উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত হ্যামলেট নাটকটির নাম নিশ্চয়ই সবাই শুনে থাকবেন। ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটকে নিয়ে রচিত শেক্সপিয়রের এই কালজয়ী সৃষ্টি ইংরেজি সাহিত্যের অত্যন্ত জটিল ও শক্তিশালী ট্রাজেডি হিসেবে সাহিত্য জগতে স্বীকৃত। একে বর্তমান সময়ের এবং ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেছেন ভারতের খ্যাতিমান পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ। মকবুল,ওমকারা, কামিনে, ব্লু আমব্রেলা, সাত খুন মাফ ছবি গুলোর সুবাদে বিশাল ভরদ্বাজ ভারতের অন্যতম সেরা পরিচালক হিসেবে স্বীকৃত। ভিন্ন ধর্মী ফিল্ম মেকিং, ডার্ক কমেডি, ধারালো সংলাপ তার ছবির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। শেক্সপিয়র সাহিত্য নিয়ে বিশাল ভরদ্বাজের কাজও নুতুন কিছু নয়। এর আগেও তিনি শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ অবলম্বনে মকবুল , ওথেলো অবলম্বনে ওমকারা নির্মাণ করেছিলেন যা দর্শক ও সমালোচক মহলে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিল তবে এই কাজটি নি;সন্দেহে তার আগের কাজগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। এটা আমরা সকলেই জানি যে ৪৭ এর দেশভাগের মারাত্নক ক্ষত হিসেবে আবির্ভূত হয় কাশ্মীর সমস্যা। দেশভাগ পূর্ব জম্মু ও কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল মুসলিম যদিও এই রাজ্যের শাসনকর্তা মহারাজা হরি সিং ছিলেন একজন হিন্দু। দেশভাগের সময় ভারত কিংবা পাকিস্তান কারো সঙ্গেই যুক্ত না হয়ে স্বাধীন কাশ্মীরের ধারনার উপর সমর্থন দিয়েছিলেন মহারাজা হরি সিং। কিন্ত ভারত বর্ষের অন্যান্য জায়গায় সংঘটিত সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার আচ লাগে কাশ্মীরেও। বাড়তে থাকে সেখানকার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যকার উত্তেজনা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদদে তৈরী হয় উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করতে মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সেনা হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন। ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ধারণাকে সমর্থন দেন কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আব্দুল্লাহও। সংঘটিত হয় কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার প্রথম যুদ্ধ। এর পর থেকে কাশ্মীরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘঠিত হয়েছে আরো দুটো যুদ্ধ। উভয় দেশই কাশ্মীরের নিজ নিজ অধিকৃত অংশে মোতায়েন করেছে সেনাবাহিনী, সেই থেকে আজ অব্দি সেখানে চলছে স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতাবিরোধীর নামে ভারত পাকিস্তানের প্রক্সি লড়াই। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের এই দলাদলি সাধারণ কাশ্মীরিদের জীবনে যে দুঃখ দুর্দশা তৈরী করেছে মূলত তা নিয়েই গড়ে উঠেছে বিশাল ভরদ্বাজের এই ছবির প্লট। এখানে হ্যামলেট ওরফে হায়দার কোন রাজপুত্র নয় বরং সাধারণ এক কাশ্মিরি যুবক। কাশ্মীরের জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা আর আপনজনের বিশ্বাসঘাতকতা তার জীবনে যে ট্রাজেডি বয়ে এনেছে তারই মর্মান্তিক উপাখ্যান এই ছবিটি।
asda

হায়দার ছবির প্লট গড়ে উঠেছে ১৯৯৫ সালে কাশ্মীরে সংঘটিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতাকে কেন্দ্র করে। এখানে হায়দার আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক কাশ্মীরি যুবক ও শখের কবি। ভারতীয় সেনা বাহিনীর হাতে বন্দী হবার পর পিতা ডাঃ হিলাল মীরের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে সে আবার কাশ্মীরে ফিরে আসে। একদিন চাচা খুররম মীর ও মা ঘাজালাকে আন্তরিক খোশ গল্প রত অবস্থায় দেখে তার মধ্যে প্রবল সন্দেহ তৈরি হয়। সেই সঙ্গে পিতা হিলাল মীরকে খুজে পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ প্রতিজ্ঞ সে। পিতাকে খোঁজার মিশনে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে এফ আই আর দাখিল করতেও দ্বিধা হয় না তার। ঘটনা ক্রমে পুলিশ কমিশনারের সাংবাদিক মেয়ে আর্শি তার প্রেমিকা ও সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। পিতাকে খোঁজার মিশনে হায়দারের পাশে দাঁড়ায় আর্শি। এরই মধ্যে একদিন গল্পে রুহদার নামের এক রহস্যময় চরিত্রের আবির্ভাব উঠে। মুলত এর পর থেকে গল্পের কাহিনী অন্য দিকে মোড় নেয়। হায়দার জানতে পারে তার পিতা গ্রেফতার ও পরবর্তীতে নিহত হওয়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা নির্মম সত্যটিকে। পিতৃ হত্যার প্রতি শোধ নিতে উন্মুখ হয় হায়দার। হায়দারের এই প্রতি শোধ প্রবণতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে বিছিন্নতাবাদীরা। পরবর্তীতে সিনেমার গল্প এগিয়েছে মা ঘাজালা ও ছেলে হায়দারের মধ্যকার নানা মানসিক টানা পোড়ন ও কাশ্মীরের বিভিন্ন জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে।

asd

অভিনয়ের দিক দিয়ে বলব শহীদ কাপুর তার ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন এই ছবিতে। এই ছবিতে শহীদের পারফরম্যান্স বিশাল ভরদ্বাজের সঙ্গে করা তার আগের ছবি কামিনের পারফরম্যান্সকেও ছাড়িয়ে গেছে। মানসিক টানা পোড়নে আক্রান্ত ও বিভিন্ন ঘটনায় বিপর্যস্ত এক কাশ্মীরি তরুণের চরিত্রে শহীদ তার অভিনয় প্রতিভার সবটুকুই ঢেলে দিয়েছেন। পর্দায় তার প্রায় প্রতিটি অভিব্যক্তিই জীবন্ত ছিল। বিশেষ করে প্রকাশ্য জটলায় পাগল সেজে কাশ্মীরি জনগণের করুন বাস্তবতা তুলে ধরার দৃশ্যটির কথা না বললেই নয়। এছাড়া খুররম মীর চরিত্রে কে কে মেনন, আরশিয়া চরিত্রে শ্রদ্ধা কাপুরও যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। ছোট কিন্ত গল্পের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রুহদার রুপায়নে ইরফান খানও যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া হিলাল মীরের চরিত্রে অভিনয় করা নরেন্দ্র ঝার কথাও আলাদা ভাবে বলতে হবে। উপরোক্ত সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হয় হায়দার ছবির মূল প্রাণ ঘাজালা চরিত্রে অভিনয় করা টাবু। এরকম একটি কমপ্লেক্স ক্যারেক্টার আর কোন অভিনেত্রী এত স্বার্থক ভাবে রুপায়ন করতে পারতেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। একদিকে একমাত্র সন্তানটির প্রতি অকৃত্তিম ভালবাসা আরেকদিকে বর্তমান স্বামী খুররম মীরের প্রতি দায় বদ্ধতা , পাশাপাশি আগের স্বামীর নিহত হওয়ার পিছনে পরোক্ষ ভাবে জড়িত থাকার তীব্র অপরাধ বোধ এরকম বিভিন্ন মানসিক দ্বন্দে আক্রান্ত একজন মধ্য বয়সী নারীর ভুমিকায় টাবু ছিলেন রীতি মত অসাধারন। অনেক দৃশ্যে কোন সংলাপ ছাড়াই শুধু অভিব্যক্তি দিয়েই অনেক কিছু ফুটিয়ে তুলেছেন। এই অসাধারন পারফরম্যান্সের সুবাদে টাবু সে বছরের প্রায় সব কটি এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরষ্কার জিতেছিলেন। পরিচালক ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে বিশাল ভরদ্বাজও পুরো মার্কসই পাবেন। বিশেষ করে সংলাপের বেশ কিছু জায়গায় কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য প্রচলিত বিশেষ আইন AFSPA ( Armed Forces Special Power Act: যে আইনের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনী যে কোন সময় যে কাউকে গ্রেফতার করে ডিটেনশনে নিতে পারে) কে কটাক্ষ করতে হিব্রু শব্দ Chutzpah ব্যবহার মুগ্ধ করেছে। কাশ্মীরের নয়নাভিরাম প্রাকতিক সৌন্দর্যকে সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য সিনেমাটোগ্রাফার পঙ্কজ কুমারকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। ছবিটিতে কাশ্মীরের অপরুপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে কাশ্মীর সম্পর্কে বহুল চর্চিত সেই নির্মম বাণীটিকে মনে পড়ে যায় God made it heaven but man has turned it into a hell।
sdfds

ছবিটিতে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে দেখানো হয়েছে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নিরীহ ব্যক্তিদের গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলা নির্মম নির্যাতন ,গুম ,খুন কে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই তুলে ধরা হয়েছে।যদিও আমার কাছে মনে হয়েছে এ ব্যাপারে আরও একটু ডি্টেইলিং থাকলে ভাল হত। এটাই বলতে গেলে যা একটু দুর্বলতা। অবশ্য যা দেখানো হয়েছে তাতেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল ভরদ্বাজের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কথা মাথায় রেখে চাইলেও হয়তো তার পক্ষে এসবের খুব বেশী দেখানো সম্ভব ছিল না। সেসময় ভারতজুড়ে মোদি হাওয়ার নামে তৈরী হওয়া হিন্দুত্ববাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের মেকি জোয়ার থেকে বাদ যায় নি সেন্সর বোর্ডও। ছবিটির অনেক দৃশ্যে সেন্সর বোর্ড কাঁচি চালিয়েছে। তবুও এই ধরনের সাহসী বিষয়বস্তু নিয়ে সিনেমা নির্মাণ এবং সেই সিনেমার সফলতা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিপক্কতার সাক্ষ্য দেয়। একটা গান বাদ দিয়ে ছবির অন্য গানগুলো তেমন ভাল লাগেনি। উল্লেখ্য বিশাল ভরদ্বাজ শুধু মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে দুই বার ভারতের জাতীয় পুরষ্কার জিতেছেন। মিউজিক নিয়ে তার কাছে প্রত্যাশা আর একটু বেশীই ছিল। সেই প্রত্যাশা পুরন না হওয়ায় খানিকটা অতৃপ্তি রয়েছে। তবে আবহ সঙ্গীত যথেষ্টই ভাল ছিল। ছবির শেষে মেসেজ হিসেবে কাশ্মীরে বন্যায় দুর্গতদের সাহায্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীর অবদানের কথা উল্লেখ করাকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। সম্ভবত সেন্সর বোর্ডের সুনজর পাওয়ার আশায় এটি যোগ করা হয়েছে। যাই হোক যে কোন মহৎ শিল্প কর্মই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। সব দিক বিবেচনায় বলা যায় হায়দার একটি অসাধারন সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা, একটি পরিপূর্ণ ও নিঃসন্দেহে ২০১৪ সালের সেরা বলিউডি ছবি। ছবিটি শুধু ভারতে নয় খ্যাতি অর্জন করেছে দেশের বাইরে থেকেও, জিতেছে রোম চলচ্চিত্র উৎসবে জনপ্রিয় বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার। এছাড়াও জিতেছে ৫টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র ও ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার। বিশাল ভরদ্বাজ এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার পরবর্তী ছবি রেঙ্গুনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। এখন সেই সিনেমাটি দেখার অপেক্ষায় আছি। যারা এখনো হায়দার দেখেননি ইচ্ছে হলে দারূণ এই ছবিটি দেখতে পারেন।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ