আমরা বিভিন্ন সময়ে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার জন্য নিজের ফটো আপলোড করে থাকি। দেশে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বিস্তৃত এবং এনডরয়েড মোবাইল সেট সহজ লভ্য হওয়ায় দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ জন। প্রতি মাসে ব্যবহারকারী বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ। এরমধ্যে মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার।এই যে প্রায় বারো কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে, তাদের অধিকাংশই ইন্টারনেট বলতে বুঝেন ফেসবুক, ইউটিউব, আর ইমো।কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে আমরা কতজনকে জানি?

এই লেখাটির চিন্তা মাথায় এলো সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরের প্রেক্ষিতে  মাসুক মিয়া নামে এক যুবক সোনিয়া আক্তার কেয়া নামে ফেইক ফেইসবুক আইডি খুলে তানজিম মেহেজাবিন খান স্নেহা নামে এক মেয়ের ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করে। এই ফেসবুক আইডি দিয়ে সে বিভিন্ন ছেলে/ পুরুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে। সময়ের সাথে সাথে তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়। এরপর মোবাইল নাম্বার দিয়ে ছেলে/ পুরুষদের সাথে কথা বলে। কথা বলার সময় সে একটি কলিং সফটওয়ার ব্যবহার করে, এতে পুরুষ কন্ঠ নারী কন্ঠের মতই শুনা যায়। কখনো সে সোনিয়া আক্তার নামে, কখনো সে সোনিয়ায় আক্তার মা হয়ে পুরুষদের সাথে কথা চালিয়ে যায়। নিজেকে সে লন্ডন প্রবাসী/ পুলিশের এএসপি ইত্যাদি পরিচয় দেয়। এরপর প্রেমে পতিত যুবক/ পুরুষদের সাথে দেখা করতে যায়- পথিমধ্যে সে এক্সিডেন্ট করে, চিকিৎসার জন্য জরুরী ভাবে ২৫- ৩০ হাজার টাকা প্রয়োজন, একথা শুনে প্রেমে উতলা পুরুষ সোনিয়া আক্তারের বিকাশে টাকা পাঠায়। এখানেই এই অধ্যায় শেষ। যোগাযোগ বন্ধ। এভাবে এই যুবক কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুলিশের হাতে সে ধরা পরে।

পাঠক, উপরের ঘটনায় বোকা পুরুষদের উচিৎ সাঁজা হয়েছে বলে আমরা হয়ত হাসাহাসি করতে পারি। করবোও হাসাহাসি। কিন্তু ঘটনার অন্য একটি দিকও আছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ।
* মাসুক আইডি করেছে সোনিয়া আক্তার নামে। প্রফাইল পিকচার দিয়েছে তানজিম মেহেজাবিন খান স্নেহা নামে। অর্থাৎ এই আইডি থেকে যা করা হয়েছে তানজিম মেহেজাবিন খান স্নেহার উপরেই বর্তায়। তানজিম মেহেজাবিন খান স্নেহার আসল আইডিতে যে সমস্ত বন্ধু আছেন, তাঁদের সবাইকে কি সে চিনতো? প্রচুর অচেনা বন্ধুও তো আছে ফেসবুকে। তারা আসল তানজিম মেহেজাবিন খান স্নেহা ভেবে এই মাসুকের সাথে ডেটিং পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। প্রশ্ন করা যায়, এতে তানজিম মেহেজাবিন খান স্নেহার কি আসে যায়? হ্যা আসে যায়। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই গসিপে বিশ্বাসী।রমরমা কাহিনী হলে তো আরো মজা। শ্নেহার সাথে ফোনে বাজে ইটিশ পিটিশ করা যায়, ফোন দিলে তো মেয়ে কন্ঠই সোনা যাবে। খুব সহজেই মানুষ এই গসিপ বিশ্বাস করে ফেলবে।

অসুবিধাটি একটি বাস্তব উদহারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। সোনেলা ব্লগেরই একজন নারী ব্লগারের সাথে ফেসবুকে বন্ধু হয়েছি তিন বছর আগে। এর অনেক আগ হতেই আমার মেঝো ছেলে এবং নারী ব্লগারের মেয়ে ফেসবুক ফ্রেন্ড। একদিন আমি ল্যাপটপে ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম, আমার মেঝো ছেলে সেই নারী ব্লগারের ফেসবুক প্রফাইলের ছবি দেখে জিজ্ঞেস করলো
=আব্বু উনি সায়ন্তনী ( ছদ্ম নাম ) আন্টি নন?
- হ্যা, তুমি চিনলে কিভাবে?
= ওনার মেয়ে নিঝুম ( ছদ্ম নাম) তো আমার ফ্রেন্ড।
- তাই নাকি? কত বছর থেকে ফ্রেন্ড তোমরা?
= চার পাঁচ বছর তো হবেই আব্বু।
পাঠক, এখন কোনো প্রতারক যদি সায়ন্তনীর ছবি দিয়ে একটি ফেইক আইডি খুলে বিভিন্ন উপায়ে প্রতারণা করে, আর তা যদি আমার ছেলে জানতে পারে তাহলে কি হতে পারে? সে তো এটা নিঝুমকে জানাবে না। তবে নিঝুমের অন্য বন্ধুদের তো জানাতে পারে।

আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। আমার ছবি ব্যবহার করে একটি ভুয়া আইডি করে অর্থ সাহায্য চাইতে পারে কেহ। সমকামী গ্রুপে আমার ছবি দিয়ে আইডি করতে পারে। আর এসব জেনে যেতে পারে নিঝুম। ইবনে মিজান যুগের কয়েকজন পরিচালকের মধ্যে একজনের সাথে আমার চেহারার কিছুটা মিল থাকায় ফেসবুকের অপরিচিত এক বন্ধুর প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছিলো আমাকে " আপনি কি সেই বিকৃত রুচির চলচ্চিত্র নির্মাতা অমুক ?" ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেছি আমি তখন। আমার উত্তর সে বিশ্বাস করেনি আমি জানি। সে কি আরো দু একজনকে বলেনি?

হয়ত আপনি ভাবছেন ফেসবুকে বন্ধু নির্বাচনে শতর্ক হলে এই সমস্যাটি আর হবার সম্ভাবনা নেই। আপনার ভাবনাটি ভুল হতে পারে। ফেসবুকের কতজন বন্ধুকে আপনি চেনেন? আসল বন্ধু কতজন আসলে আপনার? নিজেকেই প্রশ্ন করুণ, হিসেব মেলান। আমি আমার কথাই বলি, ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় প্রায় পাঁচ হাজার জন আছেন। এরমধ্যে আত্মীয় স্বজন, ক্লাসফ্রেন্ড এবং ব্লগে যোগাযোগের কারণে সর্বোচ্চ হয়ত একশত জনকে আমি জানি।সুতরাং শতর্ক হয়ে বন্ধু নির্বাচন করাটা একটি ভুল ভাবনা।

সাইবার ক্রাইম রিপোর্ট অনুযায়ী নারীরা যেমস্ত ফেসবুক ভিত্তিক হয়রানির স্বীকার হচ্ছে তার ছবি দেখুন।

হয়রানির শীর্ষে আছে ভুয়া বা ফেক আইডি। ২৮.৬০% , অর্থাৎ ফেসবুক নারী ব্যবহারকারীদের মধ্যে একশত জনের মধ্যে আঠাশ জন নারীই তাঁদের নামে ভুয়া আইডির স্বীকার। এর অর্থ একশত জনের মধ্যে আঠাশ জনের বেশী ছবি দিয়ে এই সমস্ত ভুয়া আইডির প্রফাইল পিকচার বানানো হয়েছে। আপনার ছবি যে নেই তাতে এটি ভাবার কোনো যুক্তি আছে?

এছারা ফেসবুক আইডি যখন আপনার আছে, তখন আপনি ফেসবুক সার্চ বারে বিভিন্ন এডাল্ট শব্দ ( যেমন চটি ) লিখে সার্চ দিয়ে দেখুন, কত হাজার হাজার নারী/ মেয়েদের ছবি দিয়ে সে সব প্রফাইল, পেইজ, গ্রুপ বানানো হয়েছে। এসব ছবি কাদের? ফেসবুকের বিভিন্ন নারী/ মেয়ে আইডি থেকেই তো এসব ছবি নেয়া হয়েছে।

উপরের আলোচনায় ভাবার অবকাশ নেই যে এই সমস্যা কেবল নারী ব্যবহারকারীদের। পুরুষরাও বিপদে আছেন। আমার ছবি দিয়ে ফেক আইডি বানিয়ে বিভিন্ন উস্কানিমূলক পোষ্টে, জঙ্গি গোষ্ঠির গ্রুপের সদস্যও তো বানাতে পারে।

ইন্টারনেটে নিজের ছবি আপলোডে: কতটা ঝুঁকিপূর্ণ  , তা আমরা সহজেই নির্ণয় করতে পারি।

- ক্রমশ............

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ