতাম সেটি মা বুঝতেন। তাই আমিও জানতাম মা এক সময় নিতুকে তাঁর ছেলের বউ হিসেবে গ্রহন করবেন। কিন্তু বিপওিটা হলো অন্য জায়গায়?

: সেটি কি?

: নিতুর প্রথম থেকেই পিরিয়ডের সময় প্রচন্ড ব্লিডিং আর পেইন হতো। মাস চারেক আগে নিতুর ইউটেরাসে টিউমার ধরা পরে। টিউমারটা বেশ বড় ছিল। অনেক চেষ্টা করার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। নিতুর হিস্ট্রেকটমি করতে হয়েছে। নিতু কখনই মা হতে পারবে না। মায়ের ছেলের কোন বংশধর থাকবে না। এটি মা কোন ভাবেই মেনে নিতে চাইলেন না। আমি মাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। সন্তান অ্যাডপশন নেবার কথা বলেছি কিন্তু মা কিছুতেই তা মেনে নিলেন না।

: তাহলে শুধু মাত্র সন্তানের জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন?

: না মৌ! একদম না। আমার কাছে বিয়ে মানে শুধু সন্তান জন্ম দেয়া নয়। বিয়ে মানে শুধু সামাজিক বন্ধনও নয়। বিয়ে মানে ধর্মীয় আচারও নয়। আমার কাছে বিয়ে মানে নতুন আর একটি জীবন।

আবেগে মৌটুসির হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাতুল। সেই স্পর্শে নির্ভরতার ছোয়া অনুভব করে মৌটুসি। রাতুলের চোখে মুখে দেখতে পায় সততা।

রিসিপশনের পরদিন মৌটুসিকে নিয়ে থাইল্যন্ডে হানিমুন করতে যায় রাতুল। হানিমুনের সকল ব্যবস্থা রাহেলা বানুই করে রেখেছিলেন। তিনি চান রাতুল মৌটুসি এক সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাক। এতে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে অনেক সহজ হবে।

বিয়ে হানিমুন সব মিলিয়ে তিন সপ্তাহের ছুটির পর আজই অফিস যাচ্ছে রাতুল। মৌটুসি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি গুছানো স্বভাবের একটি মানুষ। অল্প সময়ের মধ্যে রাতুলের সাথে নিজেকে কেমন মানিয়ে নিয়েছে। মৌটুসিকে নিয়ে রাহেলা বানু ভীষণ রকমের খুশি। মাকে খুশি দেখলে রাতুলের চাওয়ার আর কিছুই থাকে না।

মাস ছয় যেতে না যেতেই নতুন অতিথি আগমনের খবর পেলেন রাহেলা বানু। এতটা তাড়াতাড়ি এমন খবরের একদমই আশা করেননি তিনি তাই একটু অবাকই হলেন। মৌটুসি নিজেও এত তাড়াতাড়ি মা হতে চায়নি। সে চেয়েছিল আগে এমবিএ টা শেষ করতে কিন্তু রাতুল কেন জানি খুব করে বাচ্চা চাইছিল। রাতুল মাকে খুশি দেখতে চায়। রাতুল চায় মা তার অবসর সময় টুকু নাতি নাতনী নিয়ে আনন্দে মেতে থাকুক।

আলট্রা সাউন্ড করে দেখা গেছে মৌটুসির টুইন বেবী হবে। পরিচিত করো টুইন বেবী নেই তাই ব্যাপারটা অনেকটাই নতুন রাতুলের কাছ। ইদানিং অফিস ছুটির পর সোজা বাসায় চলে আসে রাতুল। মৌটুসির যত্ন করার চেষ্টা করে। কিন্তু মৌটুসি নিজের ব্যাপারে খুব উদাসীন! সারাদিন ঘর কন্যার কাজে ব্যস্ত থাকে। এ সময় এসব করতে রাহেলা বানুও খুব করে মানা করেছেন মৌটুসিকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

শেষ মূহুর্তে গাইনকোলজিস্ট মৌটুসির একটা সনোগ্রাফি করতে বলেছেন। তাই আজ অফিস থেকে একটু আগেই বাসায় এসেছে রাতুল। মৌটুসি রেডি হচ্ছে। রাতুল খাটের উপর আধ শোয়া হয়ে বসে আছে।

: মৌ।

: হুম।

: হলো তোমার?

: এই আর একটু।

: ঐ আলমারির ভিতর ঢুকে সেই তখন থেকে কি এত করছ?

: আছে,আছে গোপন ব্যাপার তোমাকে বলা যাবে না।

: তাই নাই! আমাকে বলা যায় না এমন কিছুও আছে নাকি?

: রাগ হল নাকি! আসলে তেমন কিছু না। তুমি জানতে চাইলে বলতে পারি।

: তুমি বলতে চাইলে শুনতে পারি।

: তুমি তো জান আমি মধ্যবিও পরিবারের মেয়ে। আমার মা সব সময় নানা ভাবে সঞ্চয় করতেন। তার মধ্যে একটি হলো আলমারির বিভিন্ন শাড়ীর ভাজে টাকা লুকিয়ে রাখা।

: তাই নাকি! তাহলে তো তোমার আলমারি গুপ্ত ধনে ভরা।

: হুম, অনেকটা তাই। প্রতি সেলফেই কিছু না কিছু গুপ্ত ধন সুরক্ষিত আছে।

: বুঝেছি। এবার চল। দেরী হয়ে যাচ্ছে।

সময়ের দুই সপ্তাহ আগে সি-সেকশন করে জন্ম হলো রাতুল মৌটুসির টুইন বেবীর। ছেলেটি বড় মেয়েটি ছোট। রাহেলা বানু নাতির নাম রাখলেন দীপ আর নাতনীর নাম রাখলেন শিখা।

নাতি নাতনির সাত দিন বয়সে ছোট খাট একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন রাহেলা বানু। আত্মীয় স্বজন ছাড়াও রাহেলা বানুর দুজন খুব ঘনিষ্ট কলিগকে নিমন্ত্রণ করলেন। তাদেরই একজন চট্টলা। চট্টলা খুব চটপটে আর ঠোঁট কাটা স্বভাবের। চট্টলা অচকিতে হাসতে হাসতে বলল-

: রাহেলা আপা ঘটনা কিন্তু উল্টো হল!

: কিসের ঘটনা চট্টলা?

: এই যে আপনার নাতির গায়ের রং হয়েছে দুধে আলতায় কিন্তু নাতনির রং হয়েছে ভোমর কালো!

: আজকাল এই সব গায়ের রং কেউ দেখে?  শিক্ষা রুচি অবস্থান এ সব দিয়েই মানুষ মানুষকে সন্মান করে।

মায়ের কথাটা কানে এসে লাগল রাতুলের। এই মা ই নিতুর গায়ের রং শ্যামলা ছিল বলে নিতুকে পুত্রবধু করতে আপওি করেছিলেন!

দেখতে দেখতে দীপশিখার বয়স চার মাস হয়ে গেল। আজ কাল মৌটুসিকে একদমই পায় না রাতুল। মৌসুমির দিনময় দুই বাচ্চা দেখা শোনা করতেই কেটে যায়।

রাতে ক্লান্ত মৌটুসিকে দেখলে খুব মায়া হয় রাতুলের। রাতুল মৌটুসির একটু যত্ন করতে চায়। তাই প্রতি রাতে ঘুমাত যাবার আগে রাতুল নিজ হাতে মৌটুসির জন্য কোন দিন দুধ, কোন দিন হরলিকস, কোন দিন কফি করে দেয়। মৌটুসি মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে রাতুলের সেই যত্নের প্রতি উওর দেয়।

দুই বাচ্চাসহ চার জনের এক বিছানায় জায়গা হয় না বলে মৌটুসি বাচ্চাদের নিয়ে বেডরুমের খাটে ঘুমায়। রাতুল ঘুমায় ঠিক তার পাশের রুমে। দুটি রুমের মাঝখানে একটা দরজা অবশ্য আছে।

সেদিনটি ছিল শুক্রবার। অফিসে যাবার তাড়া নেই রাতুলের। হঠাৎ চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাতুলের। পাশের রুম থেকে রাহেলা বানুর কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাতুল দৌড়ে পাশের রুমে গেলে রাহেলা বানু রাতুলকে জড়িয়ে ধরে বললেন -

: সর্বনাশ হয়ে গেছে রাতুল!

: কেন? কি হয়েছে মা?

: মৌটুসি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।

: কি বলছ মা?

: হ্যা, এই দেখ একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে।

চার ভাজ করা চিরকুটটি খুলল রাতুল -

“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি নিজ ইচ্ছায়, সজ্ঞানে বিষ পান করেছি। আত্মহননের জন্য কেউ আমাকে প্ররোচিত করেনি।”

হিসেব মেলে না রাতুলের। চিরকুটটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আপন মনে বলে উঠে -

: এটা কি করে সম্ভব!!

....... চলবে

 

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ