
ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফির একটি অংশ হচ্ছে বার্ড ফটোগ্রাফি। যেমন শ্রমনির্ভর তেমনি ব্যয়বহুল। বার্ড ফটোগ্রাফারকে ছবি তোলার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। যেখানেই নতুন পাখির সন্ধান পেয়েছি ছুটে গিয়েছি; একা কিংবা বন্ধুদের নিয়ে।
দামি ক্যামেরা আর লেন্স না হলে পশুপাখির ছবি তোলা সম্ভব নয়। কারণ পাখি মানুষের ভাষা বোঝে না। তারা হাতের কাছে এসেও বসে থাকে না। বরং প্রতিটি ফটোগ্রাফারকে পাখির পেছনে ছুটতে হয়। আর এই ছুটে চলার মধ্যেই অন্যরকম একটা নেশা জড়িয়ে থাকে।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে গিয়েছিলাম কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে। সেখান থেকে বড়ছড়ায় হাঁটু সমান পানিতে হেঁটে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথচলা। ছড়ার দুই পাশে পাহাড় ও উঁচু গাছ ছাড়া চোখে আর কিছুই দেখা যায় না। তাছাড়া বন্যহাতির উপদ্রব তো আছেই। আমার কাছে তথ্য ছিল এই ছড়াতে পাখিটির দেখা পাওয়া যায়। সেবার কষ্ট করে গিয়েও পাখিটির ছবি তুলতে পারিনি। মনে কষ্ট নিয়ে ঢাকা ফিরে আসি।
সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অনুজ ফটোগ্রাফার ডা. শামীম রেজওয়ান ফোনে জানালো কাপ্তাইয়ের ব্যাঙ ছড়ায় পাখিটির দেখা মিলেছে। সঙ্গে সঙ্গে শামীমকে বললাম- আজ রাতেই কাপ্তাই যাবো। তুমি প্রস্তুত হও। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শামীম রেজওয়ান বাসের টিকিট সংগ্রহ করে আমাকে জানালো। আমরা রাতের বাসে রওনা হলাম। ভোরে কাপ্তাই পৌঁছে ব্যাঙছড়ায় গেলাম। সারাদিন ঘুরে ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে পাখিটির দেখা পেলাম। দুবারে মোট ষোল হাজার টাকা খরচ হলেও White-rumped Munia বা সাদা-কোমর মুনিয়া পাখির ছবি তুলতে পারায় সব কষ্ট ও অর্থ ব্যয়ের কথা ভুলে গেলাম।
সাদা-কোমর মুনিয়া Estrildidae গোত্র বা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত এক প্রজাতির ছোট তৃণচর পাখি। এদের মুখ ও ঘাড় বাদে পিঠ মধ্যম বাদামি, দেহতল হালকা খয়েরি। সাদা-কোমর মুনিয়ার কোমর সাদা ও কালো লেজবিশিষ্ট ছোট আকারের পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ১০ সেমি., ডানা ৫.২ সেমি., লেজ ২.৭ সেমি. লম্বা এবং ওজন ১২ গ্রাম। গায়ের রঙে গাঢ় কালচে বাদামি ও সাদার প্রাধান্য দেখা যায়। হঠাৎ দেখলে সাদা-কালোই মনে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পুরো পিঠ কালচে বাদামি, কোমর সাদা। দেহের পেছনে সূক্ষ্ম ফিকে শরযুক্ত লম্বা দাগ রয়েছে।
এই পাখির লেজ সূচালো ও কালো। বুকে সূক্ষ্ম ফিকে আঁশের দাগ রয়েছে। পেট হালকা পিত-সাদা। পেটে কিছু লম্বালম্বি কালচে দাগ রয়েছে। এর ঠোঁট দুই রঙের। উপরের ঠোঁট কালো এবং নিচের ঠোঁট স্পষ্ট নীলচে ধূসর। চোখ লালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কালচে ধূসর। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কোমর হালকা রঙের এবং দেহতলে নানান বাদামি ছোপ থাকে।
সাদা-কোমর মুনিয়া মাঝারি ঝোঁপ, বনের ভেতরের পরিষ্কার জায়গা, তৃণভূমি ও ক্ষুদ্র ঝোঁপে বিচরণ করে। সচরাচর ১০-১৫টি পাখির ঝাঁকে এরা থাকে। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বা ঘাসের মধ্যে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ঘাসবীজ, ধান ও বাঁশবীজ, তবে ছানারা পোকা খায়। এরা সচরাচর করুণ কণ্ঠে ডাকে। মে-আগস্ট মাস প্রজননকাল। ছোট ছোট গাছের উঁচু শাখায় ঘাস বা বাঁশপাতা দিয়ে ছোট্ট গোল বাসা বানায়। বাসায় ঢোকার পথ সরু নলের মতো। ঘাসফুল দিয়ে পথের ভেতরটা মুড়ে নেয়। বাসার ভেতরেও থাকে ঘাসফুলের গদি। স্ত্রী মুনিয়া ৩-৮টি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৩-১৪ দিনে। বাবা-মা বাচ্চাদের পোকামাকড় খাইয়ে বড় করে।
এরা আমাদের আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। বিনা কারণে এদের শিকার বা বংশবিস্তারে বাধা দিলে জেল জরিমানাসহ উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
বাংলা নাম: সাদা-কোমর মুনিয়া
ইংরেজি নাম: White-rumped Munia
বৈজ্ঞানিক নাম: Lonchura striata
ছবিগুলো কাপ্তাইয়ের ব্যাঙছড়া থেকে তোলা।
১৬টি মন্তব্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
এরা করুণ কন্ঠে ডাকে কেন?
মনে হয় কোন দুখ আছে। ধবধবে সাদা ডিম দেয়া পাখিটি ভালোই লাগলো।
অবাক হচ্ছি যে, আপনি পাখির ছবি তুলতে অনেক কষ্ট করতে হয়।
শুভ কামনা রইল ভাইয়া।
শামীম চৌধুরী
কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মিলে না যে আপু।
পপি তালুকদার
এতো সময় অর্থ খরচ করে আমাদের জন্য পাখি সম্পর্কে তথ্য দেয়ার জন্য সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
শামীম চৌধুরী
এটা যে শুধু পাখির জন্যই অর্থ খরচ তা কিন্তু নয়। পাখির ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতন্ত্য অঞ্চল ঘুরা হয়।জানা হয় তাদের সংস্কৃতির চচর্চাও।
পপি তালুকদার
বাহ অনেক ভালো কাজ।জেনে আনন্দিত হলাম।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনারা যদি এমন করে না ছুটছেন, না জানাতেন তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ কিভাবে এসব তথ্য, ছবি পেতাম!! আপনার কষ্ট ও শ্রমকে স্যালুট জানাই। অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও রইলো শুভ কামনা দিদিভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
এটাও মুনিয়া পাখি!!
ভাগ্যিস আপনি আবারও গিয়েছিলেন ছবি তুলতে, নয়তো আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই পাখিটা দেখা হতো না। আপনি একজন সত্যিকারের পাখি প্রেমিক।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
আপনিও ভালো থাকুন সাবিনা আপু। শুভেচছা জানবেন।
আরজু মুক্তা
শুধু কি চোখ জুড়ায়? এমন পাখি দেখলে মনও জুড়ায়।
শুভ কামনা ভাই
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।
মোঃ মজিবর রহমান
আগেই প্রশ্ন মুনিয়া কত রকমের হই। অনেক দেখলাম নেটে।
খুব সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন মুনিয়া।
শামীম চৌধুরী
৬ প্রজাতির মুনিয়া আমাদের দেশে দেখা যায়। এই ৬ প্রজাতি এক এক করে ব্লগে লেখা আছে ভাই। সময় নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইলো।
মোঃ মজিবর রহমান
ইনশাল্লাহ। আল্লাহপাক সুজোগ দিলে পড়ব।
খাদিজাতুল কুবরা
লেখাটি গতকালই পড়েছিলাম।
পাখিটি সুন্দর। ছোটবেলায় পাখি পুষতাম। পাখির প্রতি ভালোবাসা এখনও আছে। যদিও শহুরে জীবনে দেখা হয়না তেমন।
পাখির প্রতি আপনার অকৃত্রিম ভালোবাসা তুলনাহীন।
শামীম চৌধুরী
দোয়া করবেন আপু।