শেষ চিঠি (প্রতিযোগীতা)

নীরা সাদীয়া ১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৪১:৩৮অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি, সাহিত্য ৩০ মন্তব্য

প্রিয় মর্ত্যবাসী,
কেমন আছ সকলে? জানি, আমার চেয়ে ভাল আছ। তাই আজ আর চিঠিতে কোন প্রকার শুভেচ্ছা দিতে পারলাম না। কি দেব বলো? এখানে গোলাপ নেই, পায়ড়া নেই, ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক নেই, রাত জাগা তারা নেই, জোনাক জ্বলা রাত্রি নেই, নেই কালো কেশের দিগন্তজোড়া আঁধার। কারণ আমি নিজেই এখন সবুজ পৃথিবীর সমস্ত আলো আঁধারি মায়া ছেড়ে ছিটকে গেছি, রয়েছি কোন সীমাহীন গোলকধাঁধাঁয়, যেখান থেকে মুক্তির আর কোন পথ খোলা নেই।

অভিমানে আর গ্লানিতে আমি নিজেই বেছে নিয়েছিলাম এ গোলকধাঁধাঁর পথ, তখন একবারো ভাবিনি এ সবুজ পৃথিবী, অপূর্ব রূপসী জন্মভূমি, স্নিগ্ধ, শান্ত মাতৃকোল, বাবার প্রশান্ত স্নেহভরা মুখ, কোন কিছুই আর কোনদিন দেখতে পাবনা। কখনো ভাইয়ের সাথে খুনসুঁটি হবে না, বুবুর বিয়েতে আমি থাকব না! অথচ কত রঙিন স্বপ্ন দেখেছি, কত হুল্লোর করব বলে ভেবে রেখেছিলেম! বর আসবে, গেট ধরব, দুষ্টুমি করব অারো কত কি! সেসব আর কিছুই হল না। আমি আংটি আর পায়েল বড্ড ভালবাসতাম। বুবু বলেছিল, চাকরি পেয়ে সুন্দর একটা পায়েল আর এত্তগুলা আংটি কিনে দেবে। এখন আর কিচ্ছু চাই না রে। শুধু তোদের কাছে আবার ফিরতে চাই, তা কি সম্ভব? জানি সম্ভব না।আমার এ চিঠি তোদের কাছে আদৌ পৌঁছবে কিনা, তাও জানি না। যদি পৌঁছে, আমার ডায়েরীগুলো গুছিয়ে রাখিস বুবু, কাওকে পড়তে দিস না। আমি চাই না, এগুলো পড়ে কেউ আমার বেদনায় নীল হোক। ওর কথা জেনে কেউ গালাগাল দেবে ওকে, তাও যে আমার সইবে না। বড্ড ভালবেসেছিলাম রে। তুই তো জানিস বল। তবে এখন বুঝে গেছি, নিজের চাইতে বেশি ভাল আর কাওকে বাসতে নেই। তোরা যত পারিস কেঁদে নে, আমার জন্য অশ্রু বিসর্জন দেবার আর যে কেউ নেই!

ঐতো মা, মা...ও মা, বড্ড গলাটা শুকিয়ে গেছে।প্রচন্ড উত্তাপ এখানে। ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর এক কোণে একটা জানালা ছিল, কিন্তু এখানেতো একটাও জানালা নেই। কি করি আমি? হায়রে, মা তুমিতো আমার ডাক শুনতেও পাও না। বাবা, মা, বুবু, ভাই সবাইকে আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা আমাকে দেখছে না। কী অসহায় বোধ করছি আমি, কিযে দু:সহ যন্ত্রনা, তা বলে বোঝানোর নেই। প্রতিটি মুহূর্তে পিঁপড়ে, জোঁক, সাপ সহ নানা নাম না জানা ভয়ঙ্কর প্রানি আমাকে আক্রমণ করছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে এই দেহটাকে। এখানকার তেলাপোকাগুলো আরো বেশি ভয়ঙ্কর। কি করি এখন? হাত পাও নাড়াতে পারছি না। অথচ কদিন আগেই, তেলাপোকা দেখলে লাফিয়ে উঠতাম! মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে মুখ গুঁজতাম, আর সেই আমি এখন কী ভয়ানক যন্ত্রণার মাঝে আছি, তা যদি মা দেখতে!

আচ্ছা, মারিয়া, দীনা তোরা কেমন আছিস? এখনো তেঁতুল ভর্তা, বড়ই ভর্তা, ঝালমুড়ি আর ফুচকা কিনে খাস তোরা, ঐ মোড়ের মামাটার দোকান থেকে? মনে পড়ে এই আমিই নাকি অন্ধকারকে খুব ভালবাসতাম!
অথচ, পাতালপুরীর এই অন্ধকার আজ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে! যার কারণে একদিন স্বেচ্ছায় এই নরককে বেছে নিয়েছিলাম, সেও কি আসবে আমার কাছে? নিজের ভুল বুঝতে পেরে সেও কি স্বেচ্ছায় নরককে গ্রহন করবে আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য? এখানে যোগাযোগের জন্য কোন নেট নেই, নেই চিঠি পৌঁছানোর পায়ড়া কিংবা ডাকপিয়ন। তবু কী সুন্দরভাবে আমি সকল পাতা কিংবা মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। কী অবাক ব্যপার তাই না? এইতো সে,সবুজ বাতিতে আছে! আমার দেয়া বার্তাগুলি পড়েছে নিশ্চই। হুম, পড়েছে! কিন্তু উত্তর না লিখেই বার্তা কুঠুরী ত্যাগ করছে কেন? আমি দেখতে পাব না বলে? ও এখনো সেই বোকাই রয়ে গেল। একটা উত্তর লিখলেই পারত! আমি দেখি বা না দেখি। কিন্তু না, ওর কক্ষে আরো কত আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোকেই ঘাটছে, নাড়াচাড়া করছে। এত দ্রুত সব সয়ে গেল তার? আর আমি কিনা সইতে না পেরে......

আচ্ছা, আমিই তো একদা নিঃসঙ্গতা সইতে পারতাম না। অথচ আজ এ কি করলাম? সাময়িক নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচতে মহাকালের নিঃসঙ্গতায় ঝাঁপ দিলাম? আরে আমি কত বোকা! মা, আর কেঁদোনা তোমার এ বোকা মেয়েটার জন্য। বাবা, মা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। বুবু, তোর বিয়েতে সবই হবে, শুধু আমিই রইব নারে। ভাইটি আমার, বড় হয়ে ভুলে যাস, তোর মেঝদি তোকে ক্লাউড ক্যান্ডি আর পিংপং বল এনে দেয়নি, লাটাইয়ের সূতোটা পরিয়ে দেয় নি, ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে দেয়নি, তার আগেই তোদেরকে ঠকিয়ে নিজেও হেরে বসে আছে।

আমি যে সবদিক থেকে হেরে গেছি, তা বুঝতে পেরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না। বড্ড দেরী হয়ে গেছিল। পৃথিবীটা তখন আরো সুন্দর লাগছিল। কী মায়াময় এ পৃথিবীর রঙ, রূপ, আর কী স্নিগ্ধ জীবনের প্রতিটি স্পন্দন! আগেতো বুঝিনি। যখন বুঝেছি তখন বারবার চিৎকার দিয়ে বলতে চেয়েছিলেম, "বাঁচতে চাই"। জীবন তখন ভর্ৎসনা করে একগাল হেসে আমাকে জানাল,

"এ পরিণতি তুমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছ।এখন আর কিছুই তোমার হাতে নেই।"

ইতি,
নরকবাসী,
আত্নখুনী।

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ