উইলিয়াম শেকসপিয়র (ব্যাপ্টাইজড ২৬ এপ্রিল১৫৬৪)  একজন ইংরেজ নাট্যকার, কবি ও অভিনেতা যাকে এক কথায় বলা হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইংল্যান্ডের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-আভন এ। উইলিয়াম শেকসপিয়রের জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্যই এখনো ধোঁয়াশায় ঢাকা। তার সম্পর্কে দর্শক, নাট্যমঞ্চের কলাকুশলী কিংবা সাহিত্য সমালোচকদের আলোচনা-সমালোচনা মূলত তার লেখা অসাধারণ সব নাটকের চরিত্র, ঘটনাপ্রবাহ আর সংলাপকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসের সব থেকে প্রতিভাবান লেখকদের একজন যিনি মানুষের মনে নিরন্তর বয়ে যাওয়া জটিলতম আবেগ থেকে বের করে এনেছেন কালজয়ী সব নাটকের প্লট। পৃথিবীর মানুষ পেয়েছে জুলিয়াস সিজার, হ্যামলেট, অথেলো, দ্য টেম্পেস্ট ইত্যাদির মতো নাটক। চরিত্র-সংলাপ এর দিকে নজর দিলে বোঝা যায় শেকসপিয়র মনের ব্যাপক পরিসরের রঙ্গমঞ্চের বিচিত্র আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তার এই দক্ষতার উৎকৃষ্ট প্রকাশ ঘটেছে হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার, এ মিডসামার নাইটস ড্রিম প্রভৃতি নাটকে। লেখনীতে মনোস্তাত্বিক বিষয়গুলো এতোই প্রবল যে অনেক বলে থাকেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তিনশ বছর আগে জন্মালেও তিনি ছিলেন একজন মনোবিজ্ঞানী!

ভালোবাসা ও যৌনতাকে নিয়ে শেকসপিয়রের নিজস্ব ধারণার কিছুটা হয়তো পাওয়া যায় ‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ এ। এখানে সচেতন ও অচেতন মন থেকে এই বিষয়গুলো যে নিয়ন্ত্রিত হয় সেটাই খুঁজতে চেয়েছিলেন। প্রেম, ভালোবাসা, কল্পনা সবই যে মনের কাজ সে সিদ্ধান্তে সম্ভবত উপনীত হতে পেরেছিলেন। তাই থিসিয়ুসের কন্ঠে বলিয়ে নিয়েছেন- ‘Lover and madmen having such seething brains’। অন্যদিকে তিনি এমন এক সময়ের মানুষ ছিলেন যখন যৌনতা বিষয়ক আচরণ, আলোচনায় কঠোর অবদমন ছিল। পরবর্তী কালে নারীবাদী আলোচকদের অনেকের মতে শেকসপিয়রের নারী চরিত্রদের অধিকাংশই স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত হয়নি। নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিবর্তে পুরুষ চরিত্রের প্রয়োজনে যেন নারীরা আবর্তিত হয়েছে। নাট্যকার নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তাদের না ফুটিয়ে তুলে কিছুটা পুরূষতান্ত্রিকতার চোখ দিয়ে তৈরি করেছেন! তবে শুধুমাত্র চরিত্রের মুখের সংলাপ বিশ্লেষণ করে কখনোই এটা বলা সম্ভব নয় নাট্যকারের মনে নারীর কি প্রতিমূর্তি ছিল। হয়তো তৎকালীন সময় ও সংস্কৃতিকে বিবেচনায় এনে সময়ের সাথে সঙ্গত চরিত্র তিনি বানিয়েছিলেন।

তার তৈরি প্রচন্ড শক্তিশালী সংলাপ, বাক্যাংশ, ভাষার অভিনব কাঠামোর সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। পাশাপাশি মানুষের মস্তিষ্কে সমসাময়িক কালেও এর সরাসরি প্রভাব আছে। এটা এমন নয় যে শুধু তাত্ত্বিকভাবে মনোস্তাত্বিক কিছু পরিবর্তন; বরং আধুনিক কালের ইইজি অথবা ফাংশনাল এমআরআই এর মতো পরীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে শেকসপিয়রের সংলাপ ও শব্দশৈলী শ্রোতার মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে্র কাজে তীব্র পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। নাট্যকার ইচ্ছাকৃত ভাবে ভাষার গঠনশৈলীর অদল বদল ঘটিয়েছিলেন। যার ফলে সংলাপ গুলো শুনলে শ্রোতার মস্তিষ্কের ভিজুয়াল এসোসিয়েশন এলাকা সক্রিয় হয়ে যায়; যা স্বাভাবিক অবস্থায় কোন কিছু দেখার সময় হয়ে থাকে।  যেন মস্তিষ্কের ভিতরে মনোজাগতিক থিয়েটারে অভিনয় শুরু হয়। মনের চোখ খুলে যায়। এই ভাষার গঠনশৈলীর পরিবর্তন শেকস্পিয়ারের নিজস্ব অনন্য আবিষ্কার। এটার মাধ্যমে তার মনের ভিতরে কাজ করা ধারণা ও চিন্তা বিষয়ে কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব। এলিযাবেথীয় যুগের অন্যান্যদের মতো তিনিও ভাষাকে নতুনভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করতেন। এটা করতে গিয়ে ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়ার মতোই আবিষ্কার করেছিলেন নিজস্ব শৈলী; নতুন শব্দ। আনুমানিক ত্রিশহাজার শব্দ ব্যবহার করেছেন লেখনীতে; যার মধ্যে প্রায় একহাজার সাতশ নতুন শব্দ নিজে আবিষ্কার করেছেন। তার মন ছিল শব্দের পরীক্ষাগার; অনবরত যেখানে ভাষাকে নিয়ে খেলা করতেন।

এটা মাথায় রাখতে হবে আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি তখন না ছিল ক্যামেরার কারিকুরি অথবা গ্রাফিকস এনিমেশনের বাহারী বাহাদুরী! এই মহান নাট্যকার একটি সাধারণ মঞ্চে শুধুমাত্র সংলাপের মাধ্যমে পুরোটা দৃশ্যকল্প এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যে কেবল অভিনেতার মুখের কথা আর অঙ্গভঙ্গির মধ্যে দিয়েই সমস্ত দর্শক যেন মনের চোখে দেখতে পারতো পুরোটা দৃশ্য। অনেক ক্ষেত্রেই সূক্ষভাবে দর্শকের মনের কল্পনা শক্তিকে সরাসরি এতে সংযুক্ত ও করেছেন। যেমন দ্য টেম্পেস্ট নাটকে যখন দুটি চরিত্র গঞ্জালো ও এন্টোনিও রহস্যময় দ্বীপের মাটির রং নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয় ( সেটা সবুজ নাকি বাদামী) তখন মঞ্চের মেঝের রং যাই হোক না কেন দর্শক দ্বিধায় পড়ে যায় আসলেই তার প্রকৃত রং কি সেটা ভেবে! এরকম অনেক সময়ই তিনি সংলাপের মধ্যে তৈরি করতেন এক ধরনের বিভ্রম (illusions)। এর ফলে দর্শক যা দেখে এবং যা শুনে এই দুইয়ের মধ্যে চেতনাগত ও জ্ঞানীয় (cognitive gap) ফারাক তৈরি হয়। এই ফারাক পূরণ করতে গিয়ে দর্শকের মনে জাগ্রত হয় সজীব কল্পনার। মনোবিজ্ঞানীদের মতে চরিত্রের সংলাপ আর দর্শকের কল্পনাকে একীভূত করে সফল দৃশ্যের জন্ম দিতে শেকসপিয়র সচেতন ভাবে ও সতর্কতার সাথে শব্দচয়ন করেছিলেন, যা আজো তার অসাধারণ প্রতিভার স্মারক হয়ে আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মানব মনের সহজে বিক্ষিপ্ত হওয়ার প্রবণতার বিষয়ে তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন এবং এই কৌশল অহরহ প্রয়োগ করেছিলেন কালোর্ত্তীর্ণ সংলাপ গুলোতে। সোশ্যাল কগনিশনের ব্যাপার গুলো- যেমন আর দশজন সমবেত মানুষের ব্যাবহার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অনুকরণের বিষয়টিও সফল্ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এই নাটকগুলোতে।

চরিত্র হিসেবে ভূত বা অশরীরি আত্মার মঞ্চে আগমন রেনেসাঁর নাটকে নতুন কোন ঘটনা ছিলোনা। তবুও জগদ্বিখ্যাত হ্যামলেট নাটকে অশরীরি আত্মার আবির্ভাব বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি ঘটনা। প্রথমত নাট্যকারের যুক্তিবাদী মন এখানে প্রশ্ন তুলেছে যে যদিও হ্যামলেট অশরীরিকে দেখতে পারছে তবুও এটা প্রকৃতই সত্য কিনা! কেননা অন্য চরিত্ররা কেউই তাকে দেখছেনা! যা দেখে দর্শক বা শ্রোতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়; একদল বিশ্বাস করে হ্যামলেটকে, আরেকদল ভাবে হ্যামলেট আসলে উন্মাদ! এই দ্বিধার অন্তরালে শেকসপিয়রের মনের গহীনের খোঁজ ও অনুমান করা সম্ভব কিছুটা হলেও। ষোড়শ শতাব্দী রেনেসাঁর কাল। সেই সময়ে প্রাচীন বিশ্বাস ও আধুনিক যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের পরস্পর বিরোধী যে অবস্থান সমগ্র ইউরোপের চেতনা জগতকে অস্থির করে রেখেছিল এই দ্বিধা হতে পারে তারই সুপ্ত প্রকাশ।

আধুনিক মনস্তত্ত্বের অন্যতম পুরোধা সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছিল শেকসপিয়রের সৃষ্টিকর্ম। তিনি সারাজীবন ইংরেজীতে শেকস্পিয়ার পড়তেন, অসংখ্য প্রবন্ধ ও চিঠিপত্রে তার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সম্ভবত মনস্তত্ত্বের অনেক ধারণাই অচেতন মনে এখানে থেকে পেয়েছিলেন। যদিও ফ্রয়েড শেকস্পিয়ারের অনেক সৃষ্টিকর্মের মৌলিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু আজীবন তার প্রভাব থেকে মুক্তি পাননি। তার ধারণা ছিল হ্যামলেট চরিত্রটির ইডিপাস কমপ্লেক্স আছে, যদিও অনেকেই তা পরবর্তীতে স্বীকার করেননি! কিন্তু অনেক বিশ্লেষক তার এই চরিত্রে অত্যধিক আগ্রহ দেখে বলেছেন ফ্রয়েডের নিজের হ্যামলেট কমপ্লেক্স ছিল। ইউরোপ এবং সমস্ত পৃথিবীকে সর্বপ্রথম ইমোশনাল এম্বিভেলেন্সের (একই সাথে পজিটিভ ও নেগেটিভ ইমোশন অনুভব) উদাহরণ দেখিছিলেন শেকসপিয়রই।

১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে যখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ, দুই কিশোরী কন্যা সুসানা ও জুডিথের বিদ্রোহী ও  অবাধ্য স্বভাবের সাথে অনেকটা সমঝোতা করে নিতে হচ্ছিল। মধ্যবয়স থেকে সেই প্রথম বৃদ্ধ বয়সের আভাস উঁকি দিচ্ছিল। হয়তো বৃদ্ধ বয়সের সম্ভাব্য স্মৃতিশক্তি লোপ বা ডিমেনশিয়ার চিন্তাও আনাগোণা করছিল মনে। এইরকম একটা সময়ে লিখলেন বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘কিং লিয়ার’। বৃদ্ধ বয়সে যখন মানুষের সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতিপত্তি ক্ষয়ে যেতে  থাকে সেই ভগ্ন মনের অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন এই নাটকে। হতে পারে এটা তার নিজস্ব আত্মজিজ্ঞাসা ছিল। কিং লিয়ার এর কন্ঠে আসে- ‘Man’s life is cheap as beast’s’ অথবা ‘O let me not be mad, keep me in temper’। হয়তো আলঝেইমার্স ডিজিস নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ছিল এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটু ভয় ও পাচ্ছিলেন। অধিকাংশ নাটকে যেটা লক্ষণীয় পিতা-কন্যার জোড়ের সম্পর্কটা মসৃণ নয়। হয় পিতা তার কন্যাকে বুঝতে পারেনা, প্রকৃত দায়িত্ব পালনে অক্ষম থাকে অথবা কন্যাকে বোঝার চেষ্টাও করেনা। হয়তো সেটা তার নিজস্ব অথোরিটেটিভ প্যারেন্টিং এর দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বারবার এসেছে। কন্যা চরিত্ররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিতার বাধ্যানুগত নয়, বিদ্রোহী স্বভাবের, কিছুটা তার নিজের মেয়ের স্বভাবের মতো। সম্ভবত চল্লিশে পৌছার পর মিড লাইফ ক্রাইসিসে পড়েছিলেন। থিয়েটারের দুনিয়ার নিয়ম এই যে সবসময় উদ্যমী তরুণদের নিজের বলয়ে আকর্ষিত করে টেনে আনে আর বৃদ্ধদের ঠেলে দেয় দূরে। শেকসপিয়রের মনে হয়তো কাজ করছিল সেই ভয়; কমে আসছিল আত্মবিশ্বাস! ফলশ্রুতিতে হ্যামলেট, ম্যাকবেথের এই কিংবদন্তি লেখককে যৌথভাবে অন্য লেখকদের সাথে লিখতে হয়েছিল। হয়তো তিনি তরূণ প্রতিদ্বন্দী লেখকদের ভয় পেতে শুরু করেছিলেন। এটা অনেকটা এযুগের সেলিব্রেটিদের মতো ব্যাপার, অভিনয়ের শিখরে তারা সব মাতোয়ারা করে রাখে, তবুও বয়স বাড়তে থাকলে কমে আসে জনপ্রিয়তা সাথে বাড়তে থাকে রক্ষণশীল ইগোর অনমনীয় জেদ!

শেষ বয়সে জন্মস্থান স্ট্র্যাটফোর্ডে ফিরে গিয়েছিলেন। স্বেচ্ছায় ছেড়ে গিয়েছিলেন লন্ডন শহর। হয়তো পৃথিবীর তাবৎ বয়সী অভিনেতার মতো চাপা অপেক্ষায় ছিলেন; যদি ডাক আসে! যদিও কাঙ্ক্ষিত ডাক আসেনি। ২৩ এপ্রিল ১৬১৬ সালে চিরদিনের মতো বিদায় নেন তিনি। তার মৃত্যুতে সমসাময়িক এক লেখক বলেছিলেন- "Shakespeare, that thou went so soon / From the world's stage to the grave's tiring room."

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ