অতীতের হজযাত্রা

আরজু মুক্তা ৭ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ০২:১২:৫৬পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৪ মন্তব্য

জানি না করোনার কারণে এবার পবিত্র হজব্রত পালন হবে কিনা! তবে, দ্রুত করোনা মুক্ত হোক পৃথিবী।

একসময় হজযাত্রা এখনকার মতো সহজ ছিলোনা। আজ থেকে চার দশক আগেও বাঙালি মুসলমানের জন্য এটা দুঃসাধ্য ছিলো। সব মুসলমানরাই স্বপ্ন দেখে মক্কা মদীনা যাবেন। হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে নিজেদের পবিত্র করবেন।

সেকালে, এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন হাতে গোনা কয়েকজন লোক। যাঁদের অর্থবিত্ত ছিলো, দৃঢ় মনোবল ছিলো, -- শুধু তাঁরাই য়েতে পারতেন এই কাঙ্খিত স্থানে।

সমাজে এইসব ভাগ্যবান হাজীর কদর ছিলো খুব। বংশে এরকম হাজী থাকলে, সেই বংশের মান মর্যাদাও বেড়ে যেতো কয়েক গুণ। এমন কি গ্রামের নামও পাল্টে যেতো। যেহেতু, প্রস্তুতি নিতে কয়েকবছর লেগে যেতো; সেহেতু তাঁরা সব ধরণের বৈষয়িক লেনদেন মুক্ত করে হজে যেতে চাইতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সবাই বয়স করেই হজে যেতেন। হয়তো সেজন্যই সবাই ভয়ে থাকতেন, যদি আর না ফিরেন! কারণ বিপদ সংকুল যাত্রায় অনেকেই পথিমধ্যে রোগে শোকে মারা যেতেন।

সেসময় হাজীদের বিদায় দেয়া হতো ঘটা করে। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই স্টেশন বা ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার জন্য যেতেন। ঐ দিন হাজী সাহেব বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতেন। আর সবারি ফরিয়াদ থাকতো, উনি যেনো মদীনায় সবার ছালাম পৌঁছে দেন, নবীজির রওজামোবারকে।

বাংলাদেশের হাজীরা আনাচ কানাচ, গরুর গাড়ি, নৌকায় করে মুম্বাই পৌঁছাইতেন। ওখান থেকে জাহাজে করে রওনা হতেন পাকিস্তানের করাচীতে। সেখানে আরও হজযাত্রী উঠতেন। এরপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে, কতে ঝড়ঝঞ্জা সয়ে পৌঁছাতেন এডেন বন্দরে।

জাহাজে থাকাকালীন সব হাজীরা মিলেমিশে কাজ করতেন। কেউ রুটি বানাতেন, কেউ ভাজতেন, কেউ তরকারি কাটতেন, কেউ রান্না করতেন।

অনেক সময় সমুদ্রের ঝড়ে তখনকার কাচের থালাবাটি, বাসন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতো। যাত্রীরা ভয়ে ডেকে মলমুত্র ত্যাগ করতেন। জাহাজের শিকল ধরে গুণতেন মৃত্যুর প্রহর।

পথিমধ্যে শহর নগর সামনে আসলে, মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হতো। সবাই আনুসাঙ্গিক জিনিসপাতি ক্রয় করতো।

আবহাওয়া রৌদ্রজ্জ্বল থাকলে, সাগরে তিমি, হাঙ্গর কতো প্রকার যে মাছ দেখা যেতো।

এডেনের পর ইয়েমেনের উপকূলীয় দ্বীপ কামারানে হাজীদের কোয়ারাইন্টানের জন্য নামিয়ে দেয়া হতো। এখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে ১ সপ্তাহ বা ১ মাসও লাগতো। কোয়ারাইন্টান শেষে জাহাজ অবতরণ করতো জেদ্দায়। পথিমধ্যে ইয়ালামলাম নামক স্থানে ইহরাম বাঁধতে হতো। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের মিকাত।

জেদ্দা থেকে কাফেলা রওনা হতো মক্কা। দুরত্ব ছিলো ২৫০ মাইল।  মক্কায় পৌঁছে সুবিধামতো তাঁবু গেড়ে হজের মূল কার্যাদি সম্পন্ন করতেন হাজীরা। সবচেয়ে কষ্টকর ছিলো এই মরুর যাত্রাপথ। একে তো জলন্ত পিন্ড। অন্যদিকে বেদুঈন দস্যুদের অত্যাচার। পথে মন্জিলে মন্জিলে পাওয়া যেতো জ্বালানি কাঠ, পানি, খেজুর, তরমুজ, চা। আবার গোসলও সারা যেতো। রাতে বেদুঈনদের থামাতে টাকা দিয়ে খুশি করতে হতো। অনেক সময় তাঁরা সর্বসান্ত হয়ে যেতো। ঐ সময় তারা আরব লোকদের বাড়ি গিয়ে উঠতো। আর আরবরা কখনোই কার্পণ্য করেনি আতিথেয়তায়।

মদীনায় হযরত মোহাম্মদ ( সাঃ) এর রওযা মোবারক দর্শনে কেউ কেউ এতোটাই আত্মহারা হয়ে উঠতেন যে তাঁরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।

অতঃপর আবার যাত্রা শুরু ঘরের দিকে। তখন কাফেলার জনসংখ্যা আর আগের মতো থাকতো না। অনেেকেই মারা যেতেন।

ছয় সাত মাস পর কোন এক রাতে জমজম কূপের পানি আর খেজুর নিয়ে পৌঁছাতেন পরিবার পরিজনের কাছে। তখন আনন্দে সবাই কেঁদে ফেলতো।

নতুন হাজী ফিরছেন, এই কথা শুনেই পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হতো তাঁকে দেখতে। আর হয়তো হজ যাত্রার গল্প বলতে বলতে মাস ছয়েক কেটে যেতো।

অথচ, আজ কতো সহজ হজযাত্রা। রাব্বুল আল আমিন আমাদেরকে তৌফিক দান করুন হজ করার।

আমিন।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ