দক্ষিণ বঙ্গের জেলাসমূহের সঙ্গে সুন্দরবনের কেবল ভৌগলিক সংযোগ নয়, ঐ অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নিবিড় সংযোগ রয়েছে। সুন্দর বনের কাঠ-খড়, গোলপাতা, মধু ও নদী নালার মাছ প্রাচীন কাল থেকেই পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠীর জীবিকা উপায় সরবরাহ করে আসছে। বন থেকে কাঠুরিয়া কাঠ-খড়, বাওয়ালিরা গোলপাতা, মৌয়ালরা মধু, জেলেরা মাছ সংগ্রহ করে থাকে। তারা যখন বনে প্রবেশ করে, তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মন্ত্রগুণী ও পূজারী সংগে রাখেন। সুন্দরবনে বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর কবলে পড়ে আজও প্রতিবছর বহু মানুষ প্রাণ হারায়। এমনকি এসব শ্রমজীবী মানুষ নানাপ্রকার অন্ধবিশ্বাসে অশরীরী ভূত পেত্নীর ভয় করে। তাদের ধারনা অশরীরী কোনো আত্মা নারীর রূপ ধারণ কর তাদের বন্দি করে রাখে, অর্থাৎ তারা দিক হারায়।

যেহেতু আমি সুন্দরবন এলাকার মেয়ে তাই অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে আমার। যেমনঃ আমাদের বাসায় মায়ের কাজে সহযোগিতা করার জন্য এক খালা ছিল, অনেক দিন ধরেই সে আমাদের বাড়িতে আছে। খালার স্বামি জঙ্গলে বা বাদায় মানে সুন্দরবনে গোলপাতা কাটতে যেতো। খালু যতদিন জঙ্গলে থাকতো খালা চুলে চিরুনি দিত না, গায়ে সাবান মাখত না, মাছ খেত না। আমার ভাগ্নি ছিল খুব দুষ্টু, ওর যেহেতু নানি হয় তাই ইচ্ছে করে খালার গায়ে সাবান মেখে দিত। ওমনি খালা, বনবিবিকে ডাকা শুরু করত। বনবিবির কাছে মাফ চাইত হাজারবার। এই হল ওখানকার সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। যাই হোক, এসব প্রাকৃতিক ও ভৌতিক শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অসহায় ও দুর্বল মানুষ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী দেবদেবী ও পীর পীরানির কল্পনা করে তাঁদের আশ্রয় কামনা করেছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সানা তন্ত্র মন্ত্র, মানর ও পূজা ইত্যাদি উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই সুন্দরবনের অধিপতি রূপে একাধিক পীর দেবতার নাম পরিচয় ও পূজা মানত প্রচলিত আছে। তারা হলেন গাজী পীর, দক্ষিণ রায়, বনবিবি, বন দূর্গা, নারায়ণী ইত্যাদি। বস্তুত তাদের কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই, তারা সম্পূর্ণ লৌকিক। লোক সংস্কৃতি থেকেই তাদের জন্ম, লোকমানস তাদের লালন করেছে। বনে যাওয়ার পথে তাদের থান বা বেদী আছে। বেদীতে তারা কারও কারো প্রতীকী মূর্তি, কারো প্রতীক প্রস্তর খন্ড রাখা আছে। বনজীবীরা যাওয়া আসার পথে তাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্র পাঠ ও মানত করে। তাদের আরাধ্য দেবতা ও পীর বন্য প্রানীর আক্রমন থেকে রক্ষা করেন। তারা কাঠ পাতা, মধু, মাছ সংগ্রহ করে নির্বিঘ্নে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে।

বৈদিক যুগে মানুষের কামনা বাসনা পরিপূর্ণ করার জন্য দেবদেবী গন যেমন বিভিন্ন মূর্তির রূপ গ্রহন করেছিলেন ঠিক তেমনি সুন্দরবনের আরাধ্য দেবদেবীর আদিম সুন্দরবন বাসীর মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন মূর্তির আকার ধারণ করেছেন। বৈদিক যুগে স্বর্গের দেবতা সূর্য, আকাশের দেবতা বায়ু, পৃথিবীর দেবতা অগ্নিরূপে কল্পনা করা হতো। মূলত এগুলো সব মানুষের কল্পনায় গড়া বিশ্বাস। সেই মতে তারা পূজোও করতো। কেবলমাত্র তাই নয়, পর্বত বনস্পতি তীরধনুক ইত্যাদি বিবিধ প্রকরণও দেবতা হিসেবে আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। বেদের এক দেবতার নাম উচ্ছিষ্ট । ঋক বেদের শেষ পর্যায়ে, শ্রদ্ধা, জ্ঞান প্রভৃতি অমৃত ধারনা ও দেবতারূপে তাদের জীবনে স্বীকৃত। তবে এরা হলেন গৌণ দেবতা। বিষ্ণু ছিলেন বৈদিক যুগের অতি গৌণ দেবতা, কিন্তু পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুর মহিমা এত বিশাল আকার ধারণ করেছে যে, তাকে নিয়েই রচনা করা হয়েছে এক বিশালাকার পৌরাণিক গ্রন্থ "বিষ্ণু-পরাণ"। সুন্দর বনের দেবদেবীও এই ভাবধারার স্রোত থেকে বিচ্যুত নয়। তবে বহু পরবর্তীকালে সৃষ্ট হয়েছে বলে সুন্দরবনের দেবদেবী কল্পনায় হিন্দু-মুসলমানির প্রভাব দেখা যায়। মুসলমান ও হিন্দুদের যৌথ সংস্কৃতি ও কামনা বাসনার প্রতীক স্বরূপ বহু দেবদেবীর সৃষ্টি হয়েছে। যেমনঃ এ প্রসংগে প্রথমেই বলা যায় সুন্দরবনের প্রধান অধিষ্ঠাত্রী দেবী বনবিবির কথা। ইনি বনজীবী হিন্দু মুসলমান উভয়েরই কাছে দেবী হিসেবে পরিচিত। এবং বিশেষ শ্রদ্ধা নিয়েই তার পূজা করা হয়। তাই প্রথমে বনবিবিকে নিয়েই কথা বলিঃ

বনবিবিঃ আমরা জানি মুসলমানরা পৌত্তলিক নয়। তবুও প্রকৃতপক্ষে বনজীবী মুসলমানদের জন্য বনবিবি কল্পনাপ্রসূত এক দেবীমূর্তি। সাধারণত মুসলমান অবশ্যই কোনো দেবদেবীর পূজো করে না। কিন্তু বনজীবী মুসলমানরা সমানভাবে বনবিবির পূজো করে, প্রশ্ন আসতে পারে কেন ? আসলে সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর নরখাদক ব্যাঘ্রকুলকে ভয়ে এবং প্রাণ বাঁচার তাগিদে এরা বনবিবির উদ্দেশ্যে মানত করে।

জহুরা নামে যে পাঁচালি পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, বনবিবি ইব্রাহিম নামে এক ফকিরের কন্যা।এর ভাইয়ের নাম জঙ্গাল শাহ্। মাতার নাম গুলাল বিবি। ইনি এবং এর ভাই দক্ষিণ রায়ের অত্যাচার থেকে বনবাসীদের রক্ষা করতে, আল্লাহর আদেশে সুন্দরবনে আবির্ভুত হন। বনবিবির জন্মবৃত্তান্ত খুবই আকর্ষনীয়। বনবিবির জন্মদায়িনী মাতাকে তার পিতা নির্জন বাদাবনে গর্ভাবস্থায় তার প্রথম স্ত্রীর প্রোরচনায় বিসর্জন দেয়। গভীর জঙ্গলে অতি অসহায় অবস্থায় এরপর তার মাতা জমজ সন্তান প্রসব করে। এবং নিঃসহায় হয়ে কন্যাকে ত্যাগ করে শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। এই শিশু কন্যাই পরবর্তীকালে বনবিবি এবং শিশু পুত্রর নাম জঙ্গাল শাহ্। যাইহোক কথিত মতে, আল্লাহর আদেশে এক হরিণী ঐ শিশুকন্যা বনবিবিকে জঙ্গলেই লালনপালন করেন। ক্রমে ক্রমে সাত বছর গেল কেটে। বনবিবি হরিনের ঘরে।

"বনের হরিণ যত খোদার ফরমানে।

বনবিবিকে পারওয়ারিশ করে সেই বনে"।

গুলবিবি জঙ্গল শাহ্কে নিয়ে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে বনবিবির সংগে আল্লাহর কৃপায় মিলিত হয়। ভাইবোন ও মা একসঙ্গে মিলিত হবার পরে তাদের ভাটির সুদূরে যাবার আদেশ আসে। কিছুদিন পরে ইব্রাহিম তার দুষ্কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বনে গুলাল বিবিকে খোঁজ করে এসে পত্নী ও পুত্র কন্যার দেখা পায়। এবং পত্নীকে রাজি করিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু বনবিবি ভাইকে বলে," মা বাবার সংগে যাবার দরকার নেই। বনবিবি গেয়ে ওঠেনঃ

আঠার ভাটিতে যেতে হবে আমাদের

খোদার হুকুম এয়ছে আমাদের পরে

আমাদের জহুরা জাহের সেথা হবে

খবরদার মা বাপের সাথে না যাইবে।।

বোনের কথা শুনে শা জঙ্গালি বোনের কাছে থেকে গেল। আর বিষণ্ন মনে তাদের পিতামাতা নিজের ঘরে ফিরে গেল। এবং বনবিবি পিতামাতাকে বিদায় দিয়ে ভাইকে নিয়ে মদিনাতে রওনা হয়। সেখানে গিয়ে কামেল নবীর আওলাদের কাছে মুরিদ হয় এবং কালাম শিক্ষা করে। তাছাড়া ভাইবোন দুজনে নবীর রওজায় গিয়ে রোজ দুরুদ সালাম পাঠ করে। তারপর জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে মা ফাতিমার রওজা শরীফে পৌছায়। এবং দুরুদ পাঠ করে। আর বর লাভ করে, বনে কিংবা রণে কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। এবং তার উপর খোদার নির্দেশ থাকে যদি কেউ বিপদে পড়ে, তাকে স্মরণ করে মেন বনবিবি তাদের রক্ষা করতে পারে। এভাবে আদেশ পেয়ে বনবিবি তার ভাইকে নিয়ে মদিনা শহর থেকে নেকালিয়া যায়। তারপর রারা হিন্দুস্থানে এসে গঙ্গানদী পার হয়ে ভাঙড় শাহ্ এর কাছে আসে। ভাঙড় শাহ্ তাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে বনবিবি পরিচয় দেয়। এবং তার কাছে ভাটির দেশের পরিচয় ও ভাটি দেশ দখলের কৌশল জানতে চায়। ভাঙড় শাহ্ তাকে জানায় দক্ষিন রায় ভাটির অধীশ্বর এবং সে খুবই খল প্রকৃতির। কাজেই তার কাছে ভাটির দেশের মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। সুতরাং সে যেন ভাটির দেশ অধিকার করে।

চলবে,,,,,

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ