আফিসের কর্তব্য পালনে প্রতিদিন আমার শীতলক্ষ্ম্যা নদীর পাড়ে যেতে হয় । নদীর পাড়ে গেলেই ছোটবেলার কথাগুলো আমার মনে পড়ে যায় । সেসময় কতনা ঝাঁপ দিয়ে পড়তাম এই শীতলক্ষ্ম্যার বুকে । সকালে বিকালে স্কুলে যাওয়ার আগে পরে,সময়ে অসময়ে । বিকালবেলা শীতিলক্ষ্ম্যা নদীতে চলতো এক অন্যরকম খেলা । বিদেশী মেমসাহেবেরা স্প্রিডবোট নিয়ে খেলতো সেই খেলা । স্প্রিডবোট চালাতো একজন, পিছনে মোটা রশি ধরে থাকত একজন । স্প্রিডবোট চলতো, আর একজন রশি ধরে থাকতো পানির উপরে । এমন দৃশ্য এখনো হয়ত অনেকেরই মনে আছে । মনে আছে এই নদীর স্বচ্ছ পানির কথা । পান করার জন্য কলসি ভরে পানি নিতো গ্রামের মা-বোনেরা । আগেকার সময় জাগায় জাগায় এত নলকূপ বা টিউবওয়েল ছিল না । শীতলক্ষ্ম্যা নদী ঘেঁষা মানুষের খাবার পানিই ছিল শীতলক্ষ্ম্যার পানি ।

শীতলক্ষ্ম্যা নদীতে মালবাহী  খালি জাহাজ

দুপুরবেলা দেখা যেত গ্রামের মা-বোনেদের নদী পাড়ে স্নান করার দৃশ্য । তখন নীট গার্মেন্টসের ডাইং এর বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি ছিল না । এই বিষাক্ত কেমিক্যালের পানিতে সব কেড়ে নিয়েছে শীতিলক্ষ্ম্যা থেকে । নদীর এপার ওপার দু'পারেই গড়ে উঠেছে রপ্তানিকারক নীট গার্মেন্টস । সাথে ডাইং, সিমেন্টের বিশাল বিশাল ইন্ডাস্ট্রিজ । আছে যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা আর ভূমি দস্যুদের নদীর পাড় দখল করা ।

এখন মানুষে স্নান করা তো দূরের কথা, পা ভেজাতে ভয় করে । যদি কোনো রোগব্যাধি হয়, তাই । প্রতিটি খেয়াঘাটের পাশে আছে প্রভাবশালীদের বালুর ব্যবসা । আছে যত্রতত্র ভাসমান ড্রেজার মেশিন । সব মিলিয়ে শীতলক্ষ্ম্যার গলায় ফাঁস লাগিয়ে রেখেছে । এই ফাঁস সীতলক্ষ্ম্যার গলায় লাগানো হয়নি । এই ফাঁস নারায়ণগঞ্জবাসীর গয়ায় লাগানো হয়েছে । এখন বর্ষা মৌসুম, নদী ভরা পানি । দেখা যায়, জোয়ার ভাটার পানিতে নদীর ভরা যৌবন ।

আসলে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে কাতান শাড়িতে যেমন দেখা যায় । ঠিক তেমনই দেখা যায় শীতলক্ষ্ম্যাকে । শীতলক্ষ্ম্যা এখন বৃদ্ধ, রোগাক্রান্ত কুষ্ঠরোগীর মতো । আগেকার সময় কারোর কুষ্ঠরোগ হলে, তাকে সমাজচ্যুত করা হত । কুষ্ঠরোগীকে দেশ, সমাজ ছেড়ে গহিন জঙ্গলে গিয়ে থাকতে হত । কুষ্ঠরোগীর শরীরে পাঁচন ধরতো, সারা শরীরে পোকা থাকতো । কুষ্ঠরোগীর শরীরের দুর্গন্ধে মানুষ তার সামনে যেত না । ঠিক তেমন একই অবস্থা এখন শীতলক্ষ্ম্যা নদীর । সামনে যেতেই নাকে রুমাল দিয়ে যেতে হয় ।

চীনের দুঃখ যেমন হুয়াংহো নদী, ঠিক নারায়ণগঞ্জবাসীর দুঃখ শীতিলক্ষ্ম্যা নদী ।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, হুয়াংহো নদী চীনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী । এর অপর নাম পীত নদী । হুয়াংহো নদীর সর্ব্বমোট দৈর্ঘ্য ৫৪৬৪ কিলোমিটার । আর এটিই হচ্ছে এশিয়ার ২য় বৃহত্তম নদী । নদীটির উৎপন্ন কুনলুন পর্বত থেকে আর পতিত হয়েছে পীতসাগরে । বস্তুত ছিংহাই প্রদেশের বায়ান হার পবর্তের উত্তরাংশে হুযাংহো নদীর উৎপত্তি হয়েছে । ছিংহাই, সিছুয়ান, কানসু , নিংশিয়া, অন্তর্দেশীয় মঙ্গোলিয়া, শাআনশি, শানশি, হনান আর শানতুং প্রদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুয়াংহো নদী শানতুং প্রদেশের খেনলি জেলায় বেহাই সাগরে গিয়ে মিশেছে । প্রাচীন চীনে প্রায়ই হুয়াংহো নদী ছাপিয়ে উঠে সবকিছু বন্যায় ভাসিয়ে দিত বলে এই নদীর নাম ছিল হুয়াংহো নদী অর্থাৎ পীতনদীকে "চীনের দু:খ" বলা হত । বর্তমান যুগে আর এই হুয়াংহো নদীর ব্যাপারে কিছু শোনা যায় না। 

আমাদের নারায়ণগঞ্জের শ্যিতলক্ষ্ম্যা

হুয়াংহো নদীর দুর্দশার কথা শোনা না গেলেও শোনা যায়, শীতলক্ষ্ম্যার কথা । কারণ আজ সেই ঐতিহ্যবাহী  পাড় দিয়ে হাটা যায় না । হাটতে হলে নাকে রুমাল দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না । কুচকুচে কালো পানির পঁচা পূঁতিময় দুর্গন্ধের কারণে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে নদী পারাপার হতে হয় ।

শীতলক্ষ্মা এখন আর সেই খরস্রোতা নদী নেই, নেই আয়নার মতো ঝকঝকা পানি । এখন পরিণত হয়েছে বিষাক্ত বর্জ্যরে ভাগাড়ে । আর দুই পাড়ে জমে থাকে ময়লার স্তুপ । বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শীতলক্ষ্মাকে । যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য এবং হৃদয়বিদারক । কেননা, শীতলক্ষ্ম্যার এই পঁচা পানিই শোধন করে আমরা জীবন রক্ষা করছি ।

জাপানের তৈরি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে পানি শোধন করা হয় । তারপরেও পানিতে সেই বিষাক্ত কেমিক্যালের পঁচা দুর্গন্ধ থেকেই যায় । যারা বিত্তশালী, তারা বাজার থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনে পান করে । যারা সীমিত অয়ায়ের মানুষ, তারা তো এই পানির উপরই নির্ভরশীল ।

আমাদের শীতলক্ষ্ম্যা নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২২৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার । বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক শীতলক্ষ্যা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর ৫৫ উত্তর-কেন্দ্রীয অঞ্চলের নদী । এই বিশাল দৈর্ঘের নদীটি আজ মৃত্যুর মুখে, সাথে আমরাও মরে যাচ্ছি । আগেকার সময় এই নদীর পানি চাষের জমিতে দিতো । এখন শীতলক্ষ্ম্যার পানি চাষের জমিতে দিলেই, জমির ফসল সব জ্বলে যায় । বর্তমানকালে নদির পাড় ঘেঁষে বহু নীট গার্মেন্টস ও ডাইং গড়ে উঠেছে । এগুলোর বিষাক্ত কালো পানি দু'পাড় থেকেই শীওতলক্ষ্ম্যায় এসে মিশে ।

সূক্ষ্ম মৌসুমে আসলে দেখা যায় পুরো নদীর পানির অবস্থা । তখন পানি দেখলে মনে হয়, কোনো এক ডাইং এর কেমিক্যাল মেশানো রং । এই রং এ যেকোনো সাদা কাপড় ছেড়ে দিলেই ব্যস, রং হয়ে যাবে । আর সেই বিষাক্ত কেমিক্যালের পানিই নারায়ণগঞ্জবাসী পান করছে নিরুপায় হয়ে । তাই আক্রান্ত হচ্ছে পেটের পিড়া সহ নানারকম জটিল রোগে ।

আগে যখন এই বঙ্গদেশে নীট গার্মেন্টস ছিল না, তখন নদীগুলোর এই অবস্থা দেখা যায়নি । এদেশে ৮০ দশকের দিকে নীট গার্মেন্টসের আবির্ভাব । তখন থেকে আমাদের দেশে শুধু ঢাকা নারায়ণগঞ্জেই ছিল দু'একটা গার্মেন্টস । আস্তে আস্তে যখন এর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন এই শিল্প স্থাপনের একটা নীতিমালাও তৈরি করে সরকার । প্রথম দিকে শুধু নীট গার্মেন্টসই ছিল, ছিল না নীট ডাইং ।

ধীরে ধীরে গার্মেন্টস শিল্প মালিকরা একসময় রাতারাতি আলাদীনের চেরাগ পেয়ে যায় । তখন শুরু হয় নীট গার্মেন্টসের সাথে ডাইং স্থাপন । আরম্ভ হয় বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্ম্যায় ডাইং এর বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি ফেলা । দুষিত হতে থাকে নদীমাতৃক দেশের নদীর পানি ।

একদিকে আমরা পেতে থাকি বৈদেশিক মুদ্রা, অন্যদিকে হারাতে থাকি পানিসম্পদ মাছ সহ অনেককিছু । অথচ সরকারের নীতিমালা মেনেই, একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় । প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন হয়ে গেলে, নীতিমালার কথা আর কারোর মনেই থাকে না । প্রতিটি নীট গার্মেন্টস স্থাপনকালে বলা হয় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কথা ।

গার্মেন্টসের সাথে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরিও করে অনেক মালিক । কিন্তু বিশাল ব্যয়বহুল হওয়ায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থাকে বন্ধ । আর শোধান ছাড়াই বিষাক্ত পানি ফেলে খালে অথবা নদীতে । এমনটা করছে পানি উন্নয়ন বোডের কিছু অসাধু কর্মচারীদের ম্যানেজ করে । তাদের এই সামান্যতম মাসোয়ারা পাবার লোভ, আমাদের মৃত্যু । অথচ তারা জাতীয় নদী রক্ষা আইন প্রয়োগকারী । তাদের যেই আইন প্রয়োগ করা জরুরি এবং যেই আইনের রক্ষক তারা । সেই আইনগুলো নিম্নরূপ:

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন

"নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসাবে গড়িয়া তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন ।"

যেহেতু নদীর অবৈধ দখল, পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসাবে গড়িয়া তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠন করা সমীচীন ও প্রয়োজন;
সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন প্রণয়ন করা হইলঃ

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩
( ২০১৩ সনের ২৯ নং আইন )
[২২ জুলাই, ২০১৩]

উপরোল্লিখিত প্রণীত আইন প্রয়োগ দাতারাই আজ মাসোয়ারার কাছে জিম্মি । ওইসব আইনগুলো শুধুই সাদা কাগজের ছাপা অক্ষর । কেউ মানছে না নদী রক্ষা আইন, জমাখরচও দিচ্ছে না কেউ কাউকে । তাই ওইসব অসাধু কর্মচারীগণের জন্য শিল্প মালিকরা হচ্ছে কোটিপতি । নদীগুলো হারাচ্ছে নব্যতা, পানি হচ্ছে  বিষাক্ত । আর মৃত্যুবরণ করছি পুরো নারায়ণগঞ্জবাসী ।

হুয়াংহো নদী চীনের জনগণকে ভাসিয়ে দিতো বন্যায় । আর শীতলক্ষ্ম্যার বিষযুক্ত পানিতে আমরা ঢলে পরছি মৃত্যুর দিকে । আমাদের সন্তানেরা হচ্ছে মেধাশূন্য, সাথে হচ্ছে রোগাক্রান্ত । তাই বলছি গণচীনের দুঃখ "হুয়াংহো" নদী, নারায়ণগঞ্জবাসীর দুঃখ "শীতলক্ষ্ম্যা" নদী ।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ