সুন্দরবনের উপকণ্ঠে মগ-ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ –১ 
সুন্দরবনের উপকণ্ঠে মগ-ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ – ২

মগ-ফিরিঙ্গীদের কুকীর্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক শিহাবুদ্ধিন তালিশের বর্ণনা থেকে জানা যায় পর্তুগিজদের মতোই মগ জলদস্যুরা জলপথে এসে বাঙলা লুণ্ঠন করত। স্ত্রী পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান সকলকেই বন্দি করে তাদের হাতের তালু ছিদ্র করে সরু বেত প্রবেশ করিয়ে এবং একজনের ওপর আরেকজনকে চাপিয়ে জাহাজের পাটাতনের নিচে ফেলে রাখত। পাখিকে যেমন মানুষ আহার দেয়, তেমনি করে তারা প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা উপর থেকে বন্দিদের মধ্যে চাল ছিটিয়ে দিত। প্রকৃতপক্ষে এদের শেষ পরিণতি ছিল মানুষের হাঁটে বেচাকেনার মধ্য দিয়ে অনির্দেশ যাত্রা। অরবিন্দ পোদ্দার উল্লেখ করেছেন, অষ্টাদশ শতকে প্রণীত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৭১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মগরা বাঙলার দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আঠেরশো নাগরিক ও বালক বালিকা ধরে নিয়ে যায়। তারা আরাকান পৌছায় দশ দিনে। বন্দিদের উপস্থিত করা হয় আরাকান রাজের সম্মুখে। তিনি শিল্পকর্ম জানে এমন লোকদের নিজের দাস হিসেবে রেখে দিতেন, এদের সংখ্যক হত এক চতুর্থাংশ। অবশিষ্ট বন্দিদের গলায় দড়ি বেঁধে বাজারে নেওয়া হত এবং তাদের শারী্রিক বলের পরীক্ষা করে কুড়ি থেকে সত্তর টাকা দরে বিক্রি করা হত। মগের অত্যাচার প্রসংগে ঐতিহাসিক তালিস অন্যত্র লিখেছেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তাদের যাতায়াতের পথে নদীর উভয় পাশে একজন গৃহস্থ আর অবশিষ্ট থাকল না। মগ সম্প্রদায়ের ক্রমাগত ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বাকলার মতো সমৃদ্ধশালী জনবসতিপূর্ণ জেলায় এমন একটি বাড়ি অবশিষ্ট ছিল না, যে বাড়িতে অন্তত একটি মানুষ ঘরে প্রদীপ জ্বালাতে পারে।

বীরেন্দ্রনাথ ভট্টচার্য্য লিখেছেনঃ গাঙ্গেয় বদ্বীপ থেকে সুদূর আরাকান পর্যন্ত এত অত্যাচার সহ্য করেও যারা বেঁচে থাকতেন, তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে কিছু কিছু পুরুষ নারীকে তারা নিজেদের কাছে কৃতদাস দাসী করে রাখত। অন্যদের চড়া দামে বিক্রি করত। ক্রেতা ছিল ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ বণিকেরা।এসকল বণিকেরা দাসত্বের প্রয়োজনে মানুষ ক্রয় করে নিয়ে যেত উপনিবেশ রাষ্ট্রের শ্রমবাজারের ঘাটতি পূরণের জন্য। ষোল শতকের কোনো এক সময়ে এসকল দেশের অধীনে ছিল পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশ। আজকাল ইউরোপের গড়ে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে ভারতবর্ষ অর্থাৎ বাঙলার এসব দাসদাসীরা।

ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়াঁ বার্ণিয়ের দীর্ঘদিন ভারতে কাটিয়েছেন। তিনি বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত সেকালের সামাজিক জীবনের এক অনবদ্য ইতিহাস। তিনি লিখেছেনঃ বাঙলার সীমান্তে আরাকান রাজ্যে বা মগদের দেশে পর্তুগিজ ও অন্যান্য ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। গোয়া সিংহল, মালাক্কা, কোচিন প্রভৃতি দেশ থেকে এসে এরা এখানে আশ্রয় নিত। এমন কোনো অপকর্ম ছিল না যা এরা করতো না। তারা নামেই শুধু খৃষ্টান ছিল, তাদের ধর্মের যে শান্তির বাণী তা তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না। খুন জখম, ধর্ষণ লুঠতরাজ, ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের সমকক্ষ কেউ ছিল না। এই পর্তুগিজ দস্যুরা, মগদের উস্কানি পেয়ে রীতিমতো যথেচ্ছাচার করতে আরম্ব করল। তারা গ্রামের হাটবাজারের দিন ও উৎসব পার্বণের দিন হানা দিত এবং লোকদের বন্দি করে নিয়ে যেত কৃতদাস বানানোর জন্য। অনেক সময় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। নিন্ম বঙ্গের কত শত গ্রাম এইভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে ও অত্যাচার করেছে এবং গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য করেছে তার কোনো হিসেব নেই। অন্যত্র তিনি লিখেছেনঃ সমুদ্রের কাছাকাছি অনেক দ্বীপ এখন প্রায় জনবসতিশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রধানত আরাকানের জলদস্যু বা বোম্বেটেদের অত্যাচারে এইসব দ্বীপ ছেড়ে মানুষ চলে গেছে। এখন এই দ্বীপ দেখলে মনে হয় না যে, এককালে লোকালয় ছিল। ধু ধু করছে জনমানবশূন্য গ্রামের পর গ্রাম। তখনকার বিভীষিকাময়তার দিনের কথার প্রমাণ মেলে প্রাচীন মানুষজনের জিজ্ঞেস করলে। ঐ সময় বর্তমান ভোলা কয়েকটি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। প্রশাসনিক কেন্দ্র থেকে বহুদূরে অবস্থিত অঞ্চলগুলোতে বর্গীরা এসে লুণ্ঠন করে চলে যেত। পশু আর মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না বর্গীদের কাছে। সুন্দরবনাশ্রিত প্রাচীন জনপদগুলোর মধ্যে ভোলা, হাতিয়া, মনপুরা ছিল তাদের লীলাভূমি। ১৫৫৭ সালে ডি সিলভেরা নামক জনৈক পর্তুগিজ হার্মাদ ভোলা দখল করে নিয়েছিল।

এ দুরাত্নাদের দুরাচার সামাজিক জীবনকে যে কিভাবে বিপর্যস্ত করেছিল, সে সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বিভিন্ন বংশের, প্রধানত ব্রাক্ষণের কুলজী থেকে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছিলেন। বস্তুত বাঙলার বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার সে যুগে মগের দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পায়নি। মগের এই দৌরাত্ম্যের জন্য সপ্তদশ শতাব্দীর বাঙলার রাঢ়ীয় ব্রাক্ষণ সমাজে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। মগ - ফিরিঙ্গিদের স্পর্শদোষ জনিত কারণে সৃষ্টি হয়েছিল একটি স্বতন্ত্র সমাজ। সমাজটি 'মগদোষ' নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। এই বিষয়টি প্রথম উদ্ঘাটন করেছিলেন দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। বিভিন্ন কুলপঞ্জী থেকে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এ তথ্য যদি উদ্ধার না করত, তবে বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায়ের কথা হয়ত আমাদের অগোচরেই থেকে যেত। উল্লেখ্য নদীয়া, যশোর, হুগলি, চব্বিশ পরগণা এবং সুন্দরবনাশ্রিত বিভিন্ন জনপদের একাধিক স্থানের বহুসংখ্যক পরিবারের পূর্বপুরুষদের স্ত্রী-কন্যা সকল দুরাত্মাদের দ্বারা অপহরণের কারণে তারা আর সমাজে ঠাঁই পায়নি।

মধ্যযুগের বাঙলা গ্রন্থে কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনঃএই সম্পর্কে। সেকালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, অপহৃত এইসব নরনারী মেদিনীপুরের সমুদ্র তীরবর্তী পিপিলি বন্দরে বিক্রি হত। সৌভাগ্যবশত মগদের হাত থেকে কোনো নারী পালিয়ে এলেও সমাজ তাদের আর গ্রহন করেনি। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য একটি পরিবার সম্পর্কে লিখেছেন, একজন স্বামী মগ স্পর্শদোষে কলঙ্কিত স্ত্রীকে স্বআবেগে গ্রহণ করলেও সমাজ তাকে সমাজচ্যুত করতে ছাড়েনি।

পূর্ব বঙ্গের 'নসর মালুম' পালায় এই মগ -বর্গীদের অত্যাচার সম্পর্কে নিম্নরুপ চিত্র তুলে ধরা হয়েছেঃ

পশ্চিম দিকেতে রাজ্য দরোয়ার শেষ।

মানষে মানুষে বেছি খায় আচানক দেশ।।

দাড়ি মাল্লা ছিল যত ছুয়নি টেগুল।

সেই দেশেতে সক্কলে বেচে ডাকুর দল।।

মুহম্মদ আব্দগল জলিল লিখেছেনঃ 'সপ্তদশ শতকের আরাকান রাজ সভাকবি আলওয়াল পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম থেকে আরাকান যাত্রাকালে জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হন এবং তার পিতা শাহাদত বরণ করেন।

মগদের তান্ডব আর অমানুষ সুলভ আচরন মুঘলদের ও হত-বিহ্বল করে ছেড়েছিল। কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় লাখেছেনঃ 'মুঘল নাবিকেরা মগদিগকে এত ভয় করিত যে বহুদূর হইতে চার খান মগের জাহাজ দেখিলে একশত মোঘল পোত থাকিলেও মোগল নাবিকেরা কোনো প্রকার প্রাণ লইয়া পালাইতে পারিলেই সাহস ও বীরত্বের জন্য প্রশংসিত হইত। আর যদি হঠাৎ মোঘল ও মগ পোত কাছাকাছি আসিয়া পড়ি, তবে মোঘলরা অবিলম্বে জলে ঝাঁপ দিত এবং ডুবে মরাকে তারা বন্দিত্ব অপেক্ষা শ্রেয় মনে করত।

এ সকল বোম্বেটেদের চিত্রন করতে গিয়ে সতীশচন্দ্র মিত্র উল্লেখ করেছেনঃ 'বংশকাহিনীর তথ্য জানিতে গিয়ে গল্প শুনেছি, একটি স্ত্রীলোক নদীর ঘাটে স্নান করিতেছিল, এমন সময় দুই জন মগ দস্যুতার উদ্দেশ্যে নাও হইতে পারে, অন্য কোনো কারণে পার্শ্ববর্তী পথ দিয়ে যাইতেছিল। স্ত্রীলোকটি মগের ভয়ে জলে ডুব দিয়া রহিল, ভাবাল মগেরা চলিয়া গেলে উঠিয়া যাইবে। কিন্তু একজন মগ ভাবল, স্ত্রীলোকটি বোধ হয় আত্মহত্যা করার জন্য ডুব দিয়েছে। অমনি সে ছুটিয়া গিয়া জল হইতে চুল ধরিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়া ডাঙ্গায় আনিল। পরে জীবিত দেখিয়া ব্যাপার বুঝিয়া তৎক্ষনাৎ তাহাকে ছাড়িয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। স্ত্রীলোকটি কিন্তু শুধুমাত্র সেই স্পর্শটুকুর জন্য দোষী হইয়া চিরজীবনের জন্য কলঙ্কিত হইয়া থাকিল।

এ যুগের মানুষ ভুলে গেছে বর্গি হাঙ্গামার ভয়ে ইংরেজরাও ছিল তটস্থ। মারাঠা বর্গীদের ঠেকাতে ইংরেজরা খনন করেছিল পরিখা, যক মারাঠা ডিচ নামে পরিচিত। মারাঠাদের উপদ্রবে বঙ্গবাসী সেদিন যেন ছিল কম্পমান। কোম্পানির সাহেবদেরও অবস্থা ছিল তথৈবচ। কলকাতা সবে সাহেব যুগে পদার্পণ করেছে। বর্গির ভয়ে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে কোম্পানির নির্দেশে গোবিন্দপুর সুতানটির মানুষ সেদিন কোদাল দিয়ে কেটে ফেলল কোলকাতার কিছু অংশ। বাগবাজার থেকে শুরু করে বৃত্তাকার পরিখা খননের কাজ যখন মধ্যপথে তখন জানা যায় মারাঠা বর্গীদের সঙ্গে নবাবদের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। চুক্তি হিসেবে তারা উঠাবে খাজনা। অবশেষে মরাখাদুর উপর দিয়ে নির্মিত হল সড়ক। বর্তমানে যা পরিচিত বাগবাজার মারাঠা ডিচ লেন এবং আপার লোয়ার সার্কুলার রোড। এক বৃদ্ধের ভাষ্য"আমাদের এ লেনটার সংগে মারাঠা বর্গি আক্রমনের যোগ আছে জানতাম, কিন্তু সার্কুলার রোডগুলো খাল ছিল তাতো জানতাম না"।

সতেরো শতকে প্রায় শেষপর্বে বঙ্গে মগ ফিরিঙ্গিদের অত্যাচারের অবসান হলেও সেই ক্ষত এবং যন্ত্রনা এ যুগের সমাজ আজও বহন করে চলেছে। যশোর, খুলনা, বরিশাল থেকে শিরু করে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা পর্যন্ত প্রভৃতি স্থানে বহু সংখ্যক মগ-ফিরিঙ্গীর যৌন সম্পর্কজাত সঙ্করজাতি ব্রাতজনের মতো আরণ্য জনপদের নিভৃত পল্লীতে বসবাস করে চলেছে। সুন্দরবনের সুন্দরী গরান হেতালের গুচ্ছ গুচ্ছ আঁধারে অন্তর্লীন হয়ে আছে তাদের জীবন।

তথ্যসূত্রঃ

১.বঙ্গে মগ-ফিরিঙ্গী ও বর্গীর অত্যাচার, মুহম্মদ আব্দুল জলিল।

২.সিয়ারে মুতাখ্খিরীন।

৩, বাঙলার ইতিহাস, আব্দুল করিম।

৪.পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি।

৫.আরও অন্যান্য বই।

পরিশেষে সবাইকে ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ