সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি ( পীর-দেব-দেবী)-৪

রিতু জাহান ২১ জুলাই ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০১:৩৫:২১অপরাহ্ন এদেশ ২৩ মন্তব্য

।"এদিকে ধোনা মোনা মোম মধু ঘরেতে আনিল
তামাম শহরে তার খবরও হইল।।
কইল সকলকে ডাকিয়া, বাঘের পেটেতে দুখে গেছে গো হারিয়া।।

এই কথা শুনে, দুখের মা বারে বারে মুর্ছা যায়।

"এইরূপ কান্দে বুড়ি ফেরে বাড়ি বাড়ি।
কানে কালা চক্ষু অন্ধ ক্ষীণ হইল নাড়ী।।

মনে মনে বনবিবিকে ডাকতে লাগল দুখের মা।

"অন্তর যামিনী মাতা জানিতে পারিল।
দুখের মাতার দুঃখে দুঃখিত হইল।।"

বনবিবি দুখের মায়ের কথা ভেবে দুখেকে তার মায়ের কাছে পাঠানোর চিন্তা করল।

"বিবি বলে যাহা বাছা, ঘরে যা আপনা।।
বুড়ি মাতা কান্দে তোর হয়ে জারে জার।।"

কিন্তু দুখে বনবিবিকে ও বন ছেড়ে লোকালয়ের অভাবে আসতে চায় না। পেটের কষ্ট যে বড়ই কষ্ট। না মানে এই কষ্ট মায়েরও ব্যাথা। তখন " বনবিবি বলে
ব্যাটা মোর, কোরোনা ভাবনা।।
আমি তোর পিঠ পরে আছি পোস্ত পানা।।
যখন ধ্যায়ান তুমি করিবা আমার।।
মুহূর্তে যাইয়া দেখা দিব গো তোমার।।

দুখেকে বুঝিয়ে বনবিবি এক কুমিরের পিঠে উঠিয়ে গ্রামে পৌছে দিল।

"পৌছাল ঘরে যখন দুখে আপনার।।
দেখে বুড়ি মা তার পড়ে আছে হইয়া লাচার।।
চক্ষে নাহি দেখে, কানে না পায় শুনিতে,
এসব দেখে দুখে কান্দে দর্দ্দ দিলে।

মনের দুঃখে দুখে বনবিবির স্বরনাপন্ন হল। দুখের স্বরনমাত্র বিবি এসে দেখা দিল। দৈব শক্তিতে দুখের মাকে সম্পর্ণ সুস্থ করল। বনবিবি চলে গেল। মা তার জ্ঞান ফিরে দুখেকে দেখে আনন্দে আত্নহারা হল। ছেলের কাছে সব শুনে, বনবিবির অপার করুনায় কৃতজ্ঞ হয়ে ছেলেকে বলল,"বাচাইল তোরে পাক জাত।। বনবিবির নামে ক্ষীর কর হে খয়রাত।। তখন বুড়ি মার কথামতো দুখে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষক করে, চাল চিনি দুধ এনে ক্ষীর বানাইল। এবং বনবিবির থান তৈরি করে পূজো দিল। গ্রামের লোককে প্রসাধ বাটিল। কথিত আছে গ্রামে সেই থেকে বনবিবির পূজো শুরু হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে বনবিবির পূজোর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। ব্রাক্ষণ ছাড়াই ভক্তরা তাশের নিজেদের সামর্থ মতো পূজো দেয়। অনেকে বিবির নামে মানত স্বরূপ বনে জ্যান্ত মুরগি ছেড়ে দেয়। এ মুরগি কখনোই কেউ ধরে না। এগুলো সবই বনবিবির মুরগি। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার রমজান নগর ইউনিয়নের মুন্ডাপাড়া মন্দিরে পৌষ মাসে বনবিবির পূজোর আয়োজন করে আদিবাসি মুন্ডারা।

যাইহোক, এদিকে দক্ষিণ রায় বার বার বনবিবির কাছে হেরে যাওয়াতে বনের আরেক পীর গাজিপীরের কাছে যায়। গাজি পীর দক্ষিণ রায়ের স কথা শোনে।

"গাজি বলে দক্ষিণা তুমি না জান সন্ধান
বনবিবি নাম তার ভাটির প্রধান।।
না বুঝিয়া ফ্যাসাদ করিলে তাহারও সাথে।
তোমাকে হয়রান তাই হইতে হবে হার রাইতে।।

এরকম কথাবার্তা যখন হচ্ছে তখন ঠিক সেই সময় জঙ্গাল শাহ্ সেখানে পৌছাল। তখন দক্ষিণ রায় ভয়ে গাজি পীরের পিছনে পলাল। গাজি পীর জঙ্গাল শাহকে অনুরোধ করল দক্ষিণ রায়কে ক্ষমা করে দেবার জন্য। কিন্তু জঙ্গাল শাহ বলল,"মানুষ ধরিয়া খায় কাফের গাঙ্গার।। দেখাইয়া দিব মজা দেখিব এবার। তবুও গাজিপীর দুইজনকে সাথে নিয়ে বিবির কাছে গেল। বিবি খুবই বিরক্ত হইল। একজন দরবেশ কেমন করে এক নরখাদকের হয়ে মিনতি করতে আসে। নরখাদক এর পাপ অমার্জনীয়। ( এখানে এই সমাজের ও অনেক মিল। এসব নরখাদকের হয়ে বাস্তবিকই কতো যে তোষামদি লোক আছে তার হিসেব নেই)। বিবি বলল, যে দুখেকে সে খাইরে উদ্দ্যত হয়েছিল সেই দুখের সব রকম দুঃখ কষ্ট যদি লাঘব হয়, তবেই দক্ষিণ রায় মাফ পাবে। " কহে বনবিবি এক ব্যাটা মোর দুঃখে ছিল।।

তার দুঃখতে আমি আছিনু কাতর।।

তখন গাজি প্রতুশ্রুতি দিল, দুখের সব দুঃখ কষ্ট লাঘব করার। কিন্ততু বিবি জিজ্ঞেস করল, এসব দুখে পাবে কিভাবে ? গাজি পীর বলল, পাবে সব ঘরেতে বসিয়া। তাই একদিন বনবিবি দুখেকে স্বপ্ন দেখা দিল, বলল, দুঃখ লাঘব হবে গাজি পীর ও দক্ষিণ রায়কে স্বরন করিলে। তাই হল। দুখের অনেক সম্পদ হল। প্রজা পালন করিতে লাগল। ক্রমে দুখের সুখ্যাতি চারিদিক ছড়িয়ে পড়ল।

" দুখের রাজ্যে প্রজা থাকে আরামেতে।
বিনা খাজনায় বাস করে গরীবেতে।।
তাবেদার রইল ঘাতক জমিদার।।

এই কাহিনিটি বনবিবির 'জহুরানামা' পুঁথিতে পাওয়া যায়।

আরণ্যক জীবনের প্রবঞ্চক ও প্রবঞ্চিতের বেঁচে থাকার আশ্চার্য্য বাস্তবতা ফুটে উঠেছে এই আখ্যানে। বাউলে মউলে, মৎসজীবি, চোরা শিকারি প্রভৃতি জঙ্গলগামি মানুষেরা জঙ্গলে যাবার আগে নিকটবর্তী বনবিবির কোনো এক থানে পূজো অর্থাৎ মানত দিয়েই তবে জঙ্গলে ঢোকে। জঙ্গলে গিয়েও তারা দেবীর পূজো দেন। জঙ্গলে বিবির দুইরকম মুর্তি দেখা যায়। একটিতে মাথায় তার টুপি, চুল বিনুনি করা, কপালে টিকলি, গলায় হার, পরনে পাজামা, পায়ে জুতো, কোলে একটি বালক। কোথাও বাঘের পিঠে, আবার কোথাও মুরগির পিঠে আরুঢ়া। ভক্তজনের বিশ্বাষ কোলের বখলকটি সেই দুখে। অন্য একটি মুর্তিতে দেখা যায়, মাথায় মুকুট, গলায় হার ও বনফুলের মালা, সর্বাঙ্গে নানা অলংকার এবং কোলে মানব মূর্তি।

পৌষ সংক্রান্তি থেকে সারা মাঘ মাস জুড়ে তাঁর বার্ষিক জাঁতাল পূজো হয়। পূজা - হাজাত উপলক্ষে জাঁকজমকভাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে। উৎসব চলে চৈত্রমাস পর্যন্ত। জয়নগর থানার রামরুদ্রপুরের হরিণখালির মাঠে, বিবির মেলাটি বেশ আকর্ষনীয়। একসময় এই অঞ্চলের বিস্তির্ণ বনভূমিতে বাঘ, হরিণের বিচরনক্ষেত্র ছিল। বিচিত্র এই বনভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বনবিবির মেলা। মেলার দিন বিকেলবেলা দূরদূরান্তত থেকে প্রচুর মানুষ এই মেলায় আসে। েবেলা যতো গড়াতে থাকে মেলায় উপচে পড়ে লোকের ভিড়। মহিলারা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যায় মন্দিরে। বনবিবি ও তার আশ্রিত বাঘকুলের জন্য জঙ্গলের বেশ গভীরেই ছেড়ে দিয়ে আসে তার ভক্তজনেরা জীবন্ত মোরগ মুরগী। মেলায় বসে তরজা, বাউল, পাঁচালি গানের আসর। পয়লা মাঘ সারারাত ধরে বিবির জাঁতাল পূজো উপলক্ষে জয়নগর থানার হলদিয়া গ্রামের ডন্ডল পরিবারের উদ্যোগে গ্রামব্যাপি মেলা বসে। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে চলে আসছে এই মেলাটি। এই প্রাচিন মেলাটি সুন্দরবনে বিরল। বিবির মেলা নামে আরো একটি শতাব্দি প্রাচীন মেলা হয় বাসন্তি থানার ভরতগড়ে। প্রায় একশো বছর আগে পঞ্চানন্দ দাস নামে ভূস্বামী মহেশচন্দ্র চৌধুরির একজন নায়েব এই মেলার সূচনা করে। মাঘ মাসের পয়লা থেকে এই মেলা তিনদিন ধরে চলে। এখানে বিবির সাথে দক্ষিণ রকয় ও জঙ্গাল শাহ ও পূজিত হন।

বনের মধ্যে বনবিবির কতোইরে ভাই খেলা
চার দিকেতে ছড়িয়ে আছে তারি মায়ালীলা
তার কৃপা হলে পরে আবার ছুটে আসব
বাদাবনে আরো কেচ্ছা তখন জেনে যাব।।

চলবে,,,,,,,,,

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ