ছুটির দিন । আমরা সবাই মিলে গল্প করছিলাম । হঠাৎ মনে হলো অনেকদিন ধরে দাদুর মুখে গল্প শোনা হয়নি ।
সাবই মিলে দাদুর কাছে গেলাম । দাদু তখন পানের বাটা সামনে নিয়ে পান চিবুচ্ছিলেন। আমাদের দেখে পিক করে পানের পিকটা পাশের একটি পাত্রে ফেলে বললো, কী দাদুরা কী মনে করে আজ?
দাদু, দাদু, আমরা গল্প শোনতে এসেছি।
গল্প শুনবি? কী গল্প?
মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
তোরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে কী করবি? সেই গল্প কি আর কেউ শুনতে চাইরে দাদু?
কেন দাদু? শুনতে চাইবে না কেন? সে গল্পগুলোই তো আমাদের অস্থিত্বের গল্প, ইতিহাসের গল্প, ঐতিহ্যের গল্প। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু কতো ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা তো আমাদের জানা উচিৎ। আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তারা যদি আমাদের এ সব গল্প না বলেন তাহলে আমরা জানবো কী করে।
ঠিক আছে। তোরা যখন শুনতে চাস তাহলে শোন।
আমাদের পাড়ায় বেশ ক’জন কিশোর ছিলো। তারা যেমন লেখাপড়ায় ভালো ছিলো, তেমন ছিলো পরোপকারী। পাড়ার অসহায় বৃদ্ধাদের তারা বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতো। নিয়মিত স্কুলে যেতো। খেলাধুলায়ও ছিলো পারদর্শী। হঠাৎ খবর শোনা গেলো পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী তিন কিশোরের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়ার মতিন মাস্টারের দেখাও নেই । বেশ কিছুদিন ধরে তিনিও নিখোঁজ। ছেলে তিনটি মতিন মাস্টারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতো। স্যারের বাসায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে শুনে নিজেদের মধ্যে বাসনা জাগলো যুদ্ধে যাবার। মাস্টার প্রথমে রাজি ছিলোনা তাদের নেয়ার। দেশের প্রতি তাদের ভালবাসা দেখে মাস্টার বাধ্য হয়। শপথ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার।
নিখোঁজ ছেলের সন্ধান না পেয়ে অসহায় টিটুর বাবা ছেলের টেবিলে বসে কাঁদছিলেন। টিটুর বইয়ে হাত বুলাতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে একটি চিরকুট “ বাবা আমার বন্ধু শামীম ও জসীমকে নিয়ে যুদ্ধে গেলাম। হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না। যদি হয় সেদিন স্বাধীন দেশের পতাকা হাতে যেন তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি। তুমিতো বলতে মাকে রক্ষা করা ছেলের কর্তব্য। আমরা শকুনের হাত থেকে মাকে রক্ষা করতে গেলাম”। চিরকুটটা পেয়ে টিটুর বাবার বুক গর্বের ভরে গেল।
ভারতের ত্রিপুরা থেকে ট্রেনিং শেষে কিশোরদের নিয়ে মতিন মাস্টার গঠন করলো একটি অপারেশন টিম।গা গতরে টিটু একটু বড় বলে অস্ত্রের ট্রেনিং মিললো কেবল তার। বাকি দু’জন নিয়োগ পেল ইনফরমার হিসেবে। পরিকল্পনা মোতাবেক শামীম ও জসীম কাজ নে গ্রামের অদূরে পাকিস্থানি ক্যাম্পে। তারা একদিন জানতে পারে আজ রাতেই এ ক্যাম্পে একটি বড় মিটিং হবে । মিটিঙে আসবে বড় বড় আর্মি অফিসাররা। পরিকল্পনা নিচ্ছে তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেবার। বিষয়টি তারা জানায় কমান্ডারকে।
রাত গভীর, চারদিকে অন্ধকার। অমাবশ্যার রাত। দূর থেকে কেবল ক্যাম্পের আলো ছাড়া আর কিছু্‌ই দেখা যাচ্ছিলো না। কমান্ডার প্রস্তুতি নিলেন অপারেশনের। পাকিস্থানি সৈনিকরা যখন মিটিঙে ব্যস্ত ছিলো তখন শামীম আর জসীম এক এক করে তাদের প্রায় অস্ত্র ফেলে দেয় পাশের ডুবায় । আর নিজেরা সরে যায় সুকৌশলে। ক্যাম্প থেকে বেড়িয়ে আলো জ্বালিয়ে সংকেত দেয় অপারেশন শুরুর। মাস্টারের নেতৃত্বে শুরু হয় এ্যাটাক। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় পাল্টা গুলি। শুরু হয় যুদ্ধ।ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মাস্টারের টিম। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে কমান্ডারের ডান কাঁধে। পেছন থেকে এসে টিটু তুলে নেয় দুইহাতে দুইটি ভারি ভারি অস্ত্র। গুলি করতে করতে এগিয়ে যেতে থেকে সামনের দিকে। একসময় পরাস্ত হয় পাকিস্তানি আর্মিরা। জ্বালিয়ে দেয়া হলো ক্যাম্প। শত্রুমুক্ত হলো গ্রাম। অপারেশনটির নাম দেয়া হলো কিশোর অপরারেশন। এরকম কতো কিশোর, তরুণ, যুবক ছাত্র,কৃষক শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন হলো আমাদের বাংলাদেশ। আমরা পেলাম বিশ্বের মানচিত্রে এক খণ্ড বাংলাদেশ, একটি লাল সবুজের পতাকা।

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ